মানব পাচারের বিষয়টি প্রথম প্রকাস্যে আসে 1991 সালের অগাস্ট মাসে । ওই দিন হায়দরাবাদ—দিল্লিগামী ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বিমানে অমৃতা আলুওয়ালিয়া নামে এক বিমান সেবিকা হঠাৎ লক্ষ্য করেন, বিমানে 10 বছর বয়সি এক নাবালিকা সারাক্ষণ কেঁদেই চলেছে । ডেকে জিজ্ঞাসা করলে সে জানায়, ষাটোর্ধ্ব বা সত্তরের কোঠায় থাকা এক ব্যক্তির সঙ্গে তার বিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং তাকে অন্য কোনও দেশে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে । এরপর ওই বিমান সেবিকার উদে্যাগেই মেয়েটিকে দেশ ছাড়ার আগেই উদ্ধার করা হয় এবং তার তথাকথিত ‘স্বামী’টিকেও পাকড়াও করা হয় । তবে পরবর্তীকালে সে জামিনে ছাড়া পেয়ে ভুয়ো পাসপোর্টে দেশের বাইরে পালিয়ে যায়।
এরপর থেকেই বেশ কয়েক দফায় 4—10 বছর বয়সি নাবালকদের উপসাগরীয় দেশের অর্বুদপতিদের কাছে বেচে দেওয়ার ঘটনার কথা জানা যায় । উটের দৌড় প্রতিযোগিতার জন্যই তাদের পাচার এবং নিগ্রহ করা হয়েছিল । নাবালকদের ব্যবহার করা হত ‘জকি’ হিসেবে । উটের পিঠের সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হত তাদের । উট কতটা জোরে দৌড়বে, তা নির্ভর করত তার পিঠে বাঁধা ৷ ওই নাবালকদের ভয়ার্ত চিৎকারের উপর । অনেক সময় ঠিকভাবে না বাঁধার কারণে দৌড়ের সময় মাঝপথেই বাঁধন খুলে কোনও কোনও নাবালক মাটিতে পড়ে যেত আর উটের পায়ের তলায় চলে এসে পিষে যেত । যারা কোনওরকমে প্রতিযোগিতা শেষ হওয়া পর্যন্ত কোনওক্রমে বেঁচে যেত, তাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকত অত্যন্ত কষ্টকর এবং অনিশ্চিত জীবন । কখনও কখনও তাদের যৌন নিগ্রহের মুখেও পড়তে হত ।
অতি সম্প্রতি জানা গেছে, ইটভাটায় যারা কাজ করে, তারাও কনট্র্যাক্টরদের নিগ্রহের শিকার হয়েছে । এদের মধ্যে মহিলা এবং শিশুরাও রয়েছে । কারও কারও সঙ্গে তো রীতিমতো ক্রীতদাসের মতো ব্যবহার করা হয় এবং কাজের অযোগ্য পরিস্থিতিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা খাটানো হয় । অথচ বেতন মেলে নামমাত্র । 2013 সালে এমনই নিগৃহীত কিছু ইটভাটার কর্মীরা এক কনট্র্যাক্টরের কবল থেকে পালানোর চেষ্টা করেছিল । দুর্ভাগ্যবশত তারা ধরা পড়ে এবং তাদের সামনে শাস্তি বেছে নেওয়ার বিকল্প রাখা হয় । হয় একটা পা কাটা যাবে আর নয় একটা হাত।
কয়েকদিন আগেই সংবাদপত্রে ইটভাটায় কাজ করা এক আদিবাসী বালিকার সাহসের বৃত্তান্ত প্রকাশিত হয়েছিল । কাজের বিনিময়ে সপ্তাহে 250 টাকা পেত মানসি বারিহা নামে ওই বালিকা । কাজ ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা জানাতেই, তাদের কনট্র্যাক্টর আর তার পোষা গুন্ডা তাদের বেধড়ক মারধর করে। মানসী কোনওক্রমে সবটা রেকর্ড করে আর সোশাল মিডিয়ায় সেই ভিডিয়ো ছেড়ে দেয়। ওই রেকর্ডিং ভাইরাল হয়ে পড়লে প্রশাসনেরও টনক নড়ে। তারা সক্রিয় হয়ে তামিলনাড়ুর ওই ইটভাটা থেকে 6000—এরও বেশি কর্মীকে উদ্ধার করে।
এই ধরনের কিছু ঘটনায় মানব পাচারের কবলে পড়া নাবালক—নাবালিকার সঙ্গে যৌন নিগ্রহও হয়। রাষ্ট্রসংঘের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে মানব পাচারের কবলে পড়াদের মধ্যে 70 শতাংশই মহিলা এবং বালিকা । যৌন নিগ্রহের উদ্দেশ্য ছাড়া আর কী কারণে তাদের পাচার করা হবে? এ কথা বিশ্বাস না করার কোনও কারণ নেই যে, ভারতে মহিলা এবং শিশু পাচার করা হয় না আর তার হার যত শতাংশই হোক না কেন, বিষয়টি কোনওভাবেই মেনে নেওয়া যায় না । যাদের পাচার করার পর যৌন নিগ্রহ করা হয়, তাদের অধিকাংশই হতদরিদ্র এবং ঋণ নিয়ে মেটাতে পারেনি। এমন বহু ঘটনা আছে, যেখানে দারিদ্রের কারণে বাবা—মায়েরা তাদের বালক—বালিকাকে বেচে দিয়েছে । আবার এমনও নজির আছে যে, বালক—বালিকাদের অপহরণ করার পর কোনও পাচার চক্রের মাফিয়ার হাতে বেচে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া মানব পাচারের আরও কিছু কায়দা আছে, যা রীতিমতো পরিশীলিত। যেমন বাল্যবিবাহ, কিংবা শিশুশ্রম এমনকী চুক্তির ভিত্তিতে শ্রমদান, যা আমার মতে ক্রীতদাসত্বের থেকে কোনও অংশে কম নয়। তবে মানব পাচারের সাম্প্রতিকতম রূপ হল সাইবার ট্রাফিকিং, যেখানে কিশোরীদের এই পাচারকারী ও তাদের এজেন্টরা নানা রকম ছল—চাতুরীর সাহাযে্য আকর্ষণ করে এবং শেষপর্যন্ত তাদের দেহব্যবসায় জড়িয়ে দেয়। যেহেতু এই ক্ষেত্রে সমস্ত কথাবার্তা এবং আর্থিক লেনদেন ইন্টারনেটের মাধ্যমেই হয়, তাই যারা এদের কবলে পড়ে, তাদের অনেকেই এই এজেন্ট ও কনট্র্যাক্টরদের শনাক্ত করতে পারে না। এতে পাচার চক্রের পাণ্ডার গতিবিধি নজরদারি করাও কঠিন হয়ে পড়ে এবং আরও দুরূহ হয়ে যায় তাদের পাকড়াও করা। সম্প্রতি দিল্লিতে একজন মহিলা মানব পাচারকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যে ঘটনায় এটা স্পষ্ট যে এই ধরনের পাচারচক্রের মাফিয়াদের সঙ্গে সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রয়েছে। ওই মহিলা পাচারকারী দিল্লিতে এই কাজ করছিলেন 2000 সাল থেকে । দীর্ঘ 20 বছর ধরে তার এই কুকর্ম চলছিল অবাধে এবং যে কোনও কারণেই হোক, কারও নজর সে দিকে এতদিন পড়েনি ।
মানব পাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করা এবং সমাজে এ নিয়ে বিশ্বব্যাপী স্তরে সচেতনতা বাড়াতে রাষ্ট্রসংঘ ‘ব্লুহার্ট ক্যাম্েপন’ চালু করেছে । দিন কয়েক আগে বিশ্ব মানব পাচার বিরোধী দিবস পালন করা হয়েছিল এবং এ নিয়ে হায়দরাবাদের বিশিষ্ট অসরকারি সংগঠন প্রজ্বলার তরফে আয়োজিত একটি ওয়েবিনারে আমিও অংশগ্রহণ করেছিলাম। সেখানে মানব পাচারের জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন, এমন কিছু মানুষদের নিয়ে গড়া সংগঠন ‘অপরাজিতা’র তরফে তিনজন উপস্থিত ছিলেন। এদের মধে্য একজনকে তার মা দেহব্যবসার কারবারিদের হাতে বেচে দিয়েছিল, আর একজন তারই এক ‘বন্ধু’—র খপ্পড়ে পড়ে পাচার চক্রে জড়িয়ে পড়ে আর তৃতীয় জন যে স্কুলে পড়ত, সেই স্কুলেরই এক কর্মচারী তাকে হায়দরাবাদ থেকে দিল্লিতে নিয়ে আসে এবং ‘রেড লাইট এরিয়া’য় পাঠিয়ে দেয়। তাদের এবং দেশের 14টি রাজ্য থেকে আসা আরও অনেকের অভিজ্ঞতা শুনে উপস্থিত সকলেই চমকে উঠেছিলেন। তাদের অভিজ্ঞতাকে ভয়ঙ্কর বললেও হয়তো কমই বলা হয়।
মানব পাচার রুখতে সমাজের অঙ্গ হিসেবে আমরা কী করতে পারি ? বর্তমানে পরিস্থিতি যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, তাতে মনে হয় যে এই কুপ্রভাবকে হয়তো চিরতরে প্রতিরোধ করা যাবে না কিন্তু অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। আমাদের মতো জনকল্যাণকর রাজ্যের এটা প্রাথমিক কর্তব্য যাতে আমরা মহিলা ও শিশুদের এমন জীবনযাত্রা উপহার দিতে পারি, যাতে তাঁদের মর্যাদা ও সম্মানরক্ষা হয়। তাঁদের উপর যৌন বা অন্য কোনও ধরনের নিগ্রহ যেন না হয়। আইন প্রণয়নকারী সংস্থাদের আগের থেকেও বেশি নজর রাখা উচিত যাতে এই মানব পাচারকারী এবং প্রভাবশালী মহলের দুষ্ট আঁতাত ভেঙে যায়। এই রকম কিছু সাধারণ পদক্ষেপ করলেই পরিবর্তন আসবে। মানব পাচার চক্র থেকে যারা বেরিয়ে আসতে পারবেন, তাদের জন্য আবাসিক হোম তৈরি করা উচিত, যেমন ওই ওয়েবিনারে উপস্থিত, তিন জন বলেছিলেন। তবে এর পাশাপাশি এগুলির উপর নিয়মিত স্তরে নজরদারিও প্রয়োজন, যাতে সেখানে মুজফ্ফরপুরের আবাসিক হোমের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়। রাজনৈতিক মদতপুষ্ট এবং রাজে্যর অর্থে পরিচালিত মুজাফ্ফরপুরের ওই হোমে আবাসিকদের উপর গণধর্ষণের ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছিল।
গোটা ঘটনায় সমাজের বড় ভূমিকা পালন করা প্রয়োজন আর আমি বিশ্বাস করি, এটা আমাদের প্রত্যেকেরই কর্তব্য যে শিশু শ্রমের ঘটনা হোক বা চুক্তির ভিত্তিতে শ্রমদানের ঘটনা হোক বা পাচারচক্রের যে কোনও রূপ হোক, এমনকী তা যৌন নিগ্রহের সঙ্গে জড়িত হোক বা না হোক–আমরা সবসময় সতর্ক থাকব এবং এ ধরনের ঘটনা ঘটলে পুলিশকে জানাব। সমষ্টিগঠভাবে আমরা প্রতিক্রিয়া না দিলে, এই মারাত্মক প্রবণতা আরও অনেক বেশি শিশু এবং মহিলার সর্বনাশ ঘটাবে। আর নিশ্চিতভাবেই আমরা তা হতে দিতে পারি না।