কলকাতা, 14 এপ্রিল : মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Bengal CM Mamata Banerjee) যখন বিরোধী দলনেত্রী ছিলেন, তখন কথায় কথায় সিবিআই তদন্ত চাইতেন । আজ তিনি যখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, তখন সিবিআই তদন্তের নাগপাশে আষ্টেপিষ্টে ক্রমেই বাধা পড়ছে রাজ্য সরকার । গত কয়েকদিনে কলকাতা হাইকোর্ট একাধিক ঘটনায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে (Calcutta HC Orders CBI Investigation in Several Case of Bengal) ৷ আদালতের দৃষ্টিভঙ্গিতে স্পষ্ট যে, তাদের রাজ্যের পুলিশি ব্যবস্থার উপর ভরসা ক্রমশ কমছে ৷
তাই প্রশ্ন উঠছে যে এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে সাধারণ মানুষ কি রাজ্য প্রশাসন বা পুলিশের উপর ভরসা রাখতে পারবেন ? সাধারণ জনগণ ভরসা রাখতে পারবেন কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর আসার আগেই আগেই বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি মমতার সরকার বিরুদ্ধে সরব হয়েছে ৷ রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবিতে সরব হয়েছে তারা ৷ ফলে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে আরও একটি প্রশ্ন, একের পর এক মামলায় রাজ্য সরকার তথা পুলিশের উপর অনাস্থা এবং রাজ্যে আইনশৃঙ্খলার অবনতি কি ধীরে ধীরে সেই পথ প্রশস্ত করছে (Is Bengal on the verge of President Rule after the Court orders several CBI investigations) ?
এই প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক তথা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক রাজু রায় বলেছেন, ‘‘এই সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত । তাহলে সবচেয়ে বেশি দায়বদ্ধতা তাদের যদি কারও কাছে থাকে, তা হল বাংলার মানুষের কাছে । সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক বিষয়ে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ কোনও সন্দেহ নেই সাধারণ মানুষের মনে পুলিশ এবং প্রশাসনের কাজকর্ম নিয়ে প্রশ্ন চিহ্ন তুলে দিচ্ছে । যেভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি খুন হচ্ছে বাংলায়, তাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে রাজ্য সরকার, যেভাবে নাবালিকার ধর্ষণকে প্রেমের সম্পর্ক বলে ছোট্ট ঘটনা হিসাবে দেখানো হচ্ছে, তা মানুষের মনে প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে ।’’
তিনি মনে করেন, ভোটের ফল মানুষের সমর্থন প্রমাণের মাপকাঠি হলেও এর বাইরে কিন্তু জনমতের একটা প্রভাব থাকে । এতগুলি ঘটনায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ আদতে সরকারের ভাবমূর্তি নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে ৷
কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী কৌশিক গুপ্ত অবশ্য এই ধরনের রাজনৈতিক মতবাদের সঙ্গে তাঁর মতকে মিলিয়ে ফেলতে রাজি নন । তিনি বলছেন, ‘‘একাধিক মামলায় সিবিআই তদন্ত দেওয়ার অর্থ যে রাজ্য সরকার বা রাজ্য পুলিশের ওপর অনাস্থা প্রকাশ করছে আদালত এমনটা নয় । সাধারণত, আদালত সিবিআই তদন্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে সব সময় এই ধরনের ভাবনা-চিন্তা করে যে এ ক্ষেত্রে রাজ্য পুলিশের কাছে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করার জন্য আরও ভাল পরিকাঠামো এবং বিশ্বাসযোগ্য ব্যবস্থাপনা রয়েছে । এর অর্থ কিন্তু রাজ্য পুলিশ বা সরকারের উপর অনাস্থার নয় ।’’
তিনি আরও একধাপ এগিয়ে বলেছেন, ‘‘সম্প্রতি কলকাতা হাইকোর্ট একাধিক ধর্ষণের মামলায় দময়ন্তী সেনকে তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছে । সে ক্ষেত্রে আদালতের যদি এই সরকার বা রাজ্য পুলিশের প্রতি অনাস্থা থাকত, তাহলে দময়ন্তী সেনকে এই তদন্তভার দিত না । কাজেই একাধিক সিবিআই তদন্তের অর্থই সামগ্রিকভাবে আইন-শৃঙ্খলা প্রশ্নে সরকার বা পুলিশের ওপর আদালতের অনাস্থা হয়েছে এ কথা বলা যায় না ।’’
সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায় কিন্তু এই প্রশ্নে আইনজীবী কৌশিক গুপ্তকেই সমর্থন করেছেন । যদিও আদালতের বিচারাধীন বিষয় নিয়ে তিনি কোনও মতামত দিতে চাননি । তবে তিনি মনে করছেন, এই ধরনের সিবিআই তদন্তের নির্দেশ আদতে বিচার ব্যবস্থা তথা প্রশাসনের প্রতি মানুষের আস্থা ফেরানোর একটা উদ্যোগ এবং এটা ভীষণভাবেই গুরুত্বপূর্ণ ।
তিনি আরও বলেন, ‘‘একটা জিনিস লক্ষ্য করবেন আদালত এতগুলি সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিল ৷ কিন্তু রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে উচ্চতর বেঞ্চে না গিয়ে বরং একে স্বাগত জানাচ্ছে । এটা ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ ।’’ তবে তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন, এই যে একাধিক বিষয়ে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ, এর থেকে রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন বা 355 জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে এমনটা বলা যাবে না । বরং এমনটা করা হলে তা আইন এর অপব্যাখ্যা হবে বলে মনে করছেন তিনি ।
রাজ্যের প্রাক্তন দুঁদে আইপিএস অফিসার নজরুল ইসলাম জানিয়েছেন, রাজনৈতিক মহল বা নেতা নেত্রীরা যাই বলুন, বিগত সময়ে একাধিক মামলায় কখনও পুলিশের পদক্ষেপ, আবার কখনও রাজ্যের পুলিশমন্ত্রী তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য বিচার বিভাগকে একরকম বাধ্য করছে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিতে ।
এ প্রসঙ্গে তিনি সম্প্রতি নদিয়ার হাঁসখালিতে ধর্ষণের (Hanskhali Rape) ঘটনার উদাহরণ টেনে আনেন । যেভাবে প্রকাশ্যে এই ঘটনা সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রী ব্যাখ্যা করেছেন, পুলিশি তদন্তের আগেই ওই বিষয় নিয়ে মন্তব্য করে পুলিশের তদন্তকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছেন, সে কারণেই হাইকোর্ট বাধ্য হয়ে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে ।
তিনি আরও বলেন, ‘‘বগটুই কাণ্ডে যেভাবে পুলিশমন্ত্রীর নির্দেশের পর পুলিশ তৃণমূল কংগ্রেসের ব্লক সভাপতিকে গ্রেফতার করে সেখানে কিভাবে বিচারকরা পুলিশের উপর আস্থা রাখবেন ।’’ তাঁর মতে, যে যে ঘটনায় হাইকোর্ট সিবিআই তদন্ত দিয়েছে, সেক্ষেত্রে একরকমভাবে আদালতকে বাধ্য করা হয়েছে সিবিআই তদন্ত দিতে । আর এই কাজটা করেছেন পুলিশমন্ত্রী নিজেই ।
যদিও যে যাই বলুক, রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস (Trinamool Congress) আদালতের চাপে সিবিআই তদন্তকে স্বাগত জানালেও এর সাফল্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করতে ছাড়েনি । তৃণমূল সাংসদ সুখেন্দুশেখর রায় (TMC MP Sukhendu Sekhar Roy) বারবার আদালতকে উদ্ধৃত করে মনে করিয়ে দিয়েছেন যে সিবিআই খাঁচায় বন্দি তোতা পাখি । এমতাবস্থায় জনগণের কাছে সিবিআইয়ের সাফল্যের হার নিয়ে প্রচার চালাচ্ছে তৃণমূল । যেখানে তারা তুলে ধরছে যে সিবিআইয়ের হাতে জমে থাকা কেসের পাহাড়, যা এখনও সমাধান করতে পারেনি এই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ।
তৃণমূল কংগ্রেসের দাবি, 20 বছরেও সিবিআই রাজ্যের 112টি মামলার কোনও ফয়সালা করতে পারেনি । 20 বছর ধরে দিল্লিতে ফয়সালা করতে পারেনি 81টি মামলার । মহারাষ্ট্র ও বিহারে এই সংখ্যাটা যথাক্রমে 62 ও 52 । এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি শুধু মহারাষ্ট্রের এক হাজারের উপরে কেস সিবিআইয়ের হাতে পড়ে রয়েছে অসম্পূর্ণ ভাবে । একই ভাবে পশ্চিমবঙ্গে 905টি মামলা ৷ তৃণমূল কংগ্রেসের প্রশ্ন, সিবিআইয়ের যা ট্র্যাক রেকর্ড, তাতে শেষ পর্যন্ত বিচার পাবেন তো মানুষ ?