আসানসোল, 19 অক্টোবর : যখন তখন ফেটে যাচ্ছে ঘরের দেওয়াল । চোখের সামনে আস্ত বাড়ি ঢুকে যাচ্ছে মাটির ভেতরে ! এভাবে পাতালগ্রাসে মৃত্যু হয়েছে কত মানুষের । এমন ঘটনার পাশেই জীবন বাজি রেখে বসবাস অসহায় মানুষগুলোর । যদিও এটাই স্বাভাবিক ঘটনা খনি অঞ্চলে । আসানসোল-রানিগঞ্জের 170টি মৌজার প্রায় 70 হাজার মানুষ এভাবেই বাঁচেন । বাঁচা-মরা গায়েগায়ে । যেন প্রতিবেশী !
কুলটির সাঁকতোড়িয়ার শিশুবাগান । 2000 সালের পর থেকেই এলাকাটি বিপজ্জনক হয়ে ওঠে । বর্ষা এলেই মাটি ফুঁড়ে গলগল করে ধোঁয়া বের হয় । তারপরেই ধস ! ভেঙে পড়ে বাড়ি । আসলে অতীতে ব্রিটিশ কোল কম্পানি এই এলাকা থেকে কয়লা খনন করেছিল ৷ কয়লা তোলা হলেও ফাঁকা ভূতল নিয়মমাফিক ভরাট করা হয়নি । তার ফলেই বিপত্তি ৷ তাছাড়া মাটির তলায় এখনও রয়ে যাওয়া কয়লার স্তরে আগুন লেগে যায় মাঝেমাঝে । বৃষ্টির জল চুঁইয়ে খনিতে ঢুকলে অক্সিজেনের মাত্রা বাড়ে, এতে আগুন বড় হয় ৷ বেরোতে থাকে ধোঁয়া । এভাবে মাটির তলার কয়লার সবটা পুড়ে ছাই হলেই ভূমির উপরের অংশ ধসে যায় আচমকা । মাটির তলায় ঢুকে যায় ঘরবাড়ি, সংসার, জীবন !
আটবছর আগের ঘটনা ৷ শিশুবাগান এলাকায় নিজের বাড়ির উঠোনে দাঁড়ানো অবস্থায় মাটির তলায় চলে যায় এক যুবতি । চার দিন পর তিরিশ ফুট নিচ থেকে উদ্ধার হয় তাঁর কংকালসার দেহ । যে বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে ছিলেন যুবতি, সেই বাড়িটিরও পাতাল প্রবেশ হয় পরবর্তীকালে । জায়গাটায় এখন মাটির স্তূপ ! বোঝা মুশকিল, বাড়ি ছিল । যুবতির পরিবার অন্য কোথাও চলে গেলেও ওই বাড়ির দু'ফুট দূরে বসবাস করেন আরও এক পরিবার । তারপরও, বাড়ি আরও আরও । এভাবে মৃত্যুপুরীতে জীবন বাজি রেখে বসবাস করছেন ধস কবলিত এলাকার 30টি পরিবার । অন্যত্র জমি কিনে বাড়ি করার ক্ষমতা নেই । অতএব, সরকারি পুনর্বাসনের অপেক্ষা ! এদের কারও বাড়িতে বিপজ্জনক ফাটল ধরেছে, কারও বাড়ির একদিকের দেওয়াল পড়ে গেছে । অনেকের উঠোন বসে যাচ্ছে ধীরে ধীরে । ভয়ে বৃষ্টি এলেই ঘর ছেড়ে খোলা আকাশের নিচে এসে দাঁড়ান ওঁরা ৷ ভিজেই কাটে রাত । বৃষ্টিতে যে ধসের সম্ভাবনা বেশি !
স্থানীয় বাসিন্দা আসমা খাতুনের অভিযোগ, "ভোট এলে নেতারা আসে, প্রতিশ্রুতি দেয় । ভোট পেরোলে কেউ খোঁজ রাখে না । পুনর্বাসন মেলে না ।"
তিনি আরও বলেন, "আমরা গরিব ৷ কোথাও যাব ! সখ করে এখানে থাকি না ৷ বহুবার আবেদন করেছি পুনর্বাসনের জন্যে, কিন্তু ভোটের পরে নেতারা ভুলে যায় ।"
আরেক বাসিন্দা মেহেরুন্নিসা বিবি বলেন, "জানিয়ে ছিলাম প্রশাসনকে ৷ বলেছে, যতক্ষণ না বাড়ির বড় ক্ষতি হবে, ততক্ষণ পুনর্বাসন দেওয়া হবে না ৷"
যদিও 2009 সালে তৎকালীন বাম সাংসদ হারাধন রায়ের করা জনস্বার্থ মামলায় ফল মিলেছিল ৷ এরপরই কেন্দ্রীয় সরকারকে ধস কবলিত এলাকার মানুষের পুনর্বাসনের নির্দেশ দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট । সেই মতো কেন্দ্রের কয়লা মন্ত্রক 2653 কোটি টাকা মঞ্জুর করে ৷ আসানসোল-দুর্গাপুর উন্নয়ন সংস্থা (ADDA) কাজটির নোডাল এজেন্ট হয় । অর্থাৎ টাকা দেবে কেন্দ্র, আবাসন তৈরি করবে রাজ্য । যদিও বাম আমলে কাজে চূড়ান্ত ঢিলেমির অভিযোগ ওঠে । "পরিবর্তন"-এর পরও তেমন গতি আসেনি ৷ ADDA এলাকার সার্ভে শেষ করতেই বহু বছর লাগিয়ে দেয় । বর্তমানে রাজ্যের আবাসন বিভাগ ধস কবলিত এলাকার মানুষের পুনর্বাসনের জন্য বেশ কয়েকটি আবাসন তৈরি করছে বটে, তবে এলাকাগুলিতে পানীয় জল ও নিকাশির সঠিক ব্যবস্থা না হলে বাসিন্দাদের পুনর্বাসন দেওয়া যাবে না, জানাচ্ছেন ADDA-র চেয়ারম্যান তাপস বন্দ্যোপাধ্যায় ।
তাপসবাবুর বলেন, "বিভিন্ন জায়গায় পুনর্বাসনের জন্য আবাসন তৈরি হচ্ছে ৷ শুরুতে ECL-এর সঙ্গে জমি নিয়ে সমস্যা হচ্ছিল ৷ পরে সে সমস্যা মেটে ৷ 160টি ফ্ল্যাট তৈরি আছে ৷ আগামী নভেম্বরে মুখ্যমন্ত্রী যখন জেলা সফরে আসবেন, আশা করছি, তখন তাঁর হাত দিয়ে ফ্ল্যাট হস্তান্তর করা যাবে ৷ "
ততদিনে আরও কিছু বাড়ি খেয়ে নেবে না তো খনি ? আরও মৃত্যু দেখবে না তো আসানসোল রানিগঞ্জের শিশুবাগান ? তাছাড়া আপাতত 160টি ফ্ল্যাট মোটে ৷ তার মানে সকলের নিস্তার নেই । কী হবে বাকিদের ?