দিল্লি, 13 জানুয়ারি : ২০১৯ সালে জাতীয় বৃদ্ধি প্রতি ত্রৈমাসিকে খুব দ্রুত নেমেছে । উল্লেখ্য সেবছরের একেবারে শেষদিনে সরকার পরিকাঠামো উন্নয়ন পরিকল্পনা খাতে আগামী পাঁচ বছরের জন্য এক লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে । ঘোষণাটি এমন সময় হয়েছে, যে সময় মার্চ ২০২০ পর্যন্ত শেষ হওয়া গত তিন অর্থবর্ষে জাতীয় বৃদ্ধির গ্রাফ শুধুই নীচের দিকে নেমেছে । আসল GDP বৃদ্ধি ২০১৬-১৭ অর্থবর্ষের ৮.২ শতাংশ থেকে পরের বছর হয়েছে ৭.২ শতাংশ । গত বছর তা কমে হয় ৬.৮ শতাংশ । আর চলতি অর্থবর্ষে চিন্তা অনেকটাই বাড়িয়ে তা ১.৮ শতাংশ কমে ৫ শতাংশে এসে দাঁড়াবে বলে মনে করা হচ্ছে । কোনও সন্দেহই নেই, এই বিষয়টি নিয়ে সরকার প্রবল চাপে রয়েছে । যাই হোক করে বৃদ্ধির গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী করাই সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ । এই অবস্থার মোকাবিলায় সড়ক,শক্তি,আবাসন,সেচ-সহ একাধিক ক্ষেত্রে পরিকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার । কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও ২০২৫ সালে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী পাঁচ লক্ষ কোটির অর্থনীতি লক্ষ্যমাত্রা ছোঁয়া মুশকিল । পরিকাঠামো ক্ষেত্রে এই বিনিয়োগ কি ভবিষ্যতের বড় বিনিয়োগ, বৃদ্ধি এবং চাকরির সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেবে?
অর্থনীতির কঠিন সময় থেকে বেরিয়ে আসার জন্য নানা দেশের কাছে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত জন-পরিকাঠামো ক্ষেত্রে বিনিয়োগ । এর সাম্প্রতিক উদাহরণ হল দক্ষিণ কোরিয়া । বাণিজ্য নির্ভর এই দেশের রপ্তানি ব্যবসা বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল অ্যামেরিকা ও চিনের মধ্যে গতবছরের বাণিজ্য সমস্যার জন্য । এর ফলে সে দেশে বৃদ্ধি ব্যাপকভাবে ধাক্কা খায় । এই অবস্থায় কর্মসংস্থান ও বেসরকারি ক্ষেত্রগুলিতে গতি আনতে প্রেসিডেন্ট মুন জায় ইন জন পরিকাঠামো উন্নয়নে পাঁচ হাজার একশো কোটি ডলার বিনিয়োগের কথা ঘোষণা করেন । এই ধরনের সরকারি বিনিয়োগ চাহিদা বাড়াতে, বেসরকারি ক্ষেত্রের উন্নতিতে এবং সার্বিকভাবে অর্থনীতির উন্নতিতে বড় ভূমিকা নেয় বলে মনে করা হয় । কেইনেসিয়ানের অর্থনীতির তত্ত্ব অনুযায়ী অর্থনীতির উন্নতিতে এই পদ্ধতি বেশ কার্যকরী ।
এই আবহে গত ১১ বছরের নিম্নগামী বৃদ্ধি ঠেকাতে পরিকাঠামো ক্ষেত্রে সরকারি বিনিয়োগের সিদ্ধান্তে ভুল কিছু খুঁজে পাওয়া কষ্টকর । বিশেষজ্ঞরা একমত হতে পারছেন না যে, দেশের বৃদ্ধি তলানিতে পৌঁছেছে, নাকি আরও নিচে নামতে পারে । পরিকাঠামো ক্ষেত্রে এই বিনিয়োগের বণ্টনের বিষয়টাও উল্লেখযোগ্য । এর মধ্যে পরের বছরই ১৯.৫ ট্রিলিয়ন টাকা খরচ করার প্রস্তাব দিয়েছে সরকার। পরের অর্থবর্ষ, অর্থাৎ ২০২১-২২ সালে খরচ হবে ১৯ ট্রিলিয়ন টাকা । এরপর বিনিয়োগের পরিমাণ ক্রমশ কমতে থাকবে । পরের তিন বছরে খরচ করা হবে ১৩.৫ ট্রিলিয়ন, ১২.৫ ট্রিলিয়ন এবং ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে ১১ ট্রিলিয়ন টাকা । এই বিনিয়োগের প্রায় ৮০ শতাংশ খরচ হবে সড়ক, গ্রাম ও আবাসন, রেল, শক্তি এবং সেচের ক্ষেত্রে । কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার সমান ভাবে এই সব প্রকল্পের ৭৮ শতাংশ ঝুঁকির দায়িত্ব নেবে। বাকি ২২ শতাংশের দায়িত্ব থাকবে প্রকল্পে অংশ নেওয়া বেসরকারি সংস্থার উপর । ২০২০ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে সম্ভাব্য ও কার্যকর প্রকল্পগুলির তালিকা তৈরি করা হয়েছে ন্যাশনাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার পাইপলাইন (NIP)-এর আওতায় । এর মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের কাজও শুরু হয়েছে ।
আগামী পাঁচ বছরে একই ধরনের বিনিয়োগের থেকে এই বিনিয়োগের পার্থক্য কোথায়? মোদি সরকার ২০১৪-১৫ সাল থেকে রাস্তা, জাতীয় সড়ক, আবাসন, গ্রামীণ উন্নয়ন, ডিজিটালাইজেশন এবং অন্যান্য পরিকাঠামো ক্ষেত্রে বিপুল বিনিয়োগ করেছিল, তা প্রায় সকলেই জানেন । NIP রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবর্ষে খরচের পরিমাণ ২.৩ গুণ বাড়িয়ে ৩.৯ ট্রিলিয়ন টাকা করেছে কেন্দ্রীয় সরকার । GDP-এর অংশ অনুযায়ী এই পর্বে বৃদ্ধির পরিমাণ ১.৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ২.৩ শতাংশ হয়। গত অর্থবর্ষ, অর্থাৎ ২০১৮-১৯ সালে পরিকাঠামো ক্ষেত্রে সরকারি খরচ ছিল ৩.৮ ট্রিলিয়ন টাকা । এর বিপরীতে পরের বছর NIP-এর আওতায় কেন্দ্রের মূলধন ব্যয় ধরা হয়েছে ৪.৬ ট্রিলিয়ন টাকা, যা ২০২০-২১ অর্থবর্ষের মোট বিনিয়োগ (১৯.৫ ট্রিলিয়ন টাকা)-এর ২৪ শতাংশ । আগামী দুই বছরে কেন্দ্রীয় সরকারের বর্ধিত ব্যয় এক ট্রিলিয়ন টাকারও কম । এই ব্যয়ের পরিমাণ বাড়বে ২০২৪ এবং ২০২৫ অর্থবর্ষের একেবারে শেষের দিকে । উলটো দিকে প্রথম তিন বছরে রাজ্যগুলি তাদের শেয়ারের একটা বড় অংশ খরচ করবে ।
সাধারণ মানুষের চাহিদা বৃদ্ধির নিরিখে,অর্থাৎ বৃহৎ অর্থনীতি বা এক্ষেত্রে রাজস্ব নীতির ক্ষেত্রে যার দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি, সেই কেন্দ্রীয় সরকারের বর্তমান পদক্ষেপ থেকে ঠিক কী আশা করা যায়?
এক্ষেত্রে, গত পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা কিন্তু একেবারেই ভাল নয় । পরিকাঠামো ক্ষেত্রে ২০১৩-১৪ অর্থবর্ষের ৬.৩ ট্রিলিয়ন বিনিয়োগ গত দুই বছরে, অর্থাৎ ২০১৭ থেকে ২০১৯-এর মধ্যে বেড়ে হয়েছে ১০ ট্রিলিয়ন টাকা। এর বেশির ভাগটাই হয়েছে সরকারি খরচ বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হওয়ায়। পরিকাঠামো বিনিয়োগের পরিমাণ গত দুই বছরে বেড়েছে চার ট্রিলিয়ন।
বৃদ্ধির ফলাফল কেমন হল? যা আশা করা হয়েছিল, তার ঠিক উলটো ফল হয়েছে । GDP বৃদ্ধির হার, যেমনটা আগেও উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৭-১৮ অর্থবর্ষে কমে গিয়েছে। এই হ্রাস পাওয়া বজায় থেকেছে ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষে এবং আশঙ্কা করা হচ্ছে, চলতি অর্থবর্ষে GDP আরও নেমে ৫ শতাংশ বা তারও কম হবে । আমরা যদি কর্মসংস্থানের দিকে তাকাই, তা হলে NSSO-এর পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে ২০১৭-১৮ বলছে, বেকারত্বের হার পৌঁছেছে চার দশকের সর্বোচ্চ পর্যায়ে, ৬.১ শতাংশে । এই রিপোর্টই প্রাথমিকভাবে আটকে রেখে ২০১৯ সালের মে মাসের শেষের দিকে প্রকাশ করা হয় । বেসরকারি পরিসংখ্যান সংস্থা CMIE-এর রিপোর্টও প্রায় একই কথা বলছে । এই রিপোর্টেরই যেন প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে ব্যবসা ও গ্রাহক মানসিকতার উপর । সাধারণ মানুষের খরচ করার ইচ্ছা এবং অবশ্যই ক্ষমতা নেমে গিয়েছে একেবারে তলানিতে। আন্তর্জাতিক বাজারে যা প্রতিযোগিতার সূচক হিসাবে দেখা হয়, সেই রফতানি ব্যবসা গত বছরে কমেছে দুই শতাংশ। উৎপাদন শিল্পে বৃদ্ধি কমেছে পাঁচ শতাংশেরও বেশি । NIP-এর অতিরিক্ত দায়িত্ব, যা কি না ভারতের প্রতিযোগিতার পরিবেশের উন্নতি, বিশেষ করে উৎপাদন শিল্পে, তা নিশ্চয়ই এই রিপোর্ট মাথায় রেখেই করা হয়েছে ।
সবমিলিয়ে পারফরম্যান্স একেবারেই উৎসাহবর্ধক নয় । এই বিপ্রতীপ ফলাফলের একাধিক কারণ থাকতে পারে যেমন, বর্ধিত ও অনাদায়ী ব্যাঙ্ক ঋণ, ঋণ দেওয়া থেকে ব্যাঙ্কের পিছিয়ে যাওয়া, NBFC-এর সমস্যা এবং যার ফলাফল অর্থ সঙ্কট, কর্পোরেটগুলির বাধ্যবাধকতা যার ফলাফল বেসরকারি ক্ষেত্রে ঝুঁকি নেওয়ার অনিচ্ছা প্রভৃতি । এগুলিই সম্ভবত বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান এবং আয়ের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে । অবশ্য এর বিপরীত চিন্তাভাবনা এবং বিশ্লেষণগুলিকে উপেক্ষা করা যায় না । হয়তো পরিকাঠামো ক্ষেত্রে এই বিনিয়োগ ছাড়া বৃদ্ধি আরও কম হত । এই বিনিয়োগের ৬০ থেকে ৮০ শতাংশকে মনে করা হয় নির্মাণ শিল্পে । দেশের অন্যতম প্রধান কর্মসংস্থান তৈরি করার ক্ষেত্র হিসাবে নির্মাণ শিল্পকে ধরা হয় । ৭ জানুয়ারি প্রকাশিত অ্যাডভান্সড GDP তথ্য অনুযায়ী এই ক্ষেত্রে চলতি বছর অবনমন হয়ে মাত্র ৩.২ শতাংশে এসে ঠেকেছে । এক বছর আগে এই ক্ষেত্রে বৃদ্ধি হয়েছিল ৮.৭ শতাংশ । ২০১৭ থেকে ২০১৯ এর মধ্যে হওয়া পরিকাঠামো ক্ষেত্রে বিনিয়োগ ছাড়া নির্মাণ শিল্পে এই মন্দা আরও বৃদ্ধি পেত বলে মনে করছেন অনেকে ।
বৃদ্ধির এই মিশ্রচিত্র থেকে মনে করা হচ্ছে যে, সাম্প্রতিক বিনিয়োগের ঘোষণা থেকে বিশাল পরিবর্তনের আশা না রাখাই ভাল । তবে একটাই সান্ত্বনা, বিনিয়োগের এই ওষুধ ছাড়া হয়তো এই বৃদ্ধি আরও নিম্নগামী হত ।