দিল্লি, 5 জুলাই : তাঁকে ঘিরে ছিল প্রত্যাশা । সকালে যখন প্রচলিত রীতি ভেঙে বাজেট নথি লাল শালুতে মুড়ে সংসদে পা রাখলেন তখন সেই গুঞ্জন আকাশও ছুঁয়েছিল । মধ্যবিত্ত আশায় বুক বাঁধতে শুরু করেছিল । কিন্তু কোথায় যেন শূন্যতা থেকেই গেল !
প্রথম পূর্ণাঙ্গ মহিলা অর্থমন্ত্রী হিসাবে ভারসাম্যের বাজেট পেশ করার চেষ্টা করলেন নির্মলা সীতারামন । একদিকে মধ্যবিত্তের কথা ভেবে আয়কর ছাড়ের হার অপরিবর্তিত রাখলেন । অন্যদিকে পেট্রল-ডিজ়েলের উপর লিটার প্রতি 1 টাকা সেস বসিয়ে মধ্যবিত্তের ভাঁড়ারে টান দেওয়ার চেষ্টা করলেন । মধ্যবিত্তদের পক্ষে সুখবর এইটুকুই যে, নতুন বাজেট-প্রস্তাবে আর আয়করের বোঝা বাড়ল না তাঁদের কাঁধে । আয়কর-কাঠামোয় কোনও রদবদল ঘটানো হল না । এখন যেমন বছরে 5 লাখ টাকার বেশি আয় করলেই কর দিতে হয়, সেই নিয়মই বহাল রাখা হল।
তবে গৃহঋণে এ বার কিছুটা বাড়তি উৎসাহ দেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে বাজেটে । বলা হয়েছে, কোনও বাড়ি বা ফ্ল্যাটের দাম যদি 45 লাখ টাকা বা তার চেয়ে কম হয়, তা হলে, তা কেনার জন্য নেওয়া ঋণের উপর 2020-র 31 মার্চ পর্যন্ত যত সুদ দেওয়া হয়েছে, তার উপর আরও দেড় লাখ টাকা কর-ছাড় দেওয়া হবে । এখন যে পরিমাণ ছিল 2 লাখ টাকা ।
আরও পড়ুন : বাজেটে বাংলা, পণ্য পরিবহনে জোর হলদিয়া-ফরাক্কায়
বিপুল জনসমর্থন নিয়ে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসা মোদি সরকারের সামনে অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ ছিল কর্মসংস্থান বৃদ্ধি । বেকারত্বের কালো ছায়া যখন গাঢ় হচ্ছে তখন মনে করা হচ্ছিল হয়তো কিছু সুরাহা দেবেন সীতারামন । কিন্তু কর্মসংস্থানে নির্মল বাতাস জোগাতে ব্যর্থ হলেন । বাজেটে কর্মসংস্থান নিয়ে একটি বাক্যও খরচ করলেন না নতুন অর্থমন্ত্রী ।
বাজেট পেশের আগে ভালো কিছু ঘটার আশায় বুক বেঁধেছিল দালাল স্ট্রিট । বাজার খুলতেই সেনসেক্স ও নিফটি একধাক্কায় বেশ কিছুটা বেড়েও গিয়েছিল । কিন্তু এখানেও সেই হতাশা । কর্মসংস্থানের সঠিক দিশা না পাওয়া, অর্থনীতিকে সঠিক দিশা দেখাতে না পারার প্রভাব পড়ল সেখানেও । বাজেট শেষ হতেই কয়েক ধাক্কায় নেমে এল সেনসেক্স ও নিফটি ।
ব্যাঙ্কিং অর্থনীতি ক্রমেই পথ হারাচ্ছিল । গত পাঁচ বছরেই ঋণ খেলাফি থেকে শুরু করে আর্থিক দুর্নীতির পরিমাণ বাড়ছিল । সরকারি ও বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলির হাল ফেরাতে উদ্যোগী হলেন নতুন অর্থমন্ত্রী । রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে সাহায্য করার জন্য 70 হাজার কোটি টাকা ঘোষণা করলেন । 'মিনিমাম গভর্মেন্ট, ম্যাক্সিমাম গভর্ন্যান্স'-এর কথা আওড়ে নির্মলার প্রস্তাব, তপশিলি জাতি ও উপজাতিদের জন্য স্টার্ট আপের বিশেষ সুবিধা দেওয়া হবে । ব্যবসায়ীদের উৎসাহ দিতে ঘোষণা করলেন পেনশনের । বার্ষিক ব্যবসার পরিমাণ দেড় কোটি টাকার কম হলে সেই সব ব্যবসায়ীরা পেনশনের সুবিধা পাবেন বলে জানালেন অর্থমন্ত্রী । অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকদের জন্য মাসে তিন হাজার টাকা কমিশনের প্রকল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথাও বললেন । শ্রম আইনের আমূল সংস্কারের কথা বললেন ।
আরও পড়ুন : লিটার পিছু 1 টাকা সেস বরাদ্দ হল পেট্রল-ডিজেলে
মোদির ডিজিটাল ইন্ডিয়ার স্বপ্নকে আরও উৎসাহ দিতে একাধিক পদক্ষেপের ঘোষণা করলেন নির্মলা । জানালেন, পূর্ব পরিকল্পনা মতোই ডিজিটাল লেনদেনে কোনও বাড়তি টাকা করতে হবে না । অনলাইন হোম লোন, ডোর টু ডোর পরিষেবায় জোর দেওয়া হল । ই - অ্যাসেসমেন্টের ক্ষেত্রে করদাতাদের কোনও ভোগান্তি বা হয়রানি যাতে না হয় তার জন্যও আশ্বাস দিলেন নির্মলা । সৃজনশীল শিল্পী ও কারীগরদের জন্য বিশেষ প্রকল্পের কথা ঘোষণা করা হল । স্বামী বিবেকানন্দকে উদ্ধৃত করে নির্মলা ঘোষণা করলেন নারী থেকে নারায়ণীর কথা । বললেন, বর্তমান সরকার বিশ্বাস করে মহিলাদের উন্নয়নের মাধ্যমেই দেশের উন্নয়ন সম্ভব । গ্রামীণ অর্থনীতিতে মহিলাদের ভূমিকার কথা স্বীকার করে নিয়ে অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাব এমন একটি কমিটি গঠনের যা মহিলাদের কাজের মূল্যায়ন ও উন্নয়নের সাহায্য করবে ।
বৈদ্যুতিক পণ্যের উৎসাহ বাড়াতে বিশেষ সুবিধার কথা ঘোষণা করলেন । পাশাপাশি NRI দের জন্য দ্রুত আধার কার্ড তৈরির প্রস্তাব দিলেন । আবার দেশের মেধা যাতে বিদেশে চলে না যায় সেজন্য পদক্ষেপ করলেন । জাতীয় গবেষণা সংস্থা তৈরির প্রস্তাব দিলেন । বিভিন্ন গবেষণার অনুদান এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে সমন্বয় আনতে বিশেষ কমিটি তৈরির কথা বললেন । স্বাভাবিক ভাবেই বাজেট পেশের পর প্রধানমন্ত্রী উচ্ছ্বাস চেপে রাখতে পারলেন না । একে দেশ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বাজেট বলেও ঘোষণা করলেন প্রধানমন্ত্রী । কিন্তু, সত্যিই কি বাজেট দেশ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ? প্রশ্ন তুলছে বিরোধীরা ।
আগামী পাঁচ বছর নরেন্দ্র মোদি সরকারের আর্থিক নীতি কী হবে, তার রূপরেখাও তুলে ধরতে হত নির্মলাকে । নরেন্দ্র মোদি দেশের অর্থনীতির বহরকে 2024-25-এর মধ্যে 5 লাখ কোটি ডলারে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন । বাজেটের আগের দিন আর্থিক সমীক্ষা বলেছিল, তার জন্য আর্থিক বৃদ্ধির হার নিয়মিত 8 শতাংশের কোঠায় থাকতে হবে । তার দিশা দেখাতে হত আজকের বাজেটে ।
গরিব চাষি, শ্রমিক, ব্যবসায়ী, শিল্পমহলের প্রত্যাশাও বিপুল । প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী চাষিদের জন্য বন্ধক ছাড়াই ঋণের বন্দোবস্ত করে দিতে হত । ছোটো-মাঝারি শিল্প, ব্যবসায়ীদের বাজেটে উপহার দরকার ছিল । চাকুরিজীবী মধ্যবিত্তের আশা, আয়করে সুরাহা মিলবে । শিল্পমহল কর্পোরেট কর কমার আশার করছিল । সাবধানী ভাবে সব দিকে নজর রাখার চেষ্টা করলেন ।
এখানেই ছিল নির্মলার চ্যালেঞ্জ । রাজকোষে টানাটানি । ভোটের আগের অন্তর্বর্তী বাজেটের হিসেবনিকেশ পালটে গেছে । আয়কর, GST থেকে আয় আশানুরূপ নয় । আর তাই হয়তো সংস্কারের পথে হাঁটলেন না নির্মলা । সাবধানী-ভারসাম্যের বাজেটের মধ্য দিয়ে আমজনতার পাশে থাকার চেষ্টা করলেন ।