পরপর সাতবার গুজরাতে বিধানসভা নির্বাচন (Gujarat Assembly Elections 2022) জিততে মরিয়া বিজেপি (BJP) ৷ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির (PM Narendra Modi) নেতৃত্বে বিজেপি-র আক্রমণাত্মক প্রচার দেখেই তা স্পষ্ট হচ্ছে ৷ বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ও বিধায়কের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা ফ্যাক্টর কাজ করছে ৷ এছাড়া দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধদের স্বর ক্রমশ বাড়ছে ৷ সেক্ষেত্রে বাড়ছে গোঁজ প্রার্থীর সম্ভাবনাও ৷ যা ভয় ধরাচ্ছে গেরুয়া শিবিরে ৷
কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি বলছে যে ক্ষমতায় ফেরা নিয়ে নিশ্চিন্ত মোদি ৷ বিজেপির বিরোধীরাও তাই মনে করছে ৷ মোদি বরং আসন সংখ্যার নিরিখে তৈরি করতে চাইছেন নতুন রেকর্ড ৷ 1985 সালে মাধবসিং সোলাঙ্কির নেতৃত্বে কংগ্রেস (Congress) গুজরাত বিধানসভার নির্বাচনে 182টি আসনের মধ্যে 149টি আসনে জিতেছিল ৷ মোদি সেই রেকর্ড ভাঙতে চাইছেন ৷
বিজেপিতে মোদির সেকেন্ড-ইন-কমান্ড অমিত শাহর (Amit Shah) হিসেব অনুযায়ী, বিজেপি এবার গুজরাতে 130টি আসন জিততে পারে ৷ তার পরও মোদি দেড়শো আসন জেতার লক্ষ্যমাত্রা দলের জন্য বেঁধে দিয়েছেন বলে খবর ৷ কিন্তু কেন তিনি এই টার্গেট গুজরাতে বিজেপির নেতাদের দিলেন, এই প্রশ্ন যে কেউ করতে পারেন ৷ এর কারণ হল, অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নেতৃত্বে আম আদমি পার্টি বা আপ (AAP) নানা সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গুজরাতের নির্বাচনী সাফল্যের পথ বদলাতে চাইছে ৷ তার পরও যে গুজরাতে বিজেপির আধিপত্য় খর্ব হওয়ার কোনও ভয় নেই, সেটা বিরোধীদের দেখিয়ে দিতেই এই লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছেন মোদি ৷
আরও পড়ুন: বরাবর এই আসনের প্রার্থীরা বড় পদ পেয়েছেন সরকারে, হয়েছেন প্রধানমন্ত্রীও
বিজেপির ভোট ম্যানেজাররা মনে করছেন যে দু’টো ফ্যাক্টর থেকে বিজেপি সুবিধা নিক বলে চাইছেন মোদি ৷ সেই ফ্যাক্টরগুলির মধ্যে একটি হল - দু’মাস আগে আপের সম্পর্কে যে আগ্রহ গুজরাতের মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছিল, তা প্রার্থী ঘোষণার পর থেকেই কমতে শুরু করেছে ৷ তার কারণ, অধিকাংশই অপরিচিত ৷ বিশেষ করে সৌরাষ্ট্র ও দক্ষিণ গুজরাতে ৷
আর দ্বিতীয়ত, আপ যতটুকু সাফল্য পাবে, তার জেরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে কংগ্রেসের ৷ 2017 সালে তারা যে সাফল্য পেয়েছিল, তা পাবে না ৷ উল্লেখ্য, কংগ্রেস গত বিধানসভা ভোটে গুজরাতে বিজেপিকে 99 আসনে নামিয়ে দিয়েছিল ৷ 27 বছর আগে এই রাজ্যে যখন বিজেপি ক্ষমতায় আসে, তার পর থেকে এটাই ছিল কোনও বিধানসভা ভোটে বিজেপির সবচেয়ে কম আসন জয় ৷
বিরোধীদের পর্যবেক্ষণ হল, গুজরাতের ভোটের লড়াইয়ে একদিকে রয়েছে মোদির পক্ষে জনপ্রিয়তা ৷ অন্যদিকে বিজেপির একাধিক মন্ত্রী, প্রাক্তন মন্ত্রী ও বিধায়কদের বিরুদ্ধে ক্ষোভের চোরাস্রোত রয়েছে ৷ 2001 থেকে 2014 সাল পর্যন্ত গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নরেন্দ্র মোদি ৷ সেই কারণে এখনও তিনি গুজরাতের মানুষের কাছে খুবই জনপ্রিয় ৷ কিন্তু তার পর মোদির দুই উত্তরসূরী আনন্দীবেন প্যাটেল (উত্তরপ্রদেশের রাজ্যপাল) ও বিজয় রূপানীর প্রশাসিক দক্ষতার অভাবের জেরে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল ৷ যদিও প্যাটেল সম্প্রদায়ের বিক্ষোভের জেরে 2017 সালের ভোটে ধাক্কা খেতে হয়েছিল বিজেপিকে ৷
যদিও মোদির আবেদন বিজেপিকে তাদের সব খামতি পূরণ করতে সাহায্য করবে ৷ সেই কারণেই গত 6 নভেম্বর ভোটমুখী গুজরাতে প্রথম সভা থেকেই নতুন স্লোগান দেন মোদি ৷ বলেন, ‘‘আ গুজরাত, ম্যায় বানায়ু ছে (এই গুজরাত আমি তৈরি করেছি) ৷’’ সেদিনই তিনি বিরোধীদের বিরুদ্ধে অল আউট আক্রমণ করেছিলেন ৷ দাবি করেছিলেন, যারা ঘৃণা ছড়াচ্ছে এবং গুজরাতের বদনাম করছে, তারা ভোটে খড়কুটোর মতো উড়ে যাবে ৷ আর বিজেপির বিশাল জয় হবে ৷
হিমাচল প্রদেশের মতো গুজরাতেও প্রচারে মোদি বারবার বলছেন, ‘‘মনে রাখবেন কে বিজেপি প্রার্থী ? মনে রাখার দরকার নেই ৷ শুধু পদ্ম প্রতীককে মনে রাখুন ৷ আপনি যদি ‘কমল কা ফুল (পদ্ম ফুল)’-এ ভোট দেন, তাহলে বুঝবেন আপনি বিজেপিকে ভোট দিচ্ছেন, মোদিকে ভোট দিচ্ছেন, যিনি আপনাদের কাছে এসেছেন ৷ পদ্ম ফুলে আপনাদের প্রতিটা ভোট সরাসরি মোদির কাছে আশীর্বাদ হিসেবে আসবে ৷’’
শুধু তাই নয়, মোদি প্রতিটা নির্বাচনী সভায় গিয়ে জোর দিয়ে বারবার বলছেন যে ভোটের দিন যাতে ভোটাররা বিশাল সংখ্যায় হাজির হন বুথে এবং অন্যান্যবারের ভোটদানের সব রেকর্ড যেন ভেঙে যায় ৷ মোদি তাঁর ভাষণে বলেছেন, ‘‘এই নির্বাচনে আমি চাই মানুষ তাঁদের বুথে বিশাল সংখ্যায় হাজির হোন এবং ভোটদানের হারের আগের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দিন ৷ আমি বলছি না যে আপনি শুধু বিজেপিকেই ভোট দিন ৷ শুধু এটা নিশ্চিত করুন যে গণতন্ত্রের এই উৎসবে যেন প্রত্যেকে অংশগ্রহণ করেন ৷ এটাই আমার সকলের কাছে আবেদন ৷’’
অন্যদিকে আরও একটা জিনিস মোদি ভোটারদের বলছেন, ‘‘বিজেপি যেন প্রতিটি বুথে জেতে, সেটা নিশ্চিত করুন৷ আপনারা কি তা আমার জন্য করবেন ৷ এবার আমার লক্ষ্য এখানে প্রতিটি বুথ থেকে ভোটে জেতা ৷ এই লক্ষ্যপূরণে আপনি যদি আমাকে সাহায্য করেন, তাহলে গান্ধিনগরের বিজেপি প্রার্থী বিধানসভায় পৌঁছে যাবেন ৷’’
আরও পড়ুন: 'আমি এই গুজরাত তৈরি করেছি' ! ভোটের আগে নতুন স্লোগান মোদির
জয়ের কর্তৃত্ব গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ভূপেন্দ্র প্যাটেল পেলে, তাতে কিছু মনে করবেন না মোদি ৷ তিনি বলেছেন, আমি চাই এটা নিশ্চিত করতে যাতে ভূপেন্দ্র (প্যাটেল) নরেন্দ্রর রেকর্ড ভাঙতে পারে ৷ এর মানে হল আমি দিল্লিতে গিয়ে যেন কাজ করতে পারি ৷ আমাদের গুজরাত ও দেশকে উন্নয়নের রাস্তায় নিয়ে যেতে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে ৷’’
অনেক ভোটার হয়তো বিজেপির বিকল্প খুঁজবেন ৷ কিন্তু বিরোধীরা তাঁদের জন্য আশার আলো দেখাতে পারছে না ৷ কেজরিওয়াল এখনও পরীক্ষিত রাজনৈতিক বিকল্প নন ৷ আর কংগ্রেস আহমেদের প্যাটেলের মতো কুশলী রাজনৈতিকের অভাব অনুভব করছে ৷
2021 সালের সেপ্টেম্বরে নরেন্দ্র মোদি গুজরাতে একটি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ভুল শুধরে নিয়েছিলেন ৷ আর সেটা হল অমিত শাহের নিয়োগ করা জনপ্রিয়তা না থাকা বিজয় রূপানীকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ৷ বদলে আনা হয় ভূপেন্দ্র প্যাটেলকে ৷ রূপানীর সঙ্গে মন্ত্রিসভার কিছু পুরনো মুখকে সরিয়ে দেওয়া হয় ৷ তাঁদের এবারের ভোটে প্রার্থীও করা হয়নি ৷ 2017 সালে প্যাটেল সম্প্রদায়ের ভোট সেভাবে পায়নি বিজেপি ৷ সেই ভোট ফিরে পেতেই ভূপেন্দ্রকে মুখ্যমন্ত্রী করা হয় ৷
এবারের ভোটে বিজেপি আত্মবিশ্বাসী যে প্যাটেল ও পতিদার ভোটব্যাংক আবার আগের মতোই বিজেপির পাশেই থাকবে ৷ একসময় সংরক্ষণ নিয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে আন্দোলন করা হার্দিক প্যাটেল কংগ্রেস ঘুরে এখন মোদির দলেই চলে এসেছেন ৷
প্যাটেল সম্প্রদায়ের পাশাপাশি আদিবাসী এলাকাতেও দলের নেতাদের কঠোর পরিশ্রমের নির্দেশ দিয়েছেন মোদি ৷ সেখান থেকে যতটা বেশি আসন জেতার বার্তা দিয়েছেন তিনি ৷ যাতে সৌরাষ্ট্র ও দক্ষিণ গুজরাতে যদি কিছু আসন হারাতে হয়, সেই ক্ষতি এখান থেকে পূরণ করা যায় ৷
মোদি আত্মবিশ্বাসী যে গুজরাতের মানুষ তাঁকে হতাশ করবেন না ৷ তাই প্রতিটি সভাতেই মোদি সেই তালিকা তুলে ধরছেন, যা তিনি গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তৈরি করেছিলেন ৷ সেই তালিকায় নর্মদা বাঁধ তৈরির কাজ শেষ করে রাজ্যের খরা প্রবণ অঞ্চলের জল বিষয়টি থেকে একাধিক সেক্টরে নতুন প্রকল্প তৈরির বিষয়গুলি থাকছে ৷
যদি বিজেপি আবার জেতে, তাহলে তারা ইতিহাস তৈরি করবে ৷ 1995, 1998, 2002, 2007, 2012, ও 2017 - তারা ছ’টা বিধানসভা নির্বাচন পরপর জিতেছে ৷ এর মধ্যে সেরা পারফরম্যান্স ছিল 2002 সালে ৷ সেবার মোদির নেতৃত্বে 182টি আসনের মধ্যে 127টি আসনে জিতেছে ৷ 2017 সালে বিজেপি জিতেছিল 99টি আসনে ৷ আর কংগ্রেস 77টি আসনে জিতেছিল ৷
অন্যদিকে 2022 সালে কংগ্রেসের সংগঠনের শোচনীয় অবস্থা তাদের সমর্থকদের হতাশ করেছে ৷ রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘‘কংগ্রেসের প্রতি মানুষের সমর্থন অনেক আছে ৷ কিন্তু কংগ্রেস নেতারা সেই আশা পূরণ করতে কোনও চেষ্টাই করছে না ৷’’
আরও পড়ুন: আমার কোনও 'অওকাত'ই নেই ! কংগ্রেসকে কড়া জবাব মোদির