দিল্লি, 18 নম্বর : ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক মজবুত করতে অ্যামেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘টাইগার ট্রায়াম্প’ – এর কথা ঘোষণা করেছেন । কিন্তু ‘টাইগার ট্রায়াম্প’ বিষয়টি কী ? তা নিয়ে একাধিক দেশের সরকারের মধ্যে কৌতূহল দেখা দিয়েছে । ‘টাইগার ট্রায়াম্প’ হল আসলে ভারত ও অ্যামেরিকার ত্রিমুখী যৌথ সামরিক মহড়া । সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অ্যামেরিকা সফরে গিয়েছিলেন । তখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ‘টাইগার ট্রায়াম্প’ –এর কথা ঘোষণা করেন । এই যৌথ সামরিক মহড়া নিঃসন্দেহে দুই দেশের মজবুত প্রতিরক্ষা সম্পর্কের পরিচয় । ভারত ও অ্যামেরিকার নৌবাহিনী 1992 সাল থেকেই যৌথ মহড়া দিয়ে আসছে । এই মহড়ার নাম ‘মালাবার’ ।
ভারত ও অ্যামেরিকার এই যৌথ মহড়ার উদ্দেশ্য হল একে অপরের সামরিক ও কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া এবং ভবিষ্যতে যৌথভাবে বিশেষ কোনও সামরিক অভিযান চালানোর প্রস্তুতি নেওয়া । এছাড়া এই ধরনের যৌথ মহড়ার আরও একটি বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে । ভারতবর্ষের তিন দিকে সমুদ্র রয়েছে – বঙ্গোপসাগর, আরব সাগর ও ভারত মহাসাগর । তাই ভারতীয় উপমহাদেশ এলাকায় সমুদ্রপথে বৈদেশিক আক্রমণ কীভাবে ঠেকানো সম্ভব সেই বিষয়ে ভারতীয় নৌবাহিনীর দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা রয়েছে । অন্যদিকে অ্যামেরিকার নৌবাহিনীও যথেষ্ট দক্ষ । প্রশান্ত মহাসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগর এলাকায় কীভাবে শত্রুর আ্ক্রমণ ঠেকানো সম্ভব সেই বিষয়ে তাদের অভিজ্ঞতা রয়েছে । কিন্তু এশিয়ার ভারতীয় উপমহাদেশ এলাকার সমুদ্রের চরিত্রের সঙ্গে আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের চরিত্র আলাদা । ফলে ওই দুই এলাকায় সামরিক কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গিরও যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে । তাই এশিয়ার সমুদ্র অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব বিস্তারে মরিয়া অ্যামেরিকার নৌবাহিনী ভারতের নৌবাহিনীর অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চাইছে । সেজন্য এই যৌথ মহড়ার উদ্যোগ । গত 27 বছর ধরে ‘মালাবার’ মহড়া চলছে । মহড়ায় নৌবাহিনীর কয়েক হাজার আধিকারিক ও সেনা অংশ নিয়েছে । এছাড়া মহড়ায় দুই দেশের যৌথ উদ্যোগে সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে উভয় দেশের ডুবোজাহাজ, যুদ্ধ বিমান, যুদ্ধ জাহাজ ইত্যাদি । শুধু কৌশলগত সামরিক পরিকল্পনা নয়, এই মহড়ার অন্য উদ্দেশ্যগুলি হল প্রাকৃতিক ও অন্যান্য বিপর্যয়ের সঠিক মোকাবিলা, জলদস্যুদের পরাস্ত করে সাধারণ মানুষকে তাদের হাত থেকে বাঁচানো ।
‘মালাবার’ মহড়ার অন্যতম সদস্য দেশ হল জাপান । জাপান সরকার বুঝতে পেরেছে তাদের সমুদ্রসীমা রক্ষা করার জন্য শক্তিধর রাষ্ট্রগুলির সাহায্য প্রয়োজন । 2007 সালের ‘মালাবার’ মহড়ার আয়োজক দেশ ছিল জাপান । 2015 সালে ভারত ও অ্যামেরিকার পর এই মহড়ায় তৃতীয় সদস্য দেশ হিসেবে জাপানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় । পরবর্তীতে অস্ট্রেলিয়াও এই মহড়ায় যোগ দেয় । নিজেদের নৌবাহিনীর পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়া তাদের সমুদ্রসীমার নিরাপত্তার জন্য ভারত ও অ্যামেরিকার নৌবাহিনীকে অতিরিক্ত সুরক্ষাকবচ হিসেবে বিবেচনা করে । তাই সব মিলিয়ে ‘মালাবার’ মহড়ার জন্য ভারত, অ্যামেরিকা, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সামরিক সম্পর্ক যথেষ্ট জোরদার হয়েছে । ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় ভারতের কৌশলগত সামরিক দৃষ্টিভঙ্গির কথা মাথায় রেখে অ্যামেরিকার নৌবাহিনীতে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক কমান্ড’ তৈরি করা হয়েছে । অ্যামেরিকা চায় ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় তাদের মিত্র দেশগুলি পর্যাপ্ত সামরিক শক্তির মাধ্যমে নিজেদের সমুদ্রসীমা রক্ষা করতে সমর্থ হোক । তাই ওই দেশগুলিতে সামরিক উপকরণ সরবরাহ করতে অ্যামেরিকা বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে । সম্প্রতি অ্যামেরিকার সঙ্গে ভারতের একটি সামরিক চুক্তি হয়েছে । এই চুক্তি অনুসারে অ্যামেরিকা ভারতকে INS জলাশ্ম এবং P-81 সরবরাহ করবে ।
এশিয়ায় শক্তি হওয়ার চেষ্টা দীর্ঘদিন ধরে করে আসছে চিন । তাই স্বভাবতই ‘মালাবার’ মহড়া তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে । ভারত মহাসাগর অঞ্চলে নিজেদের প্রতিপত্তি বাড়াতে ব্যস্ত চিন । কিন্তু সন্দেহ নেই ‘মালাবার’ মহড়া তাদের সেই উদ্যোগে একটি বড় কাঁটা । চিন একটি অনেক বড় দেশ । কিন্তু তাদের সমুদ্রসীমা সেই তুলনায় অনেকটাই কম । নিজেদের নৌবাহিনীকে ভারতের কাছাকাছি রাখার জন্য চিন শ্রীলঙ্কার হামবানটোটা এলাকাটিকে বেছে নিয়েছে । এছাড়া চিন বাংলাদেশ, মায়ানমার, ফিলিপিন্স ও আফ্রিকার দেশগুলির সেনাবাহিনীর সঙ্গেও সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলছে । ভারতের অন্যতম শত্রুদেশ পাকিস্তানকে হাতে রাখার জন্য চিন বালুচিস্তানে গদর সমুদ্র বন্দর ও CPEC (চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিড়র) তৈরিতে সাহায্য করছে । চিন মনে করে ‘মালাবার’ মহড়া এশিয়ায় তাদের শক্তি হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে বড় বাধা ।
এখনও পর্যন্ত শুধু রাশিয়ার সঙ্গে ভারত ত্রিমুখী সামরিক মহড়া করেছে । যার নাম ‘ইন্দ্র’ । এবার প্রথম অ্যামেরিকার সঙ্গে এই ধরনের মহড়া করবে ভারত । এই মহড়ার নাম ‘টাইগার ট্রায়াম্প’ । এই মহড়ায় দুই দেশের 1200 সেনা অংশ নেবে । মহড়া শুরু হয়েছে 13 নভেম্বর থেকে । চলবে 21 নভেম্বর পর্যন্ত । মহড়ার জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে অন্ধপ্রদেশের কাকিনাড়া ও বিশাখাপটনম এলাকাকে । এতদিন পর্যন্ত ভারত ও অ্যামেরিকার সামরিক মহড়ায় জল, স্থল ও বায়ু সেনা আলাদা আলাদাভাবে অংশ নিত । এই প্রথম ‘টাইগার ট্রায়াম্প’ মহড়ায় দুই দেশের জল, স্থল ও বায়ু সেনা একযোগে অংশ নিচ্ছে । কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, এই মহড়া দুই দেশের সম্পর্কে নিঃসন্দেহে এক নতুন মাইল ফলক ।