কংগ্রেসের 23 জন বিক্ষুব্ধ নেতা দলের নেত্রী সোনিয়া গান্ধিকে সম্প্রতি চিঠি দিয়ে আবেদন করেছিলেন যে, যোগ্য কাউকে দলের পূর্ণমেয়াদি সভাপতিত্বের জন্য নির্বাচিত করা হোক । সেই চিঠি নিয়ে দলের অন্দরে যথেষ্ট শোরগোল হয় । যে 23 জন নেতা চিঠি দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন কংগ্রেসের অন্যতম বর্ষীয়ান নেতা গুলাম নবি আজ়াদ । তাই তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে দলের অন্দরে এখন জল্পনা শুরু হয়েছে । গুলাম নবি আজ়াদ বর্তমানে রাজ্যসভার সদস্য । রাজ্যসভায় তাঁর পঞ্চম মেয়াদ শেষ হবে আগামী বছরের 15 ফেব্রুয়ারি । আর তারপর দলের তরফে গুলাম নবি আজ়াদকে ফের রাজ্যসভায় নির্বাচিত করা কার্যত অসম্ভব বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহলের একাংশ ।
তবে গুলাম নবি আজ়াদকে এক্ষেত্রে কিছুটা সাহায্য করতে পারে পুদুচেরি । সেখান থেকে বর্তমানে AIADMK-এর রাজ্যসভার সদস্য হলেন এন গোকুলকৃষ্ণন । তাঁর মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী বছরের 21 অক্টোবর । তারপর সেখান থেকে কংগ্রেস গুলাম নবি আজ়াদকে রাজ্যসভায় পাঠাতে পারে, কিন্তু সেটা তবেই সম্ভব হবে যদি আগামী বছর কংগ্রেস পুদুচেরিতে ক্ষমতায় আসে । সুতরাং এর থেকে যা বোঝা যাচ্ছে তা হল মেয়াদ শেষ হওয়ার পর গুলাম নবি আজ়াদকে 2022 সালের মার্চ মাসে পরবর্তী রাজ্যসভা নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে । শুধু তাই নয়, সেক্ষেত্রে সেই নির্বাচনে জিতে তিনি তবেই রাজ্যসভায় যাওয়ার সুযোগ পাবেন যদি কংগ্রেসের হাতে তখন জেতার জন্য নিশ্চিত কোনও আসন থাকে । কিন্তু সূত্রের খবর, গুলাম নবি আজ়াদের পক্ষে কংগ্রেসের হয়ে ফের রাজ্যসভায় নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ বড়ই ক্ষীণ ।
উল্লেখ্য, রাজ্যসভায় বর্তমানে গুলাম নবি আজ়াদ পূর্বতন জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করছেন । যদিও জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখকে 2019 সালে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে রূপান্তরিত করা হয়েছে । তবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্প্রতি এটা স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, ভবিষ্যতে কেন্দ্রশাসিত জম্মু ও কাশ্মীরে বিধানসভা নির্বাচন হবে । তবে সে জন্য 2021 সালের মার্চের মধ্যে সেখানে বিধানসভা কেন্দ্রগুলির পুনর্বিন্যাস করতে হবে ।
2015 সালে গুলাম নবি আজ়াদ যখন রাজ্যসভায় নির্বাচিত হন, তখনও তাঁর নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক মহলে যথেষ্ট জল্পনা ছড়িয়েছিল । সেবার তিনি শেষ পর্যন্ত ন্যাশনাল কনফারেন্সের বিধায়কদের সমর্থন নিয়ে রাজ্যসভায় নির্বাচিত হয়েছিলেন । তবে এটা ঘটনা যে, জম্মু ও কাশ্মীরের বদলে দেশের অন্য কোনও রাজ্য থেকে গুলাম নবি আজ়াদকে নির্বাচনে জিতিয়ে রাজ্যসভায় পাঠানো কংগ্রেসের ম্যানেজারদের পক্ষে কার্যত অসম্ভব । বর্তমানে কংগ্রেস ক্ষমতায় রয়েছে পঞ্জাব, রাজস্থান ও ছত্তিশগড়ে । কিন্তু ওই তিনটি রাজ্য থেকেই ইতিমধ্যে রাজ্যসভায় প্রতিনিধি পাঠিয়ে দিয়েছে দল । এছাড়া অন্য যে রাজ্যগুলিতে কংগ্রেস ক্ষমতায় না থাকলেও তাদের যথেষ্ট সংখ্যক বিধায়ক রয়েছে, সেগুলি হল কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশ ও গুজরাত । কিন্তু ওই রাজ্যগুলি থেকেও ইতিমধ্যে রাজ্যসভায় প্রতিনিধি পাঠিয়েছে কংগ্রেস । অন্যদিকে মহারাষ্ট্র থেকেও কংগ্রেসের তরফে রাজ্যসভায় কাউকে পাঠানো সম্ভব নয় । কারণ সেই রাজ্যে যে জোট সরকার চলছে তাতে শিব সেনা ও ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টির জোট শরিক হল কংগ্রেস এবং সেখানেও রাজ্যসভার নির্বাচন ইতিমধ্যে হয়ে গিয়েছে ।
কংগ্রেসের অন্দরের সূত্র বলছে, যদিও গুলাম নবি আজ়াদের বিক্ষুব্ধ নেতাদের সঙ্গে জোট বেঁধে সোনিয়া গান্ধিকে চিঠি লেখা ও তাঁর রাজ্যসভায় প্রত্যাবর্তনের মধ্যে দৃশ্যত কোনও সম্পর্ক এখনও পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু এটাও ঠিক যে, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাজ্যসভায় এই বর্ষীয়ান নেতার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর এবং LOP স্টেটাস চলে যাওয়ার পর তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অতটা সহজ হবে না । কারণ তখন গুলাম নবি আজ়াদের কাছে একমাত্র যে পদটি থাকবে সেটি হল হরিয়ানা রাজ্যের ইন চার্জ হিসেবে AICC (সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটি)-র সাধারণ সম্পাদক । এই পদ তিনি পেয়েছিলেন 2019 সালে । তার আগে 2016 গুলাম নবি আজ়াদ উত্তরপ্রদেশের AICC-র ইন চার্জ হিসেবে দায়িত্ব সামলেছেন । উত্তরপ্রদেশে 2017 সালে গুরুত্বপূর্ণ বিধানসভা নির্বাচনের আগে গুলাম নবি আজ়াদকে ওই দায়িত্ব দেওয়া হয় । তাঁর উপর দায়িত্ব ছিল রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা ভোটের আগে কংগ্রেসের সংগঠন মজবুত করা । গুলাম নবি আজ়াদ দায়িত্ব নেওয়ার পর 2017 সালে উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা ভোটের লড়াইতে সমাজবাদী পার্টির হাত ধরেছিল কংগ্রেস । কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত ছিল ভুল, ভোটে কংগ্রেসের ভরাডুবি হয় । সম্প্রতি সোনিয়া গান্ধিকে চিঠি পাঠানোর বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা করার সময় উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসের প্রাক্তন প্রধান নির্মল খাতরি 2017 সালের বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসের ভরাডুবির প্রসঙ্গ তুলে গুলাম নবি আজ়াদের তীব্র সমালোচনা করেন । উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসের অন্যতম নেতা নসিব পাঠান দাবি করেছেন গুলাম নবি আজ়াদকে দল থেকে বহিষ্কার করা হোক ।
দলের অন্দরে এখন যা বলা হচ্ছে তা হল এই যে, কংগ্রেসের সভাপতি থেকে শুরু করে জেলাস্তরে সভাপতি বাছাই করার ক্ষেত্রে নির্বাচনের দাবিতে সোনিয়া গান্ধিকে বিক্ষুব্ধরা যে চিঠি লিখেছিলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেই দাবির পক্ষে নিজের সমর্থন জারি রাখা গুলাম নবি আজ়াদের পক্ষে হয়ত সহজ হবে না ।
যদিও কংগ্রেসের অন্তর্বর্তী সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধি ও রাহুল গান্ধি যিনি ফের দল পরিচলনায় সক্রিয় ভূমিকা নিতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে, তাঁরা দুজনেই গুলাম নবি আজ়াদকে আশ্বস্ত করেছেন এই বলে যে, যে বিষয়টি নিয়ে চিঠি লেখা হয়েছে, তা অবশ্যই বিবেচনা করা হবে । কিন্তু আগামীতে কংগ্রেসের অন্দরে নেতৃত্বের যদি সামান্যতম রদবদলও হয়, তাহলে হরিয়ানায় দলের নেতৃত্ব গুলাম নবি আজ়াদের বদলে সোনিয়া-রাহুল শিবিরের বিশ্বস্ত কারও হাতে তুলে দেওয়া হতে পারে । ঠিক যেমন, রাজস্থানে দলের নেতৃত্ব AICC-র ইন চার্জ হিসেবে রাহুল গান্ধির বিশ্বস্ত অজয় মাকেনের হাতে হঠাৎ তুলে দেওয়া হয়েছে । তাঁর আগে রাজস্থানে ওই পদে ছিলেন অবিনাশ পাণ্ডে, তাঁর আমলে গত জুলাইতে সেখানে কংগ্রেসের অন্দরে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল ।
গুলাম নবি আজ়াদ রাজ্যসভায় বিরোধী নেতা । তাই তাঁর মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে আর যে বিষয়টি নিয়ে দলের অন্দরে জোর চর্চা চলছে, তা হল এই বর্ষীয়ান নেতার মেয়াদ শেষের পর সেই পদের দায়িত্ব কংগ্রেস নেতৃত্ব কার হাতে তুলে দেবে । হিসেব মতো ওই পদ পাওয়া উচিত আনন্দ শর্মার । তিনি গুলাম নবি আজ়াদের ডেপুটি হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন এবং রাজ্যসভায় বিরোধী নেতার পদের স্বাভাবিক দাবিদার । কিন্তু এটাও ঘটনা যে, সোনিয়া গান্ধিকে যে বিক্ষুব্ধ নেতারা চিঠি পাঠিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে আনন্দ শর্মাও ছিলেন । তাই রাজ্যসভায় বিরোধী নেতার পদ পাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর সমস্যা হতে পারে বলেই মনে করছে দলের অন্দরের একাংশ । উল্লেখ্য, আনন্দ শর্মার রাজ্যসভার মেয়াদ শেষ হচ্ছে 2022 সালের এপ্রিলে ।
এই পরিস্থিতিতে রাজ্যসভায় বিরোধী নেতা হিসেবে যাঁর নাম কংগ্রেসের অন্দরে বিশেষভাবে শোনা যাচ্ছে তিনি হলেন কর্নাটকের বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা মল্লিকার্জুন খাড়গে । তিনি চলতি বছরেই রাজ্যসভায় নির্বাচিত হয়েছেন । তাঁর মেয়াদ শেষ হবে 2026 সালে । মল্লিকার্জুন খাড়গে সোনিয়া গান্ধির বিশ্বস্ত । তা ছাড়া ওই 23 জন বিক্ষুব্ধ নেতার মধ্যে তাঁর নাম নেই । এই দলিত নেতা নয়বারের বিধায়ক ও দুইবারের লোকসভা সাংসদ । UPA সরকারের আমলে তিনি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সদস্যও ছিলেন । রাজ্যসভায় বিরোধী দলনেতা বাছাইয়ের সময় এই সমস্ত বিষয়গুলি মল্লিকার্জুন খাড়গের পক্ষেই যাবে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহলের একাংশ ।