দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের সার্বভৌমত্বের দাবিতে লড়াই চালিয়েছেন বোরো এলাকার বাসিন্দারা । অসমের ব্রক্ষ্মপুত্র নদের উত্তর তীর কার্যত যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয় ১৫ লাখ বোরোবাসীর । বোরোল্যান্ড ইশুতে বছরের পর বছর ধরে যে রক্তক্ষয়ী লড়াই চলেছে তাতে প্রাণ হারিয়েছেন বহু মানুষ । দিনকয়েক আগে সেই আন্দোলনে ইতি টানতে স্বাক্ষরিত হয় এক চুক্তি । ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট অফ বোরোল্যান্ডের (NDFB) সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে কেন্দ্রীয় ও অসম সরকার । NDFB-র পাশাপাশি অল বোরো স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (ABSU) ও ইউনাইটেড বোরো পিপলস অর্গানাইজেশনও তাতে শামিল হয় । দিল্লিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর উপস্থিতিতে স্বাক্ষর হয় এই চুক্তি । পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, "অসমের আঞ্চলিক সংহতি নিশ্চিত করা হল ।"
বোরোল্যান্ড টেরিটোরিয়াল এরিয়া ডিস্ট্রিক্টস (BTAD)-র নতুন নামকরণ হবে বোরোল্যান্ড টেরিটোরিয়াল কাউন্সিল(BTC)। আদমসুমারি আনুযায়ী BTAD সংলগ্ন এলাকায় ৩ হাজার গ্রামের অন্তর্ভুক্তির জন্য একটি কমিশন নিয়োগ করা হবে । ওই এলাকায় জাতীয় ক্রীড়া বিশ্ববিদ্যালয়, রেল কোচ ফ্যাক্টরি, মেডিকেল কলেজ ও ক্যানসার হাসপাতাল স্থাপন করা হবে । NDFB-র সঙ্গে কেন্দ্রীয় ও অসম সরকার যে শান্তি চুক্তি করেছে তার অন্যতম দাবি- বিজ্ঞপ্তি জারি করে বোরো ভাষাকে অসমের অফিশিয়াল ভাষার স্বীকৃতি প্রদান । এদিকে অসমের অন্য জেলা এবং BTAD-কে নিয়ে ইউনিয়ন টেরিটোরিয়াল কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাবে রাজ্যে বন্ধের ডাক দেয় বিভিন্ন সংগঠন। বিশেষ রাজ্যের দাবিতে অনড় ABSU। এই পরিস্থিতিতে শান্তি চুক্তি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন পর্যবেক্ষকরা।
CAA বিরোধী আন্দোলনে যখন গোটা উত্তর-পূর্ব ভারত জ্বলছে, সেই সময় এই চুক্তি অসমে কিছুটা হলেও অক্সিজেন জোগাচ্ছে BJP-কে । গত ২৭ বছরে বোরোল্যান্ড ইশুতে ৩ বার ত্রিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষতির হয়েছে। এতেই সংশ্লিষ্ট এলাকার ভৌগলিক জটিলতার বিষয়টি বোঝা যায়। পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠনের দাবিদাওয়া কী তীব্র- তাও। ১৯৮১ সালে বোরো নিরাপত্তাবাহিনী গঠন করে রঞ্জন দায়মারি। অন্যদিকে আদিবাসীদের জন্য বিশেষ রাজ্যের দাবি তোলে ABSU। এর জেরে অস্থিরতা তৈরি হয় অসমে । আদিবাসীদের জন্য সাংবিধানিক সুরক্ষা এবং বোরো এলাকার উন্নয়নের দাবিতে শুরু হয়েছিল বোরো আন্দোলন। কিন্তু, অহমিয়া ভাষাকে রাজ্যের অফিশিয়াল ভাষার স্বীকৃতি প্রদানের পর বোরো আন্দোলন বিচ্ছিন্নতা আন্দোলনের রূপ নেয়। বোরোল্যান্ড স্বশাসিত পর্ষদ সৃষ্টির সম্মতিক্রমে ১৯৯৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ত্রিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু, কিছুদিনের মধ্যেই সেই চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসে NDFB। ৪ জেলা নিয়ে BTC গঠনের লক্ষ্যে ২০০৩ সালে দ্বিতীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় । ফের একবার সরে আসে NDFB। এবং হিংসার রাস্তা গ্রহণ করে । যদিও সাম্প্রতিক চুক্তি আশা জোগাচ্ছে। অতীতের পুনরাবৃত্তির আশঙ্কাও আছে।
ব্রিটিশ শাসিত ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের মধ্যে ছিল অসম, নাগাল্যান্ড, মেঘালয় এবং মিজোরাম । ১৯৫৬ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ছিল মণিপুর ও ত্রিপুরা । উন্নয়নের জন্য উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিকে সরকারিভাবে উত্তর-পূর্ব পর্ষদের অধীনে রাখা হয়েছে। 238 প্রাচীন জনজাতি গোষ্ঠীর আঁতুড়ঘর হওয়ায়, এই এলাকা প্রায়শই আক্রমণ এবং সাংস্কৃতিক দমন-পীড়নে জর্জরিত থাকে। দেশের অন্য প্রান্তের থেকে উন্নয়নের নিরিখে পিছিয়ে থাকাও এইসব এলাকার সামাজিক-রাজনৈতিক লড়াইয়ের অন্যতম কারণ। যদিও অসমে শান্তি ফিরে আসবে বলে আশাবাদী কেন্দ্রীয় সরকার। এর মধ্যে আবার ST তালিকায় অন্তর্ভুক্তির দাবি তুলেছে নাথ-যোগী সম্প্রদায়। নিজেদের অধিকারের জন্য পৃথক স্বশাসিত পর্যদের দাবি তুলেছে গারো উপজাতি। বোরো নিয়ে সরকারের পদক্ষেপে বিরক্ত এমন একাধিক গোষ্ঠীও রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে শান্তি ফেরানোর জন্য বন্ধুত্বপূর্ণ সমাধান প্রয়োজন।