ETV Bharat / briefs

লিভার দিয়ে বাবাকে বাঁচিয়ে অনন্য সাহসিনী

নিজের লিভারের ৬৫% দান করে বাবাকে বাঁচিয়েছেন হাওড়ার রাখি দত্ত। তাঁর এই কাজকে কুর্নিশ জানিয়েছে নেটিজেনরা। যদিও তিনি আশ্চর্য কিছু করেননি বলে জানিয়েছেন।

রাখি দত্ত
author img

By

Published : Apr 24, 2019, 11:53 PM IST

Updated : Apr 28, 2019, 11:02 PM IST

কলকাতা, 24 এপ্রিল : কয়েকদিন আগেই সোশাল মিডিয়ায় একটি ছবি ভাইরাল হয়। ছবিতে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রয়েছেন বাবা আর মেয়ে। দু'জনের মুখেই হাসি। যদিও ছবিতে দেখা যায় দু'জনের পেটেই বড়সড় অস্ত্রোপচারের না মেলানো দাগ। ছবিটা আসলে ছিল এক গর্বিত বাবার গর্বিত মেয়ের ছবি। সত্যিই গর্বের। কারণ, তাঁরা দু'জনেই যা করেছেন অনেকেই তা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেন না। ১৯ বছরের রাখি দত্ত তাঁর লিভারের ৬৫ শতাংশ দান করেছেন বাবাকে। কারণ তাঁর বাবার লিভার নষ্ট হয়ে যায়। একমাত্র উপায় ছিল লিভার প্রতিস্থাপন। কিন্তু উপযুক্ত ডোনার পাওয়া যায়নি। হাল না ছেড়ে তাই বাবাকে নিজের লিভারের ৬৫ শতাংশ দান করেন রাখি দত্ত। আর রাখির এই কীর্তিকেই এখন কুর্নিশ জানাচ্ছে নেটিজেনরা। তবে সেসবে পাত্তা দিতে নারাজ রাখি। ETV ভারতকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তাই জানালেন, বাবার কাছে ১৯ বছর ধরে যা চেয়েছেন তাই পেয়েছেন। তাই এটুকু বাবার জন্য তিনি করতেই পারেন। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

আমাদের প্রতিনিধিকে রাখি বলেন, লিভার প্রতিস্থাপন হয়েছিল ২৭ ফেব্রুয়ারি। অপারেশনের ধকল তিনি কাটিয়ে উঠেছেন। কেমন আছেন জানতে চাইলে একমুখ হাসিতে বললেন, "ভীষণ ভালো আছি।" জানালেন, অপারেশনের ধকল কাটিয়ে তিনি শারীরিকভাবে এখন ঠিক আছেন।

ETV ভারত : কেমন আছেন এখন ?

রাখি : আমি এখন খুবই ভালো আছি ।

ETV ভারত : আপনার অপারেশন কবে হয়েছিল ?

রাখি : ২৭ ফেব্রুয়ারি ।

ETV ভারত : সোশাল মিডিয়ায় আমরা অনেক কিছুই দেখেছি । কিন্তু আসলে কী ঘটেছিল ?

রাখি : আমার বাবা স্বাভাবিকই ছিলেন । হঠাৎ তার জন্ডিস ধরা পড়ল । বাবার বিলিরুবিন ১ সপ্তাহের মধ্যে ১৮ থেকে বেড়ে ৪৭ হয়ে যায় । প্রথমে আমরা কলকাতার একটি হাসপাতালে বাবাকে ভরতি করি । ২০ দিন হাসপাতালে ভরতি ছিলেন । এরপর ডাক্তার আমাদের জানান, বাবার লিভার নষ্ট হয়ে গেছে । সিরোসিস অফ লিভার হয়েছিল । আর কিছু করা যাবে না । এরপর আমরা বাবাকে হায়দরাবাদে নিয়ে যাই । সেখানে এশিয়ান ইন্সটিটিউট অফ গ্যাস্ট্রোএন্ট্রোলজিতে তাঁকে ভরতি করা হয় । স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর ডাক্তার জানান, বাবার লিভারের ৯০ শতাংশ নষ্ট হয়ে গেছে । লিভার প্রতিস্থাপন ছাড়া কোনও উপায় নেই । আমরা তখনও লিভার প্রতিস্থাপন বিষয়ে কিছুই জানতাম না । ডাক্তার আমাদের জানান যে, পরিবারের কাউকে লিভার দিতে হবে। প্রথমে ঠিক ছিল আমার মা লিভার দেবেন । কিন্তু মায়ের অতিরিক্ত ওজন এবং নার্ভের সমস্যার জন্য তা সম্ভব নয় । আমরা দুই বোন । দিদির লিভারের কাঠামো অন্য রকম তাই তাঁর থেকেও লিভার নেওয়া যায়নি । তারপরে সিন্ধান্ত নেওয়া হয় যে আমি বাবাকে লিভার দেব । প্রথমে বাবা রাজি হয়নি । কারণ আমি বয়সে ছোট । ডাক্তাররাও প্রথমে আমার বয়সের জন্য রাজি হচ্ছিলেন না । এরপর আমার ১০৯ রকম মেডিকেল টেস্ট হয় । রিপোর্টে আমার লিভারে একটি সমস্যা ধরা পড়ে । ডাক্তাররা জানান, আমার ক্ষেত্রে বিষয়টি ঝুঁকির হবে । কিন্তু যেহেতু দিদি বা মা কেউই এই অপারেশনের জন্য তৈরি ছিল না তাই সিদ্ধান্ত হল যে আমি বাবাকে লিভার দেব । বলা হল আমার ৬৫ শতাংশ লিভার নেওয়া হবে । এরপর আমাদের অপারেশন হল ।

এরই মধ্যে বাবার অনেকরকম সমস্য দেখা দিচ্ছিল । মানসিক সমস্যাও দেখা দিয়েছিল । অপারেশনের ১ সপ্তাহের মধ্যে বাবার স্বাস্থ্যের উন্নতি হতে শুরু করে । এখন অনেক ভালো আছেন ।

ETV ভারত : যে মেয়েটি ইনজেকশনকেও ভয় পায় সে এত বড় একটা কাজ করল। কী বলবেন ?

রাখি : আমি এর আগে আমার রক্তের গ্রুপ জানতাম না । কোনওদিন আমি রক্ত দিইনি । সাধারণ জ্বর ছাড়া কখনও ডাক্তার দেখাতে হয়নি । এই প্রথম আমি ১০৯ টি টেস্ট করাই । প্রথমে আমার ১৬ বার রক্তের নমুনা নেওয়া হয়েছিল । ৩ দিনের মধ্যেই এই পরীক্ষাগুলো হয়েছিল ।

ETV ভারত : এখনও কি ইনজেকশনে ভয় পান ?

রাখি : তখন রক্ত নেওয়ার সময় ভয় পাইনি । কারণ বাবাকে সুস্থ করতে বদ্ধপরিকর ছিলাম । স্ক্যান, MRI ইত্যাদি অনেক পরীক্ষাই হয়েছে । ভয় পাইনি । তবে এখন রক্ত নিতে এলে দেব না ।

ETV ভারত : অপারেশনটা কত ঘণ্টার ছিল ?

রাখি : ১৫ ঘণ্টা ।

ETV ভারত : অপারেশনের আগে আপনার মাথায় কী চলছিল ?

রাখি : অপারেশনের আগের দিন একটা বোর্ড মিটিং হয়েছিল । এই মিটিংয়ে ১৬ জন ডাক্তার ছিলেন । তাঁরা জানান, স্বাস্থ্য পরীক্ষার রিপোর্ট যে সবসময় ঠিক হবে এমন কোনও মানে নেই । অপারেশন টেবিলে আমার মৃত্যুও হতে পারে । এই অপারেশনটা ৯৫ শতাংশ সুরক্ষিত । কিন্তু ৫ শতাংশ ঝুঁকি থেকেই যায় । যেমন অনেকের হৃদস্পন্দন ধীরে চলতে থাকে । এই বিষয়গুলো আমাকে বলা হয়েছিল । কিন্তু আমি বাবার জন্য ৫ শতাংশ ঝুঁকি নিতেই পারি । আমি যদি আমার বাবার জন্য না করি তাহলে একটা বাইরের লোক নিজের লিভার কেন দেবে ? ১৮ বছর ধরে বাবার কাছে যা চেয়েছি সব দিয়েছেন । একদিনও না বলেননি । আমি তাঁর জন্য ৫ শতাংশ ঝুঁকি নিতে পারব না ? ওই দিনই আমি বন্ডেও সই করি ।

ETV ভারত : অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়ার সময় আপনার পাশে কে কে ছিলেন ?

রাখি : আমার মা, দিদি, বন্ধুরা এবং মামা ।

ETV ভারত : আপনার অপারেশন নিয়ে তাঁদের প্রতিক্রিয়া কী ছিল ?

রাখি : তাঁরা যে চিন্তায় আছেন সেটা আমাকে বুঝতে দেননি । সকাল ৬ টায় আমাকে OT-তে ঢোকানো হয়েছিল । সেইসময় আমারও অল্প চিন্তা হচ্ছিল যে কী হবে । রাত ১১ টায় আমার জ্ঞান এসেছিল । তখন বুঝতেই পারছিলাম না আমার অপারেশন হয়ে গেছে । অপারেশনের পরের দিন আমার বাবা মোটামুটি সুস্থ হয়ে গেছিলেন । পরের দিনই ICU-র বিছানা ছেড়ে উঠে হেঁটেছিলেন। অপারেশনের পর তিন দিন পর্যন্ত আমি ভাবছিলাম এত তাড়াতাড়ি সব ঠিক হয়ে গেল কী করে ।

ETV ভারত : মেয়েরা তো এখন নানান রকমের পোশাক পরে । অপারেশনের পর যখন নিজেকে আয়নায় দেখলেন তখন কী মনে হয়েছিল ?

রাখি : এই বিষয়ে আমি একবারও ভাবিনি । কারণ কিছু কিছু দাগ আছে যেগুলো খুব লাকি হয় । আমার জন্য এই দাগটা খুবই লাকি । এই দাগটাই আমায় মনে করিয়ে দেবে যে আমার জীবনে কিছু একটা হয়েছিল ।

ETV ভারত : আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী ?

রাখি : আপাতত আমি স্নাতকের পড়া শেষ করব । আমার সোশাল মিডিয়া মার্কেটিং নিয়ে মাস্টার্স করার ইচ্ছা আছে । এরকম ভাবেই আস্তে আস্তে এগিয়ে যাব ।

ETV ভারত : এইসবের জন্য তো কায়িক পরিশ্রমের প্রয়োজন । আপনার কী মনে হয় এই অপারেশন আপনার স্বপ্ন পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়াবে ?

রাখি : একেবারেই নয় । কারণ আমি অনেকটা সুস্থ হয়ে গেছি । আমি ঠিক হয়ে গেছি বলেই এখন এখানে বসে আছি । পরবর্তীকালেও কোনও সমস্যা হবে না । এই অপারেশনের পর ডাক্তাররা সেরকম কোনও ওষুধ দেয় না ।

ETV ভারত : অপারেশনের পর দূষণের থেকে কীভাবে রক্ষা করেন নিজেকে ?

রাখি : দূষণের জন্য ইনফেকশন হয়ে যেতে পারে । তাই ধুলো বালি এড়িয়ে চলাই ভালো । বাইরের খাওয়ার একেবারেই খাওয়া উচিত নয় । তেলও পরিমাণ মতোই খেতে হয় ।

ETV ভারত : এই বিষয়গুলি কতদিন পালন করতে হবে ?

রাখি : ৬ মাস । তারপরই আগের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারব ।

ETV ভারত : আপনার বাবা এখন কেমন আছেন ?

রাখি : বাবা এখন ভালো আছেন । আগে তিনি পরিবার ও ব্যবসা ছাড়া কিছুই বুঝতেন না । কিন্তু প্রায় ৬ মাস তিনি সব ভুলে গেছিলেন । এখন অনেকটাই সুস্থ হয়েছেন । আগের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেছেন ।

ETV ভারত : বাবাকে সুস্থ দেখে কেমন লেগেছে ?

রাখি : অপারেশনের পরদিনই বাবা চলাফেরা করছিলেন। সেইসময় খুবই ভালো লাগছিল । এখন তো আরও ভালো লাগছে ।

ETV ভারত : অপারেশনের পর আপনার বাবা যখন আপনাকে দেখেন তখন তাঁর কেমন লেগেছিল ?

রাখি : বাবা তো প্রথমে আমার লিভার নিতে রাজি হননি। বাবার বক্তব্য, আমার জন্যই তিনি এত তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়েছেন । বাবা আমাকে খুবই ভালোবাসেন ।

ETV ভারত : ফেব্রুয়ারি মাসে অপারেশন হওয়া সত্ত্বেও খুব সম্প্রতি বিষয়টি সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়েছে । হর্ষ গোয়েঙ্কার টুইটের পরেই কি সোশাল মিডিয়াতে ব্যাপারটা চাউর হয়েছিল ?

রাখি : আমি খুবই ইন্ট্রোভার্ট প্রকৃতির মেয়ে । আমি চাইনি যে বিষয়টি ভাইরাল হোক । কেউ জানুক বা না জানুক তাতে আমার কিছু যায় আসে না । আমার এক বন্ধু আমাদের একটা ছবি তোলে । কারণ অপারেশনের পর ডাক্তারদের একটি ছবি দিতে হয় । ওই বন্ধুটি সেই ছবি তুলে সোশাল মিডিয়াতে দেয় ।

ETV ভারত : পোস্টটি ভাইরাল হওয়ার পর সবার আশীর্বাদ, ভালোবাসা পেয়ে কেমন লাগছে ?

রাখি : আমি ভাবতে পারিনি পোস্টটি ভাইরাল হয়ে যাবে । হাজার হাজার মানুষের আশীর্বাদ পেয়েছি । আবার খারাপ কমেন্টও পেয়েছি । আমার খুব খারাপ লেগেছিল । এমনও একাধিক কমেন্ট পেয়েছি যেখানে আমার বাবাকে স্বার্থপর বলা হয়েছে । আমার বাবা কখনও মদ বা সিগারেট খান না । তাই কমেন্টগুলি আমার খুবই খারাপ লেগেছে । ১০ শতাংশ মানুষের প্রতিক্রিয়া এরকম ছিল । কিন্তু ৯০ শতাংশ মানুষ আমাকে আশীর্বাদ করেছেন । তাই আমি এসব কেয়ার করি না ।

ETV ভারত : যুব সম্প্রদায়ের কাছে আপনি অনুপ্রেরণা । যারা লিভার প্রতিস্থাপন সম্পর্কে কিছু জানে না বা এবিষয়ে অনেক কৌতুহল রয়েছে তাঁদের কী বার্তা দিতে চান ?

রাখি : লিভার প্রতিস্থাপন প্রয়োজন এরকম মানুষের কাছ এগিয়ে যাওয়া দরকার । তাঁদের পাশে দাঁড়ানো উচিত । নিজের বাবা-মার জন্য তো সবাই করবে । এমন অনেকে আছেন যাঁদের পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ নেউ । তাঁদের পাশে দাঁড়াতে হবে । সামান্য সাহায্য করতে পারলেও যথেষ্ট ।

কলকাতা, 24 এপ্রিল : কয়েকদিন আগেই সোশাল মিডিয়ায় একটি ছবি ভাইরাল হয়। ছবিতে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রয়েছেন বাবা আর মেয়ে। দু'জনের মুখেই হাসি। যদিও ছবিতে দেখা যায় দু'জনের পেটেই বড়সড় অস্ত্রোপচারের না মেলানো দাগ। ছবিটা আসলে ছিল এক গর্বিত বাবার গর্বিত মেয়ের ছবি। সত্যিই গর্বের। কারণ, তাঁরা দু'জনেই যা করেছেন অনেকেই তা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেন না। ১৯ বছরের রাখি দত্ত তাঁর লিভারের ৬৫ শতাংশ দান করেছেন বাবাকে। কারণ তাঁর বাবার লিভার নষ্ট হয়ে যায়। একমাত্র উপায় ছিল লিভার প্রতিস্থাপন। কিন্তু উপযুক্ত ডোনার পাওয়া যায়নি। হাল না ছেড়ে তাই বাবাকে নিজের লিভারের ৬৫ শতাংশ দান করেন রাখি দত্ত। আর রাখির এই কীর্তিকেই এখন কুর্নিশ জানাচ্ছে নেটিজেনরা। তবে সেসবে পাত্তা দিতে নারাজ রাখি। ETV ভারতকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তাই জানালেন, বাবার কাছে ১৯ বছর ধরে যা চেয়েছেন তাই পেয়েছেন। তাই এটুকু বাবার জন্য তিনি করতেই পারেন। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

আমাদের প্রতিনিধিকে রাখি বলেন, লিভার প্রতিস্থাপন হয়েছিল ২৭ ফেব্রুয়ারি। অপারেশনের ধকল তিনি কাটিয়ে উঠেছেন। কেমন আছেন জানতে চাইলে একমুখ হাসিতে বললেন, "ভীষণ ভালো আছি।" জানালেন, অপারেশনের ধকল কাটিয়ে তিনি শারীরিকভাবে এখন ঠিক আছেন।

ETV ভারত : কেমন আছেন এখন ?

রাখি : আমি এখন খুবই ভালো আছি ।

ETV ভারত : আপনার অপারেশন কবে হয়েছিল ?

রাখি : ২৭ ফেব্রুয়ারি ।

ETV ভারত : সোশাল মিডিয়ায় আমরা অনেক কিছুই দেখেছি । কিন্তু আসলে কী ঘটেছিল ?

রাখি : আমার বাবা স্বাভাবিকই ছিলেন । হঠাৎ তার জন্ডিস ধরা পড়ল । বাবার বিলিরুবিন ১ সপ্তাহের মধ্যে ১৮ থেকে বেড়ে ৪৭ হয়ে যায় । প্রথমে আমরা কলকাতার একটি হাসপাতালে বাবাকে ভরতি করি । ২০ দিন হাসপাতালে ভরতি ছিলেন । এরপর ডাক্তার আমাদের জানান, বাবার লিভার নষ্ট হয়ে গেছে । সিরোসিস অফ লিভার হয়েছিল । আর কিছু করা যাবে না । এরপর আমরা বাবাকে হায়দরাবাদে নিয়ে যাই । সেখানে এশিয়ান ইন্সটিটিউট অফ গ্যাস্ট্রোএন্ট্রোলজিতে তাঁকে ভরতি করা হয় । স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর ডাক্তার জানান, বাবার লিভারের ৯০ শতাংশ নষ্ট হয়ে গেছে । লিভার প্রতিস্থাপন ছাড়া কোনও উপায় নেই । আমরা তখনও লিভার প্রতিস্থাপন বিষয়ে কিছুই জানতাম না । ডাক্তার আমাদের জানান যে, পরিবারের কাউকে লিভার দিতে হবে। প্রথমে ঠিক ছিল আমার মা লিভার দেবেন । কিন্তু মায়ের অতিরিক্ত ওজন এবং নার্ভের সমস্যার জন্য তা সম্ভব নয় । আমরা দুই বোন । দিদির লিভারের কাঠামো অন্য রকম তাই তাঁর থেকেও লিভার নেওয়া যায়নি । তারপরে সিন্ধান্ত নেওয়া হয় যে আমি বাবাকে লিভার দেব । প্রথমে বাবা রাজি হয়নি । কারণ আমি বয়সে ছোট । ডাক্তাররাও প্রথমে আমার বয়সের জন্য রাজি হচ্ছিলেন না । এরপর আমার ১০৯ রকম মেডিকেল টেস্ট হয় । রিপোর্টে আমার লিভারে একটি সমস্যা ধরা পড়ে । ডাক্তাররা জানান, আমার ক্ষেত্রে বিষয়টি ঝুঁকির হবে । কিন্তু যেহেতু দিদি বা মা কেউই এই অপারেশনের জন্য তৈরি ছিল না তাই সিদ্ধান্ত হল যে আমি বাবাকে লিভার দেব । বলা হল আমার ৬৫ শতাংশ লিভার নেওয়া হবে । এরপর আমাদের অপারেশন হল ।

এরই মধ্যে বাবার অনেকরকম সমস্য দেখা দিচ্ছিল । মানসিক সমস্যাও দেখা দিয়েছিল । অপারেশনের ১ সপ্তাহের মধ্যে বাবার স্বাস্থ্যের উন্নতি হতে শুরু করে । এখন অনেক ভালো আছেন ।

ETV ভারত : যে মেয়েটি ইনজেকশনকেও ভয় পায় সে এত বড় একটা কাজ করল। কী বলবেন ?

রাখি : আমি এর আগে আমার রক্তের গ্রুপ জানতাম না । কোনওদিন আমি রক্ত দিইনি । সাধারণ জ্বর ছাড়া কখনও ডাক্তার দেখাতে হয়নি । এই প্রথম আমি ১০৯ টি টেস্ট করাই । প্রথমে আমার ১৬ বার রক্তের নমুনা নেওয়া হয়েছিল । ৩ দিনের মধ্যেই এই পরীক্ষাগুলো হয়েছিল ।

ETV ভারত : এখনও কি ইনজেকশনে ভয় পান ?

রাখি : তখন রক্ত নেওয়ার সময় ভয় পাইনি । কারণ বাবাকে সুস্থ করতে বদ্ধপরিকর ছিলাম । স্ক্যান, MRI ইত্যাদি অনেক পরীক্ষাই হয়েছে । ভয় পাইনি । তবে এখন রক্ত নিতে এলে দেব না ।

ETV ভারত : অপারেশনটা কত ঘণ্টার ছিল ?

রাখি : ১৫ ঘণ্টা ।

ETV ভারত : অপারেশনের আগে আপনার মাথায় কী চলছিল ?

রাখি : অপারেশনের আগের দিন একটা বোর্ড মিটিং হয়েছিল । এই মিটিংয়ে ১৬ জন ডাক্তার ছিলেন । তাঁরা জানান, স্বাস্থ্য পরীক্ষার রিপোর্ট যে সবসময় ঠিক হবে এমন কোনও মানে নেই । অপারেশন টেবিলে আমার মৃত্যুও হতে পারে । এই অপারেশনটা ৯৫ শতাংশ সুরক্ষিত । কিন্তু ৫ শতাংশ ঝুঁকি থেকেই যায় । যেমন অনেকের হৃদস্পন্দন ধীরে চলতে থাকে । এই বিষয়গুলো আমাকে বলা হয়েছিল । কিন্তু আমি বাবার জন্য ৫ শতাংশ ঝুঁকি নিতেই পারি । আমি যদি আমার বাবার জন্য না করি তাহলে একটা বাইরের লোক নিজের লিভার কেন দেবে ? ১৮ বছর ধরে বাবার কাছে যা চেয়েছি সব দিয়েছেন । একদিনও না বলেননি । আমি তাঁর জন্য ৫ শতাংশ ঝুঁকি নিতে পারব না ? ওই দিনই আমি বন্ডেও সই করি ।

ETV ভারত : অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়ার সময় আপনার পাশে কে কে ছিলেন ?

রাখি : আমার মা, দিদি, বন্ধুরা এবং মামা ।

ETV ভারত : আপনার অপারেশন নিয়ে তাঁদের প্রতিক্রিয়া কী ছিল ?

রাখি : তাঁরা যে চিন্তায় আছেন সেটা আমাকে বুঝতে দেননি । সকাল ৬ টায় আমাকে OT-তে ঢোকানো হয়েছিল । সেইসময় আমারও অল্প চিন্তা হচ্ছিল যে কী হবে । রাত ১১ টায় আমার জ্ঞান এসেছিল । তখন বুঝতেই পারছিলাম না আমার অপারেশন হয়ে গেছে । অপারেশনের পরের দিন আমার বাবা মোটামুটি সুস্থ হয়ে গেছিলেন । পরের দিনই ICU-র বিছানা ছেড়ে উঠে হেঁটেছিলেন। অপারেশনের পর তিন দিন পর্যন্ত আমি ভাবছিলাম এত তাড়াতাড়ি সব ঠিক হয়ে গেল কী করে ।

ETV ভারত : মেয়েরা তো এখন নানান রকমের পোশাক পরে । অপারেশনের পর যখন নিজেকে আয়নায় দেখলেন তখন কী মনে হয়েছিল ?

রাখি : এই বিষয়ে আমি একবারও ভাবিনি । কারণ কিছু কিছু দাগ আছে যেগুলো খুব লাকি হয় । আমার জন্য এই দাগটা খুবই লাকি । এই দাগটাই আমায় মনে করিয়ে দেবে যে আমার জীবনে কিছু একটা হয়েছিল ।

ETV ভারত : আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী ?

রাখি : আপাতত আমি স্নাতকের পড়া শেষ করব । আমার সোশাল মিডিয়া মার্কেটিং নিয়ে মাস্টার্স করার ইচ্ছা আছে । এরকম ভাবেই আস্তে আস্তে এগিয়ে যাব ।

ETV ভারত : এইসবের জন্য তো কায়িক পরিশ্রমের প্রয়োজন । আপনার কী মনে হয় এই অপারেশন আপনার স্বপ্ন পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়াবে ?

রাখি : একেবারেই নয় । কারণ আমি অনেকটা সুস্থ হয়ে গেছি । আমি ঠিক হয়ে গেছি বলেই এখন এখানে বসে আছি । পরবর্তীকালেও কোনও সমস্যা হবে না । এই অপারেশনের পর ডাক্তাররা সেরকম কোনও ওষুধ দেয় না ।

ETV ভারত : অপারেশনের পর দূষণের থেকে কীভাবে রক্ষা করেন নিজেকে ?

রাখি : দূষণের জন্য ইনফেকশন হয়ে যেতে পারে । তাই ধুলো বালি এড়িয়ে চলাই ভালো । বাইরের খাওয়ার একেবারেই খাওয়া উচিত নয় । তেলও পরিমাণ মতোই খেতে হয় ।

ETV ভারত : এই বিষয়গুলি কতদিন পালন করতে হবে ?

রাখি : ৬ মাস । তারপরই আগের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারব ।

ETV ভারত : আপনার বাবা এখন কেমন আছেন ?

রাখি : বাবা এখন ভালো আছেন । আগে তিনি পরিবার ও ব্যবসা ছাড়া কিছুই বুঝতেন না । কিন্তু প্রায় ৬ মাস তিনি সব ভুলে গেছিলেন । এখন অনেকটাই সুস্থ হয়েছেন । আগের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেছেন ।

ETV ভারত : বাবাকে সুস্থ দেখে কেমন লেগেছে ?

রাখি : অপারেশনের পরদিনই বাবা চলাফেরা করছিলেন। সেইসময় খুবই ভালো লাগছিল । এখন তো আরও ভালো লাগছে ।

ETV ভারত : অপারেশনের পর আপনার বাবা যখন আপনাকে দেখেন তখন তাঁর কেমন লেগেছিল ?

রাখি : বাবা তো প্রথমে আমার লিভার নিতে রাজি হননি। বাবার বক্তব্য, আমার জন্যই তিনি এত তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়েছেন । বাবা আমাকে খুবই ভালোবাসেন ।

ETV ভারত : ফেব্রুয়ারি মাসে অপারেশন হওয়া সত্ত্বেও খুব সম্প্রতি বিষয়টি সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়েছে । হর্ষ গোয়েঙ্কার টুইটের পরেই কি সোশাল মিডিয়াতে ব্যাপারটা চাউর হয়েছিল ?

রাখি : আমি খুবই ইন্ট্রোভার্ট প্রকৃতির মেয়ে । আমি চাইনি যে বিষয়টি ভাইরাল হোক । কেউ জানুক বা না জানুক তাতে আমার কিছু যায় আসে না । আমার এক বন্ধু আমাদের একটা ছবি তোলে । কারণ অপারেশনের পর ডাক্তারদের একটি ছবি দিতে হয় । ওই বন্ধুটি সেই ছবি তুলে সোশাল মিডিয়াতে দেয় ।

ETV ভারত : পোস্টটি ভাইরাল হওয়ার পর সবার আশীর্বাদ, ভালোবাসা পেয়ে কেমন লাগছে ?

রাখি : আমি ভাবতে পারিনি পোস্টটি ভাইরাল হয়ে যাবে । হাজার হাজার মানুষের আশীর্বাদ পেয়েছি । আবার খারাপ কমেন্টও পেয়েছি । আমার খুব খারাপ লেগেছিল । এমনও একাধিক কমেন্ট পেয়েছি যেখানে আমার বাবাকে স্বার্থপর বলা হয়েছে । আমার বাবা কখনও মদ বা সিগারেট খান না । তাই কমেন্টগুলি আমার খুবই খারাপ লেগেছে । ১০ শতাংশ মানুষের প্রতিক্রিয়া এরকম ছিল । কিন্তু ৯০ শতাংশ মানুষ আমাকে আশীর্বাদ করেছেন । তাই আমি এসব কেয়ার করি না ।

ETV ভারত : যুব সম্প্রদায়ের কাছে আপনি অনুপ্রেরণা । যারা লিভার প্রতিস্থাপন সম্পর্কে কিছু জানে না বা এবিষয়ে অনেক কৌতুহল রয়েছে তাঁদের কী বার্তা দিতে চান ?

রাখি : লিভার প্রতিস্থাপন প্রয়োজন এরকম মানুষের কাছ এগিয়ে যাওয়া দরকার । তাঁদের পাশে দাঁড়ানো উচিত । নিজের বাবা-মার জন্য তো সবাই করবে । এমন অনেকে আছেন যাঁদের পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ নেউ । তাঁদের পাশে দাঁড়াতে হবে । সামান্য সাহায্য করতে পারলেও যথেষ্ট ।

Intro:wb_kol_24april_8001_livertransplant_still_papri


Body:wb_kol_24april_8001_livertransplant_still_papri


Conclusion:wb_kol_24april_8001_livertransplant_still_papri
Last Updated : Apr 28, 2019, 11:02 PM IST
ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.