ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টার জমানায় ওই শক্ত হলদেটে-বাদামি রঙের কাগজটি আজ দুর্লভ । একসময় এই ছোট্ট মোটা কাগজটিকে ঘিরেই বহু আবেগ, অপেক্ষা, মন কেমন আবর্তিত হয়েছে । পোস্টকার্ড । আজকাল এই নামটাও বড় কম শোনা যায় । নতুন প্রজন্ম কখনও গল্পকথায়, কখনও ইতিহাসের পাতায় কিংবা দাদু-ঠাম্মার সিন্ধুক থেকে হয়তো দু-একটি পোস্টকার্ডের সন্ধান পায় । তবে একসময় যোগাযোগের অপরিহার্য মাধ্যম ছিল এই পোস্টকার্ড । এর সুদীর্ঘ ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বহু তথ্য, যা তৎকালীন সময়ের সামাজিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে তুলে ধরে ।
উনবিংশ শতকের ষাটের দশক
অস্ট্রিয়ার হাত ধরে প্রথমবার বাজারে আসে পোস্টকার্ড । 1869 সালে উত্তর জার্মানিতে ওই একই চেহারার পোস্টকার্ডের মাধ্যমেই যোগাযোগ শুরু হয় । শুরু করেছিলেন জার্মানের তৎকালীন পোস্টাল অফিসার হেনরিখ ভন স্টিফেন ।
ভারতে পোস্টকার্ড
1879 সালের জুলাই মাস । ভারতে পোস্টকার্ডের পথচলা শুরু । প্রথম কার্ডটির গায়ে নাম লেখা ইস্ট ইন্ডিয়া পোস্টকার্ড । উপরের ডানদিকের কোণে রানি ভিক্টোরিয়ার ছবি । 1879-1889 সাল । সেইসময় বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় যে পোস্টকার্ড ব্যবহার করা হত, তাতে আইফেল টাওয়ারের ছবি থাকত ।
রঙিন পোস্টকার্ড
1889 সাল । এবার পোস্টকার্ডের সজ্জায় পরিবর্তন এল । প্রথমবার একাধিক রঙে সাজানো হল পোস্টকার্ডকে ।
মুছে দেওয়া হল ইস্ট শব্দটি
1899 সাল । ইস্ট ইন্ডিয়া পোস্টকার্ড থেকে ইস্ট শব্দটি ফেলে দেওয়া হয় । এবার থেকে শুধু ইন্ডিয়া পোস্ট কার্ড লেখা হল ।
বিংশ শতকের শুরুর দিকে অফিশিয়াল পোস্টকার্ড
1900-1930 সাল । ব্রিটিশ কলোনিগুলিতে ইউরোপিয়ানদের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছিল এই পোস্টকার্ড । পরবর্তী সময়ের এক সমীক্ষায় এক সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, 1902-1910 সালের মধ্যে প্রায় 6 বিলিয়ন পোস্টকার্ডের আদানপ্রদান হয়েছিল । 1911 সালে অফিশিয়াল কাজে ব্যবহারের জন্য বিশেষ পোস্টকার্ড তৈরি হয় ।
মুদ্রণের বিবর্তন ও পোস্টকার্ড
বিশ শতকের শুরু থেকে প্রিন্টিং মেশিন,টেকনিকে নানা পরিবর্তন ও পরিবর্ধন আসে । সেই সময় বেঙ্গালুরু ও মাদ্রাজে ( বর্তমানে চেন্নাই ) ফোটোগ্রাফি ও স্টুডিয়োর ব্যবসা শুরু হয় । আর এরে জেরেই পোস্টকার্ডের স্ট্যাম্পে, ছবিতে নানা পরিবর্তন আসে ।
স্বাধীনতার বছরে নতুন স্ট্যাম্প
1947 সাল । 15 অগাস্ট স্বাধীন হল ভারত । এরপর পোস্টকার্ডে স্ট্যাম্পে নানা পরিবর্তন এল । উজ্জ্বল সবুজ রঙে অশোকস্তম্ভ ছাপা হল । 1949 সালের ডিসেম্বরে সেই পোস্টকার্ড ডাক পরিষেবা দেওয়া শুরু করল । সেইসময় অনেক পোস্টকার্ডে গান্ধিজির ছবিও ব্যবাহার করা হয় । মূলত দুটি ছবি । একটিতে একটি শিশুকে নিয়ে গান্ধিজি । অন্যটিতে চরকায় সুতো কাটছেন গান্ধিজি । দিল্লি রাজধানী হয় । সেই সূত্রেই রাজধানী শহরের নানা স্থাপত্য, দর্শনীয় স্থানের ছবিও পোস্টকার্ডে ছাপা শুরু হয় । 1950 সালে পোস্টকার্ডে কোনার্কের ঘোড়ার ছবি দিয়ে স্ট্যাম্প ছাপা হয় ।
পোস্ট কার্ডের এক শতাব্দী পূর্ণ
1979 সাল । সেবছর সাড়ম্বরে পোস্টকার্ডের শতবর্ষ পালন হয় । নতুন স্ট্যাম্প হয় । যেখানে জায়গা পেয়েছিল 50 পয়সার ছবি । পোস্টকার্ডও ছিল রঙিন । মোট 30,00,00টি পোস্টকার্ড ছাপানো হয়েছিল । পোস্টকার্ডের সাইজ ছিল 3.91 x 2.90 cms ।
ক্যুইজ কনটেস্ট ও পোস্টকার্ড
বিশ শতকের আট-নয়ের দশক । ধীরে ধীরে হারাতে শুরু করে পোস্টকার্ডের গুরুত্ব । এক দশকের মধ্যে বাজারে STD, PCO আসে । 1993 সাল । সুরভি নামের একটি সাপ্তাহিক কুইজ় কম্পিটিশন চালু করা হয় ইন্ডিয়া পোস্টের তরফে । সেই সময় আবার পোস্টকার্ড নিয়ে বেশ মাতামাতি হয়েছিল ।
সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পোস্টকার্ডে বিজ্ঞাপন
একবিংশ শতাব্দী । পোস্টকার্ডের জনপ্রিয়তা প্রায় নেই কমতে শুরু করে । এই পরিস্থিতিতে পোস্টাকার্ডের অস্তিত্ব বাঁচাতে নতুন পরিকল্পনা নিল ইন্ডিয়া পোস্ট । 2002 সাল । মেঘদূত নামে একটি পোস্টকার্ড এল বাজারে । যেখানে ঠিকানা লেখার জায়গার কাছে বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য শূন্যস্থান রাখা হল । তবে এতে তেমন কোনও ফল মেলেনি ।
এই শতাব্দীর শুরুর কয়েকটা বছর পোস্টকার্ড খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চললেও, আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি । এস এম এস, হোয়াটস অ্যাপ চ্যাটিংয়ের বর্ণময় অধ্যায়ে নীরবে জায়গা করে নেয় রং চটা পোস্টকার্ড ।