বোলপুর, 7 জানুয়ারি: এশিয়ার প্রথম নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে গাড়ি ৷ WBA 8689 হাম্বার 1933 গাড়িটির রেজিস্ট্রেশন হয়েছিল ৷ এটি সম্ভবত ব্রিটিশ কোম্পানির একমাত্র গাড়ি যা নোবেলজয়ীয় নামে কেনা । শীতল পাটি দিয়ে গাড়ির ভিতরটা সাজিয়েছিলেন জাপানি শিল্পী কিন্তারো কাসাহারা ।
বর্তমানে সেই গাড়ি শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রভবন সংগ্রহশালায় সযত্নে রয়েছে । ওই গাড়িতে চড়েছেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, মহাত্মা গান্ধি, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর মতো বিশিষ্টরাও ৷ কবিগুরুর সাধের সেই গাড়ির খুঁটিনাটি ইটিভি ভারতে ৷
কলকাতার পার্ক স্ট্রিটের শোরুম থেকে একই মডেলের দুটি গাড়ি কেনা হয়েছিল ৷ একটি জোড়াসাঁকোয় থাকত, অন্যটি শান্তিনিকেতনে ৷ কবি শান্তিনিকেতনের গাড়িটিতেই বেশি চড়েছেন ৷ তবে গুরুদেব নিজে গাড়ি চালাতে জানতেন না । গাড়িটি চালাতেন কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ।বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবনের আধিকারিক নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় ও রবীন্দ্রভবনের রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট শাশ্বতী কর্মকারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর গাড়ির ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য মিলেছে ৷
গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষ দিকে তাঁর বাড়ি-গাড়ির সব কিছুই বানানো বা কেনা - এসব করতেন কবিপুত্র তথা বিশ্বভারতীর প্রথম উপাচার্য রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর । 1938 সালে তিনিই গুরুদেবের জন্য দুটি একই মডেলের গাড়ি কেনেন ৷ 1868 সালের ব্রিটিশ গাড়ি কোম্পানি হাম্বার । ভারতে কলকাতার 42, পার্ক স্ট্রিটে রুটস লিমিটেডের শোরুমে একমাত্র এই গাড়ি বিক্রি হত ৷ সেখান থেকেই হাম্বার 1933 মডেলের কালো রঙের দুটি সিডান গাড়ি কিনেছিলেন কবিপুত্র ৷
সেই সময় উৎকৃষ্ট মানের এক একটি গাড়ির দাম পড়েছিল ব্রিটিশ মুদ্রায় 400 পাউন্ড করে ৷ ভারতীয় মুদ্রায় তখন 5300 টাকা করে, অর্থাৎ মোট 10,600 টাকায় কেনা হয় গাড়ি দুটি ৷ একটি গাড়ি জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে রাখা হয়েছিল ৷ অন্যটি শান্তিনিকেতনে নিয়ে আসা হয় ৷ শান্তিনিকেতনে কবির ব্যবহৃত গাড়ির নম্বর WB A 8689 । উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, এই নম্বরটি এশিয়ার প্রথম নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছিল ৷ হাম্বার কোম্পানির কাছে যা ছিল একটি মাইলস্টোন ৷
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গাড়ির নকশা
বীরভূমের লালমাটিতে গ্রীষ্মকালে অত্যধিক তাপপ্রবাহ । উষ্ণ আবহাওয়া থেকে আরামদায়ক করার জন্য কবির গাড়ির ভিতরটি শীতল পাটি দিয়ে সাজিয়েছিলেন জাপানি শিল্পী কিন্তারো কাসাহারা । প্রসঙ্গত, 1916 সাল থেকে 1929 সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাঁচবার জাপান গিয়েছিলেন । জাপানের বহু সংস্কৃতি তিনি শান্তিনিকেতনে রোপণ করেছিলেন ৷ সেই সূত্র ধরেই পরিচয় শিল্পী কাসাহারার সঙ্গে ৷
কবির উদয়ন বাড়ির দেওয়াল ঠান্ডা রাখতে শীতল পাটি ব্যবহার করা হয়েছিল । জাপানে তাতামি ম্যাটের বদলে শান্তিনিকেতনে শীতল পাটি ব্যবহার করেছিলেন কিন্তারো কাসাহারা । একই ভাবে গুরুদেবের গাড়ির সিট ও ভিতর ঠান্ডা রাখতে শীতল পাটি দিয়ে মুড়ে দেওয়া হয়েছিল ৷ সেই সময় উন্নত মানের সিডান গাড়িটিতে চারটি দরজা ছিল ৷ শীতল ইঞ্জিন যাতে দ্রুত গরম হয় সেই ব্যবস্থা ছিল ৷ সহজেই চালক গাড়ি স্টার্ট করে স্পিড তুলতে পারতেন ৷ 1931 সালে এই মডেলের গাড়ি নির্মাণ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল । ফের 1933 সালে শুরু হয়েছিল এই মডেলের গাড়ি নির্মাণ ।
কবিগুরুর গাড়ির ব্যবহার
কবি যখন মূলত শান্তিনিকেতনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বা উপাসনায় অংশ নিতে যেতেন, তখন তিনি এই গাড়ি চড়েই যেতেন ৷ উপাসনা গৃহ, আম্রকুঞ্জ, শ্রীনিকেতনের মাঘ মেলা প্রভৃতি জায়গায় এই গাড়ি চড়ে গিয়েছিলেন গুরুদেব ৷ সেই সব ছবি রবীন্দ্রভবন সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত রয়েছে । এছাড়া, 1941 সালের 25 জুলাই অসুস্থ কবি যখন শেষবারের জন্য শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, অর্থাৎ কবির শেষ যাত্রার সঙ্গীও ছিল হাম্বার 1933 । কবিকে একটি অ্যাম্বুলেন্সের ন্যায় গাড়িতে অর্ধশায়িত অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল ৷ সেই অ্যাম্বুলেন্সের আগে আগে যাচ্ছিল কবির প্রিয় গাড়িটি ৷ সেই ছবিও রয়েছে বিশ্বভারতীর সংগ্রহে ৷
শুধু যে গুরুদেবই এই গাড়িতে চড়েছেন তা নয়, সস্ত্রীক মহাত্মা গান্ধি থেকে শুরু করে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর মতো প্রখ্যাত মানুষজনও শান্তিনিকেতনে কবির প্রিয় গাড়িতে চড়েছেন । তবে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ নিজে গাড়ি চালাতে জানতেন না বা কখনও চেষ্টাও করেননি ৷ কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর গাড়ি চালাতেন । এছাড়াও, কবির গাড়ি চালানোর জন্য একজন চালক ছিলেন ৷
কয়েক বছর আগে হিন্দুস্থান মোটরস রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গাড়িটি পুনরায় চালানোর চেষ্টা করেছিল ৷ কিন্তু, তা সফল হয়নি ৷ এত পুরনো যন্ত্রাংশ আর পাওয়া যায়নি ৷ তাই বর্তমানে কবির গাড়িটি রবীন্দ্রভবন সংগ্রহশালায় কাঁচের ঘরে প্রদর্শিত হয় ৷
বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবনের আধিকারিক নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় ও রবীন্দ্রভবনের রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট শাশ্বতী কর্মকার বলেন, "গাড়িটির বহু ছবি রবীন্দ্রভবনের আর্কাইভে রয়েছে । কবির প্রিয় গাড়িটি তাঁর শেষ যাত্রার সঙ্গী । বহু ইতিহাস, স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে এই গাড়ি নিয়ে ৷ বর্তমানে পর্যটকদের কাছে কবির এই গাড়ি খুব আকর্ষণীয় ।"