লখনউ, 21 অগস্ট : একটা সময় ছিল যখন উত্তরপ্রদেশে ভারতীয় জনতা পার্টিকে লোকে চিনত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিংয়ের জন্য ৷ কিন্তু 1999-এ কয়েকটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে দু'পক্ষ একে অপরের প্রধান শত্রু হয়ে উঠেছিল ৷ যার জন্য কল্যাণ গেরুয়া দলের সঙ্গ ছেড়েছিলেন ৷ এটা অবশ্যম্ভাবী ছিল, কারণ 2012-তে উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচনের লড়াইয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল কল্যাণ সিংয়ের জনক্রান্তি পার্টি (Jan Kranti Party) ৷ আর এই যুদ্ধে জনক্রান্তি পার্টি বিজেপির বিপরীতে শক্তিশালী দল হয়ে উঠেছিল, তার পরিষ্কার ইঙ্গিত দিয়েছিল জনক্রান্তি পার্টি ৷
1991-এর পর 2012-র নির্বাচনে বিজেপি মাত্র 47টি আসন জিতেছিল ৷ এতে কল্যাণ সিংয়ের দল সত্যিকারের ভোট কেটে নেওয়ার দল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল (vote-cut party) ৷ ভয়ঙ্কর পতনের পর বিজেপি আর কল্যাণ দু'পক্ষই একে অপরের শক্তি বুঝতে পেরেছিল ৷ 2013 সালে কল্যাণ সিং আরেকবার নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে থাকা বিজেপিতে ফেরার কথা ঘোষণা করেন ৷ তবে এ বিষয়ে তৎকালীন বিজেপির দায়িত্বে থাকা অমিত শাহ মধ্যস্থতা করেছিলেন ৷ 2014 সালের নির্বাচনে এই দুই দল একটা সন্তুষ্টির জায়গায় পৌঁছেছিল ৷ উত্তরপ্রদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিজেপি তার ক্যারিশমা দেখিয়ে দিয়েছিল ৷ 2014 সালের নির্বাচনে বিজেপি আর তাঁর মিত্র আপনা দল (Apna Dal) লোকসভার 80টি আসনের মধ্যে 73টি আসন পেয়েছিল ৷ এর মধ্যে বিজেপি একা 71টি আসনে জয়ী হয়েছিল ৷ ফলস্বরূপ 2014 সালে কেন্দ্রে সরকার গড়েছিল বিজেপি ৷ 2017 সালের নির্বাচনেও বিজেপি ফের ক্ষমতায় ফেরার সৌভাগ্য অর্জন করেছিল ৷ ইতিমধ্যে, রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ বিজয় শঙ্কর পঙ্কজের মতে, রামমন্দির আন্দোলন কল্যাণ সিংকে শক্তিশালী করে তুলেছিল ৷ যার জন্য তিনি তাঁর সামনে অন্য সব নেতাদের অযোগ্য মনে করতেন ৷
বিজয় শঙ্কর পঙ্কজ বলেন, "কল্যাণ সিংয়ের সঙ্গে তাঁর নিজের দলের বহু নেতার ভুল বোঝাবুঝির ফলে এই দূরত্ব বাড়তে থাকে ৷ যখন মায়াবতী ইউপি-র সিংহাসন বিজেপির কাছে হস্তান্তরিত করতে রাজি ছিলেন না ৷ আর বিজেপি এই কৌশলে সরকার গড়েছিল ৷"
পঙ্কজ জানান যে কল্যাণের একটা ভুল ধারণা ছিল যে বিজেপি তাঁর ৷ কেন্দ্রের নেতা আর কল্যাণ সিংয়ের মধ্যে তৈরি হওয়া ঝামেলার ফলে কল্যাণ সিং বিজেপি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন ৷ এর ফলে, বিজেপি আর কল্যাণ দু'পক্ষকেই ভুগতে হয়েছিল ৷ পঙ্কজের দাবি, বাড়তে থাকা বিতর্কের জেরে কল্যাণ সিং আরও বেশি মত প্রকাশ করতে শুরু করেন ৷ এমনকি তিনি বিজেপির সমস্ত দোষ ঢাকার একমাত্র মুখোশ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ি বলে উল্লেখ করেন ৷ বিজেপির থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরে কল্যাণ সিং জনক্রান্তি পার্টি গঠন করেন ৷ 2002 সালে উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে লড়েছিল এই দল ৷ বিজেপি মাত্র 88টি আসন পেয়ে ভয়ঙ্কর ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল ৷ সেই সময় এসপি 143টি আসন, বিএসপি 98টি আসন, কংগ্রেস 25টি, আরএলডি 14টি আসন আর কল্যাণের দল মাত্র 4টি আসন পেয়েছিল বিধানসভা নির্বাচনে ৷
কল্যাণ সিং আবার বিজেপিতে যোগ দেন ৷ কিন্তু তাঁর এই ফেরা নিয়ে দলের অভ্যন্তরে মতবিরোধ তৈরি হয় ৷ কল্যাণ সিং নিজেকে দলের সবচেয়ে বয়স্ক আর প্রবীণ সদস্য হিসেবে বিবেচনা করতেন ৷ তাঁর মতো করে বিজেপিকে পরিচালনা করার চেষ্টা করতেন কিন্তু বহু শক্তিশালী নেতা তাঁকে "বহিরাগত" হিসেবে চিহ্নিত করেন ৷ 2007-এ বিজেপি বিধানসভা নির্বাচনে খুব ভাল কিছু ফল করতে পারেনি ৷ মাত্র 51টি আসন পেয়েছিল ৷ যাইহোক, বিএসপি সামাজিক কৌশলের সূত্র মেনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় আর মায়াবতী সেবার ইউপি-র মুখ্যমন্ত্রী হন ৷ এতে বিজেপি আর কল্যাণ সিং ফের আলাদা আলাদা পথ বেছে নেয় ৷ 2009-এ লোকসভা নির্বাচনের সময় কল্যাণ সিং মুলায়ম সিং যাদবের সঙ্গে জোট বাঁধেন ৷ এই নির্বাচনে এটাহ থেকে একজন নির্দল প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ান কল্যাণ সিং ৷ কিন্তু তাঁকে মুলায়ম সিংয়ের সঙ্গে এসপি-র হয়ে প্রচার করতে দেখা গিয়েছিল ৷ কল্যাণ সিংয়ের সঙ্গে এই বন্ধুত্বের তলায় চাপা পড়ে গিয়েছিল এসপি ৷ সেবার মোটে 24টি আসন পাওয়ার ফলে মুলায়ম সিংয়ের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ে কল্যাণ সিংয়ের ৷ অন্য দিকে, 2009-এ বিপুল ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছিল ৷
আরও পড়ুন: Kalyan Singh: প্রয়াত কল্যাণ সিং
2012-এর বিধানসভা নির্বাচনে, কল্যাণ সিং তাঁর জনক্রান্তি পার্টির 200 জন প্রার্থীকে দাঁড় করিয়েছিলেন ৷ এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছিল বিজেপির ৷ যদিও, তাঁর দল সাফল্য পায়নি ৷ কিন্তু তাঁর দল 50টি আসন পেয়ে বিজেপিকে পিছনে ফেলে দিয়েছিল ৷ বিজেপি পেয়েছিল 47টি আসন ৷ 1991-এর পর সবচেয়ে কম ৷ এই সময়, জনসাধারণ সমাজবাদী পার্টিকে ক্ষমতায় আসার একটা সুযোগ দিয়েছিল আর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ৷ অখিলেশ যাদব উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন ৷ কল্যাণ সিংয়ের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর এটা বিজেপি-র জন্য একটা বিরাট ধাক্কা ছিল ৷
প্রবীণ সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ পিএন দ্বিবেদি বিশ্বাস করেন যে, 2012 বিধানসভা নির্বাচনে, কল্যাণ সিং আর ভারতীয় জনতা পার্টি দু'পক্ষেরই ভুল ভেঙেছিল ৷ "2014-র লোকসভা নির্বাচনের আগে কল্যাণ সিং বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন ৷ এটা একটা সমাপতন মাত্র ৷ বিজেপি কিন্তু তখন থেকেই সমানে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে ৷ রাজনীতির দুনিয়ায় কল্যাণকে জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠতে দেখা গিয়েছিল ৷ কিন্তু, এটাও একটা বিষয় যে কল্যাণ সিং লোধা সম্প্রদায়ের ৷ আর ইউপি-তে বিশাল সংখ্যায় রয়েছেন তাঁরা ৷ লোধা সম্প্রদায়ের মানুষ তাঁকে নেতা হিসেবেই বিবেচনা করেন ৷"