কলকাতা, 17 জানুয়ারি : রবিবারই নক্ষত্র পতন হয়েছে বাংলা তথা ভারতীয় নাট্য জগতে ৷ নীরবেই চলে গিয়েছেন শাঁওলি মিত্র ((Shaoli Mitra Passes Away)) ৷ বাবা শম্ভু মিত্রর পথই বেছে নিয়েছেন তিনি ৷ বাবার মতোই চাননি তাঁর মৃত্যুতে শোক উদযাপনের কোনও হিরিক পড়ুক বা তাঁকে শেষ দেখা দেখতে মানুষের ভিড় হোক ৷ মৃত্যুর আগে ইচ্ছেপত্রে শাঁওলি লিখেছেন, শেষকৃত্যের পরই যেন তাঁর মৃত্যুসংবাদ জানানো হয় সকলকে । তাঁর সেই ইচ্ছেকে মান্যতা দিয়েই অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার পরেই প্রয়াণের খবর অনুরাগীদের সামনে আনেন তাঁর নাট্যসঙ্গী তথা রাজনীতিবিদ অর্পিতা ঘোষ । শনিবার সিরিটি মহাশ্মশানে শেষকৃত্য সম্পন্ন হয় শম্ভু মিত্র ও তৃপ্তি মিত্রর কন্যা শাঁওলির ৷
এক সময় শাঁওলি মিত্রর বাড়িতে থেকে অভিনয়ের পাঠ নিতেন অভিনেতা সুদীপ সেনগুপ্ত । প্রসঙ্গত, সুদীপ বাংলা টেলিভিশনের জনপ্রিয় মুখ । 2010 সালে 'কেয়া পাতার নৌকো' দিয়ে টেলিজার্নি শুরু তাঁর । সেই থেকে এখনও পর্যন্ত বিভিন্ন চরিত্রে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে চলেছেন সুদীপ । এই মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে রয়েছেন 'খেলাঘর' ধারাবাহিকে । শাঁওলি মিত্রর প্রয়াণে শোকস্তব্ধ তিনি ৷ ইটিভি ভারতকে বলেন,"অভিভাবকহারা হলাম বলে মনে হচ্ছে আজ । কত স্মৃতি দিদিকে ঘিরে । আজ সব তালগোল পাকাচ্ছে । কিছুই সেভাবে মনে পড়ছে না । খুব অসুস্থ ছিলেন ৷ ক'দিন আগে পা ভেঙে গিয়েছিল । আর্থ্রাইটিসে ভুগছিলেন । হাসপাতালেও ভর্তি হতে চাইতেন না । দিদি কারওকে জানাতে চাননি । আমিও জানলাম কিছুক্ষণ আগেই । দিদির বাড়িতে একটা সময় থাকতাম আমি একটা কাজের সূত্রে । দিদির সঙ্গে আমার প্রথম দেখা 2006 সালে । তখন রবীন্দ্রভারতীতে আমি নাটক নিয়ে পড়াশুনা করি । উনি এসেছিলেন একটা ওয়ার্কশপ করাতে । আমি আমাদের এক প্রফেসরকে বলি, আমি কোনও একটা দলে যুক্ত হতে চাই নিয়মিত অনুশীলনের জন্য । তখন উনিই বলেন এর জন্য শাঁওলিদি'র বিকল্প আর কেউ হতে পারে না । এরপর শাঁওলি দি'র সঙ্গে দেখা হয় । মনের ইচ্ছা জানাই । ইন্টারভিউ দিয়ে জয়েন করি 'পঞ্চম বৈদিক'-এ ।"
আরও পড়ুন : প্রয়াত শাঁওলি মিত্র, নীরবে না ফেরার দেশে শম্ভু-কন্যা
সুদীপের স্মৃতিচারণায় উঠে এল আরও বহু কথা ৷ বললেন, "দিদি হিন্দিতে 'নাথবতী অনাথবৎ' লেখার সময় তাঁকে সহযোগিতা করার সুযোগ পেয়েছি । তখন দিদির বাড়িতেই থাকতাম আমি । 'নাথবতী অনাথবৎ'-এ দীর্ঘদিন মঞ্চের পিছনে গান গেয়েছি আমি ।" অর্পিতা ঘোষের নির্দেশনায় 'ঘরে বাইরে'তে অমূল্য চরিত্রে অভিনয় করতেন সুদীপ । সেই নাটকে দেবদূত ঘোষ এবং শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়ও অভিনয় করতেন । সেই স্মৃতি আওড়ে সুদীপ জানান, "আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রপ্স নিয়ে স্টেজে উঠতে ভুলে গিয়েছিলাম একটা শো'তে । সেদিন শাঁওলি দি আমার অভিনয় দেখতে এসেছিলেন । আর সেদিনই ওরকম ভুল । স্টেজে কায়দা করে ম্যানেজ দিয়েছিলাম । পরে ভয়ে ভয়ে দিদির কাছে নিজের ভুলের কথা বলতে গেলে, আমায় না বকে উল্টে উনি প্রশংসা করেছিলেন । বলেছিলেন, দিদির মা অভিনেত্রী তৃপ্তি মিত্র নাকি একবার 'রক্তকরবী'র একটা শো-তে কুন্দফুলের মালা নিতে ভুলে গিয়েছিলেন । তিনিও সেদিন স্টেজে মেক-আপ দিয়েছিলেন । আমার সেই স্টেজে মেক-আপ দেওয়ার সাহসিকতার উনি তারিফ করেছিলেন সেদিন । দিদি ভাল কাজের প্রশংসা করতেন মুক্তকণ্ঠে । কত কিছু যে শিখেছি দিদির কাছে তা বলে শেষ করা কঠিন । 'কেয়া পাতার নৌকো' তে অভিনয় করার সুযোগ পেয়ে দিদিকে প্রণাম করতে গিয়েছি । দিদি আমাকে বললেন, কাজ করার সুযোগ পেয়েছো ভাল কথা । এমন কাজ কখনও ইন্ডাস্ট্রিতে গিয়ে কোরও না, যাতে পিছলে যেতে হয় । যেন আমার, অর্পিতার (ঘোষ) আর তোমার বাবা-মায়ের মাথা হেঁট না হয় । পিছলে যেওনা । এটুকুই বলার তোমাকে । এখনও কানে বাজে কথাটা । কথাটা মনে রাখব চিরকাল ।"
সাম্প্রতি 'সীতাকথা' নাটকে অভিনয় করছিলেন শাঁওলি মিত্র । সেখানেও গান গেয়েছেন সুদীপ ৷ সেই স্মৃতি আওড়ে সুদীপ জানান, "আমাকে একদিন দিদি ফোন করে বললেন, সীতাকথাতে গান গাইতে হবে তোকে । কারণ যারা গাইছে তাদের গলা উঁচুতে ওঠে না । আর মঞ্চে গাওয়ার জন্য উঁচু গলার প্রয়োজন । তার জন্য তোর গলাটা আদর্শ । শাঁওলি দি'র মতো একজন গুণী মানুষের কাছ থেকে এরকম কদর পাওয়া আমার কাছে সবকিছু পেয়ে যাওয়ার মতো । আরও অনেক কাজ তো করতে চেয়েছিলাম দিদির সঙ্গে । এ কী হল ..." ভেজা কণ্ঠে সুদীপ সংযোজন, "জীবনে যখনই ভাল কিছু হয়েছে সবসময় দিদিকে আগে জানিয়েছি । এরপর কাকে জানাব ?"