কলকাতা, 18 ফেব্রুয়ারি: রাজ্যের সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালেও বাড়ছে সিজারিয়ান সেকশনের হার। এর কারণ হিসাবে রয়েছে পরিকাঠামোগত খামতির পাশাপাশি আইনি সমস্যার বিষয়টিও। এমনই বলছেন সরকারি বেসরকারি চিকিৎসকরা।
এ দেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে সিজারিয়ান সেকশনের হার এখন 55 শতাংশ। তবে, বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে প্রসব করানোর অভিযোগ ওঠে নিত্যদিন ৷ যদিও তা মানতে নারাজ বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা ৷
বেসরকারি হাসপাতালের এক চিকিৎসক পৌষালী সান্যাল মনে করেন, ‘‘এই ‘আননেসেসারি সিজারিয়ান সেকশন’ কথাটির সঙ্গে আমি একমত নই। দরকার থাকলেই সিজারিয়ান সেকশন করা হয় ৷’’
তবে এক্ষেত্রে বিশ্ব সংস্থার বেঁধে দেওয়া নিয়মবিধি যে অমান্য করা হচ্ছে, তা একপ্রকার স্বীকার করেন নেন পৌষালী ৷ তিনি জানান, ‘‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) এক্ষেত্রে একটি স্ট্যান্ডার্ড বেঁধে দিয়েছে। হু বলেছে, সরকারি হাসপাতালে সিজারিয়ান সেকশনের হার হওয়া উচিত 5 থেকে 10 শতাংশের মধ্যে। কিন্তু বর্তমানে পরিমাণটা 30 শতাংশ। আর, বেসরকারি হাসপাতালের ক্ষেত্রে হু বলেছে, সিজারিয়ান সেকশন করা উচিত 20 থেকে 25 শতাংশ। সেখানে হচ্ছে 55 শতাংশ।’’
যদিও রোগীর স্বার্থেই সিজারিয়ান সেকশন করতে হয় বলে দাবি এই স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ৷ তিনি বলেন, ‘‘আননেসেসারি নয়, সব কিছু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে, প্রয়োজন থাকে বলেই সিজারিয়ান সেকশন করা হয় ৷ তবে এক্ষেত্রে অডিট হওয়া দরকার ৷ কিন্তু এ দেশে তা হয় না।’’
কিন্তু হঠাৎ করে সন্তান সম্ভবাদের অস্ত্রোপচার করাটা এত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ল কেন? এর উত্তরে পৌষালী জানান, ‘‘বেসরকারি হাসপাতাল বা বেসরকারি চিকিৎসকের কাছে যে মহিলারা চিকিৎসার জন্য যান, তাঁরা অধিকাংশই উচ্চবিত্ত এবং 30 বছরের বেশি বয়সে প্রথমবার সন্তানসম্ভবা হন ৷ বয়সজনিত কারণেই বাড়ে জটিলতা ৷ এই ধরনের বহু মহিলাই উচ্চ রক্তচাপ, হাই ব্লাড সুগার, ওবেসিটি, থাইরয়েড ও অ্য়াজমার সমস্য়ায় ভোগেন ৷ কাজের চাপ ও মানসিক অস্থিরতাতেও ক্ষতি হয় গর্ভস্থ সন্তানের ৷ এইসব কারণেই সিজারিয়ান সেকশনের সাহায্য নিতে হয় ৷ আবার অনেক সময় বয়স 30 বছরের বেশি হলে নির্দিষ্ট তারিখ পেরিয়ে যাওয়ার পরও প্রসব বেদনা ওঠে না ৷ ফলে অস্ত্রোপচার করতে হয় ৷’’
আরও পড়ুন: অ্যাম্বুলেন্সেই প্রসব, দৃষ্টান্ত স্থাপন কর্নাটকের
অন্যদিকে, সরকারি হাসপাতালে বেসরকারি হাসপাতালের তুলনায় কম হলেও সিজারিয়ান সেকশনের প্রবণতা বাড়ছে ৷ এর কারণ হিসাবে পৌষালী বলেন, ‘‘নরমাল ডেলিভারির একটি প্রসেস থাকে। এটি 12 ঘণ্টা, 24 ঘণ্টা, এমনকী 36 ঘণ্টা ধরে চলতে পারে ৷ এই দীর্ঘ সময় ধরে মা ও গর্ভস্থ সন্তানের হৃদস্পন্দনের উপর নজর রাখতে হয় চিকিৎসকদের ৷ কিন্তু সরকারি হাসপাতালে সেই পরিকাঠামো নেই ৷ তাই চিকিৎসকরা অনেক ক্ষেত্রেই ঝুঁকি নিতে চান না ৷’’
কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের চিকিৎসক তারাশংকর বাগ বলেন, ‘‘সিজারিয়ান সেকশনের হার আজকাল খুবই বেড়ে যাচ্ছে। এটা চিন্তার বিষয়। আইডিয়ালি সিজারিয়ান সেকশনের হার 15 থেক 25 শতাংশ হওয়া উচিত। কিন্তু, আজকাল দেখা যাচ্ছে, সরকারি এবং বেসরকারি, সব ক্ষেত্রেই সিজারিয়ান সেকশনের হার বেড়ে গিয়েছে। সরকারি ক্ষেত্রে সিজারিয়ান সেকশনের হার এখন 50 শতাংশের মতো। আর বেসরকারি ক্ষেত্রে সিজারিয়ান সেকশনের আর 80 থেকে 90 শতাংশের মতো। ইংল্যান্ড, আমেরিকার মতো উন্নত দেশে সিজারিয়ান সেকশনের হার আমাদের দেশের মতো এত বেশি নয়।’’ অর্থাৎ এক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকের দেওয়া পরিসংখ্যানে বেশ বড়সড় ফারাক রয়েছে ৷
সিজারিয়ান সেকশন বাড়ার কারণ প্রসঙ্গে ডাঃ বাগ বলেন, ‘‘আমাদের দেশে যন্ত্রণাহীন নরমাল ডেলিভারির ব্য়বস্থা খুবই কম ৷ ফলে রোগীরাও অনেক সময় সিজারিয়ান সেকশনের দিকেই ঝুঁকে পড়েন। তাছাড়া, এখন আইনি ঝঞ্ঝাটও মারাত্মক বেড়েছে ৷ কোনও কারণে ডেলিভারির সময় মৃত্যু মা বা সন্তানের মৃত্য়ু হলে নানা সমস্য়া হয় ৷ এসব এড়াতে প্রত্য়েক রোগীকে আলাদাভাবে নজরে রাখতে হবে ৷ সেই পরিকাঠামো আমাদের নেই ৷’’
কিন্তু গোটা বিশ্বের তথ্য অনুযায়ী দেখা গিয়েছে, সিজারিয়ান সেকশনে প্রসূতি এবং শিশুর মৃত্যুর হার নরমাল ডেলিভারির তুলনায় গড়ে অনেকটাই বেশি। তাছাড়া, কোনও কোনও ক্ষেত্রে নরমাল ডেলিভারির তুলনায় সিজারিয়ান সেকশনেও ঝুঁকি বেশি থাকে ৷