আলমোড়া (উত্তরাখণ্ড), 30 জুন : ঐতিহাসিক শহর আলমোড়া দেশকে বহু খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব উপহার দিয়েছে ৷ যার মধ্যে রয়েছেন ভারতরত্ন গোবিন্দবল্লভ পন্থ এবং নৃত্য কিংবদন্তি উদয় শংকর । এই তালিকায় থাকবে শীলা আইরিন পন্থের নামও ৷ যিনি পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের বিবি হিসেবে 1947 থেকে 1951 পর্যন্ত পাকিস্তানের ফার্স্ট লেডি ছিলেন । বেগম রানা লিয়াকত আলি খান নামে পরিচিত আইরিন তাঁর অবদানের জন্য পেয়েছিলেন "নিশান-এ-ইমতিয়াজ" এবং "মাদার-এ-ওয়াতন" সম্মান ৷ যা পাকিস্তানের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ।
ড্যানিয়েল পন্থের কন্যা শীলার জন্ম 1905 সালে 13 ফেব্রুয়ারি, আলমোড়ার একটি কুমায়ুনি খ্রিস্টান পরিবারে । তাঁর ঠাকুর্দা খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন 1887 সালে । আলমোড়া ও নৈনিতালে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করার পর পরবর্তী পর্যায়ের শিক্ষার জন্য লখনউ যান তিনি ৷ সেখানে লালবাগ স্কুলে পড়াশোনা করেন । এরপর ইসাবেলা থোবার্ন কলেজ থেকে অর্থনীতি এবং ধর্মতত্ত্বে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন শীলা । তাঁর পৈতৃক বাড়িটি এখনও আলমোড়ার মেথডিস্ট চার্চের রক্ষণাবেক্ষণের আওতায় রয়েছে ৷ তাঁর ভাই নর্মান পন্থের পুত্রবধূ মীরা পন্থ এবং নাতি রাহুল পন্থ সেখানেই থাকেন । আইরিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে রাহুল জানালেন, বিয়ের পর কখনওই আলমোড়া আসেননি শীলা ৷ কিন্তু ভাই নর্মানকে নিয়মিত চিঠি লিখতেন ।
লিয়াকত এবং আইরিনের প্রথম দেখার ঘটনায় আলোকপাত করতে গিয়ে তাঁর পরিবার জানিয়েছে, আইরিন তখন কলেজে পড়তেন ৷ বিহারে বন্যাদুর্গত মানুষদের জন্য একটা চ্যারিটি শো-র আয়োজন করা হয়েছিল ৷ সেই শোয়ের টিকিট বিক্রির দায়িত্ব দেওয়া হয় আইরিনকে ৷ তার জন্য তিনি গিয়েছিলেন লখনউ অ্যাসেম্বলিতে ৷ যেখানে প্রথমবার আইরিন ও লিয়াকতের দেখা হয় । শুরুতে লিয়াকত টিকিট কিনতে রাজি ছিলেন না ৷ কিন্তু অনেক জোরাজুরির পর তিনি রাজি হন । আইরিন তাঁকে অন্তত দু'টো টিকিট কিনতে বলেন । জবাবে লিয়াকত বলেন যে চ্যারিটি শো-তে তাঁকে সঙ্গ দেওয়ার মতো কেউ নেই । শুনে আইরিন নিজে তাঁকে সঙ্গ দেওয়ার কথা বলেছিলেন ।
প্রায় দেড় বছর আইরিন দিল্লির ইন্দ্রপ্রস্থ কলেজে অধ্যাপনা করেন । লিয়াকত উত্তরপ্রদেশ বিধানসভার সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন জেনে আইরিন তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে একটি চিঠি পাঠান । জবাবে লিয়াকত চিঠিতে তাঁকে কনট প্লেসের ওয়েঙ্গার রেস্তরাঁয় চা খেতে ডাকেন । পরপর কয়েকবার সাক্ষাতের পর তাঁদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে ৷ যা নিকাহয় পরিণতি পায় । লিয়াকত পরে পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন । তুতো বোন জাহান আরা বেগমের সঙ্গে আগের বিবাহ থেকে একটি পুত্রসন্তান ছিল লিয়াকতের । পরে 1933 সালের 16 এপ্রিল তিনি আইরিনকে বিয়ে করেন ৷ বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছিল দিল্লির সবথেকে ব্যয়বহুল ভেনু, মেন্ডেজ হোটেলে । এই মেন্ডেজ হোটেল এখন "ওবেরয় মেন্ডেজ" বলে পরিচিত ৷ 1994 সালে হোটেলটিকে হেরিটেজের মর্যাদা দেওয়া হয় ।
বিয়ের পর আইরিন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন ৷ তাঁর নাম বদলে হয় গুল-এ-রানা । লিয়াকত আলি খানের বিবি হিসেবে আইরিন শুধু ইতিহাসের সাক্ষীই থাকেননি, তার অংশও হয়েছেন । 1947 সালের অগাস্টে যখন লিয়াকত পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বসলেন তখন গুল-এ-রানা তাঁর শওহর ও দুই ছেলে আশরফ ও আকবরের সঙ্গে দিল্লি থেকে করাচির বিমান ধরেন । লিয়াকত তাঁকে সংখ্যালঘু ও নারী বিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে তাঁর ক্যাবিনেটে অন্তর্ভুক্ত করে নেন । পরে 1951 সালের 16 অক্টোবর রাওয়ালপিণ্ডির কম্পানিবাগে একটি জনসভায় বক্তৃতা দেওয়ার সময় লিয়াকতকে হত্যা করা হয় । শওহরের মৃত্যুর পরও আইরিন পাকিস্তানেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ৷ সেখানে থেকেই নারীদের অধিকারের জন্য শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত লড়ে গেছেন । তিনি রক্ষণশীল শক্তির বিরুদ্ধেও সরব হয়েছিলেন এবং স্বৈরাচারী জেনেরাল মহম্মদ জিয়া-উল-হকের ইসলামিক আইন চাপিয়ে দেওয়ার তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন । জুলফিকার আলি ভুট্টোর ফাঁসির পর আইরিন সেনা শাসনের বিরুদ্ধে প্রচার করেন । তাঁকে পরে প্রথমে নেদারল্যান্ডস ও পরে ইট্যালিতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত করা হয় । 1990 সালের 13 জুন শীলা আইরিন পন্থ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন । তাঁর 85 বছরের জীবনে তিনি 43 বছর ভারতে এবং প্রায় ততটাই পাকিস্তানে কাটিয়েছেন । 1947-এর পর তিনবার ভারতে এলেও আর কখনও আলমোড়ায় যাননি আইরিন ।
স্বীকৃতি ও সম্মান: আইরিনকে পাকিস্তানে "মাদার-এ-ওয়াতন" উপাধি দেওয়া হয় । জুলফিকার আলি ভুট্টো তাঁকে ক্যাবিনেট মন্ত্রী করেছিলেন । তাঁকে সিন্ধের গভর্নরের পদও দেওয়া হয় । আইরিন ছিলেন করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা উপাচার্য । তিনি নেদারল্যান্ডস, ইট্যালি ও তিউনিশিয়ায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব সামলেছেন ।
1. রাষ্ট্রসঙ্ঘের মানবাধিকার পুরস্কার ৷
2. ইট্যালির গ্র্যান্ড নাইট ক্রস অফ দ্য অর্ডার অফ মেরিট ৷
3. তুরস্কের উইমেনস অ্যাসোসিয়েশনের তরফে উওম্যান অফ দ্য ওয়ার্ল্ড ৷
4. গ্র্যান্ড ক্রস অফ অরেঞ্জ নাসাউ ৷
5. নিশান-ই-ইমতিয়াজ ৷
6. মাদার অফ পাকিস্তান ৷
7. জেন অ্যাডামস পদক ৷
8. উওম্যান অফ অ্যাচিভমেন্ট পদক ৷