কলকাতা, 2 জুলাই : পশ্চিমবঙ্গে ভোট পরবর্তী হিংসা নিয়ে রাজ্য়ের সরকার তথা পুলিশ, প্রশাসনকে কার্যত তুলোধনা করে ছাড়ল কলকাতা হাইকোর্ট ৷ ইতিমধ্য়েই এই ইস্যুতে একাধিক জনস্বার্থ মামলা রুজু হয়েছে ৷ মামলাগুলির শুনানি একত্রে চালানো হচ্ছে পাঁচ বিচারপতির বিশেষ বেঞ্চে ৷ শুক্রবার সেই বেঞ্চে শুনানি চলাকালীনই রাজ্য়ের সরকার, পুলিশ এবং প্রশাসনকে কড়া ভাষায় ভর্ৎসনা করেন বিচারপতিরা ৷ দেন একাধিক নির্দেশ ৷
আদালত তার পর্যবেক্ষেণ জানিয়েছে, মামলাকারীদের বয়ান পড়েই বোঝা যাচ্ছে, ভোটপর্ব মেটার পর থেকেই রাজ্য়ে হিংসা চলছে ৷ কিন্তু সরকার প্রথম থেকেই ভুল পথে চালিত হয়েছে ৷ তারা প্রথম থেকেই গোটা বিষয়টিকে অস্বীকার করে গিয়েছে ৷ ভোট পরবর্তী হিংসায় বহু মানুষ খুন হয়েছেন ৷ অনেকের উপর যৌন নির্যাতন চালানো হয়েছে এবং আক্রান্তদের অনেকেই গুরুতর জখম হয়েছেন ৷ এমনকী নাবালিকাদেরও রেয়াত করা হয়নি ৷ তাদের অকথ্য যৌন নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে ৷ বহু মানুষকে তাঁদের ঘরবাড়ি, সম্পত্তি হারাতে হয়েছে ৷ তাঁরা বাধ্য হয়েছেন বাড়ি ছেড়ে পালাতে ৷ এমনকী, এঁদের অনেকেই বর্তমানে ভিনরাজ্যে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন ৷ আজ পর্যন্ত রাজ্য সরকার সেই বাতাবরণ তৈরি করতে পারেনি, যার উপর ভরসা করে ঘরছাড়ারা ঘরে ফিরতে পারেন ৷ নিজেদের কাজকর্ম, রুজিরুটি শুরু করতে পারেন ৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুলিশ আক্রান্তদের অভিযোগ গ্রহণ করেনি ৷ উপরন্তু তাঁদের বিরুদ্ধেই পাল্টা মামলা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে ৷
আরও পড়ুন : Post Poll Violence : রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি নিয়ে কেন্দ্রের মত জানতে চাইল সুপ্রিম কোর্ট
আদালতের মতে, গোটা ঘটনায় রাজ্য়ের অবস্থান হতবাক করে দেওয়ার মতো ৷ সরকার পক্ষ বার বার দাবি করে আসছে, ভোট পরবর্তী হিংসা নিয়ে কোনও অভিযোগই নাকি জমা পড়েনি ৷ অথচ আক্রান্তদের যখন ‘রাজ্য আইনি পরিষেবা কর্তৃপক্ষ’-এর (এনএইচআরসি) মাধ্যমে অভিযোগ জানানোর সুযোগ দেওয়া হয়, তখন তাদের কাছে অভিযোগের বন্যা বয়ে যায় ৷ আক্রান্তরা এতটাই ভীত, সন্ত্রস্ত হয়ে আছেন, যে তাঁরা নিজেদের পরিচয় পর্যন্ত প্রকাশ্যে আনতে চাইছেন না ৷ তাঁদের ভয়, এতে তাঁদের প্রাণ খোয়াতে হতে পারে ৷ তাঁদের সম্পত্তি ছিনিয়ে নেওয়া হতে পারে ৷
এই পর্যায়েই পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকার কড়া সমালোচনা করেছে কলকাতা হাইকোর্ট ৷ আদালতের তরফে গোটা বিষয়টিকেই গুরুত্ব সহকারে বিবেচনাধীন বলে উল্লেখ করা হয়েছে ৷ এই প্রসঙ্গে আদালতের মনে হয়েছে, ভোট পরবর্তী হিংসার যে ক’টি অভিযোগ দায়ের হয়েছে, সেগুলিরও তদন্ত দায়সারাভাবে করা হয়েছে ৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যাঁরা এই ধরনের ভয়ঙ্কর অপরাধের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি ৷ এমনকী, বেশ কয়েকটি ঘটনা শুনে মনে হয়েছে, সেগুলিতে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা রুজু হওয়া উচিত ছিল ৷ অথচ, আক্রান্তদের অভিযোগটাও নথিভুক্ত করা হয়নি ৷ অধিকাংশ মামলাতেই অভিযুক্তরা জামিন পেয়ে গিয়েছেন ৷
আরও পড়ুন : ভোট-পরবর্তী হিংসা মামলায় পুলিশের আচরণে ক্ষুব্ধ হাইকোর্ট
প্রসঙ্গত, ভোট পরবর্তী হিংসার অভিযোগ খতিয়ে দেখতে ইতিমধ্যেই জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের নেতৃত্বে একটি কমিটি তৈরি হয়েছে ৷ এদিন আদালত সেই কমিটির অন্তর্বর্তী রিপোর্টকেও রেকর্ড করেছে ৷ তাতে দাবি করা হয়েছে, কমিটি এই ইস্যুতে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের কাছে যে সমস্ত প্রশ্ন তুলেছিল, তার কোনও সদুত্তর মেলেনি ৷ এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে, এখানে যতটা বিষয় প্রকাশ্যে আনা হচ্ছে, তার থেকে অনেক বেশি গোপন করা হচ্ছে ৷
ভোট পরবর্তী হিংসার শিকার মানুষজন যে ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে দিন কাটাচ্ছেন, কার্যত তাও মেনে নিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট ৷ সংশ্লিষ্ট বিশেষ বেঞ্চের পর্যবেক্ষণ, হিংসার শিকার এই মানুষগুলো নিজেদের চিকিৎসা পর্যন্ত করাতে পারছেন না ৷ রাজ্য়ের তরফে তাঁদের কোনও সহযোগিতা করা হচ্ছে না ৷ এমনকী, অনেকে রেশনও তুলতে পারছেন না ৷ কারণ, কিছু গুন্ডা তাঁদের রেশন কার্ড ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছে ৷