দিল্লি, 11 নভেম্বর : 31 অক্টোবর 2019 । সেনসেক্স ইতিহাসের সর্বোচ্চ 40,392 পয়েন্টে পৌঁছানোয় উল্লসিত দেশের প্রিন্ট ও বৈদ্যুতিন মিডিয়া । বিনিয়োগকারীরাও উল্লসিত । কিন্তু এই বিষয়টি ভারতীয় অর্থনীতির অন্য একটি দিকও তুলে ধরে । শেয়ার বাজারের এই বিপুল উত্থানের আনন্দে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মিডিয়া সেকথাটিও ভুলে গিয়েছে । সেনসেক্সের এই রেকর্ড ছোঁয়ার আগের দিন 30 অক্টোবর ভারতের অন্যতম অর্থনৈতিক সংস্থা জে এম ফিনান্সিয়াল একটি রিপোর্ট পেশ করে । দেশের 13 টি রাজ্যের উপর করা একটি সমীক্ষার ফলাফলই এই রিপোর্টে বলা হয় । সেই রিপোর্ট অনুযায়ী, খাদ্যের কম দামের জন্য দেশের কৃষিক্ষেত্রে আয় কমেছে । ফলে চাষিদের আয় দ্বিগুণ করার যে ঘোষণা করেছে সরকার তা আরও কঠিন হবে বলেই মনে করা হচ্ছে । এই রিপোর্ট প্রকাশের দিন কয়েক আগে দেশের ফার্স্ট মুভিং কনজ়িউমার গুডস (FMCG)-এর বাজারে বেশ খানিকটা মন্দা দেখা দিয়েছিল । দেখা যায়, গ্রামীণ ভারতে বছর খানেক আগে যে বৃদ্ধি ছিল প্রায় 16 শতাংশ তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র 2 শতাংশে । সাত বছরে এই প্রথম FMCG-এর গ্রামীণ বৃদ্ধি শহরের বৃদ্ধির চেয়ে কম হল ।
এই দুটি বিষয় দেশের বর্তমান গ্রামীণ অর্থনীতির ভয়াবহ অবস্থাকেই তুলে ধরছে । প্রথম ঘটনা থেকে গ্রামের সার্বিক উপার্জনের করুণ অবস্থা সামনে আনছে । অন্যদিকে দ্বিতীয় ঘটনা থেকে গ্রামে চাহিদার হ্রাস পাওয়ার ছবিটা বোঝা যাচ্ছে । এই চাহিদা হ্রাস পাওয়ার অর্থ গ্রামীণ উপার্জন ও উন্নতি নিম্নমুখী হওয়া । দেশে যখন আর্থিক মন্দা চলছে তখন এই অবস্থা খুবই প্রাসঙ্গিক বলে মনে হতে পারে । কিন্তু দেশ যখনই এর আগে এই ধরনের আর্থিক মন্দার কবলে পড়েছে তখনই গ্রামই চাহিদা বাড়িয়ে বিপদ থেকে দেশকে উদ্ধার করেছে । গত 10 বছরে দেশের বাজারে যে বিপুল পরিমাণে দৈনন্দিন ব্র্যান্ডেড জিনিসের চাহিদা বেড়েছে তার অনেকটাই কৃতিত্ব দাবি করতে পারে গ্রামীণ ভারত । এই গ্রামীণ ভারতে 80 কোটিরও বেশি মানুষ বসবাস করেন । দেশের মোট FMCG পণ্য বিক্রির 36 শতাংশের জোগান দেয় এই গ্রাম । দেশের অর্থনীতিতে গ্রামের গুরুত্ব ও অবদান এই একটি পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যাচ্ছে । কিন্তু ঠিক কী কারণে গ্রামীণ অর্থনীতি এতটা পিছিয়ে পড়েছে? এর জন্য গ্রামীণ অর্থনীতির গভীরে ঢুকে পর্যালোচনা করতে হবে ।
গ্রামীণ ভারতের উন্নতি কেন ব্যাহত হচ্ছে?
গ্রামীণ ভারতের উন্নতি ব্যাহত হওয়ার পিছনে একাধিক কারণ রয়েছে, যা একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত । প্রথমত, গ্রামের ক্রমহ্রাসমান আয় । তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কর্মসংস্থানের অভাব ও বৃষ্টিপাতের অসম বণ্টন । আয় কমে যাওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই চাহিদা হ্রাস পেয়েছে ।
পাশাপাশি, গ্রামীণ ভারতে ছোটো ব্যবসায়ী ও চাষিদের মধ্যে রয়েছে নগদ অর্থের প্রবল অভাব । সঙ্কট কাটাতে ভারতীয় রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক নিজেদের বিভিন্ন নীতিতে একাধিক পরিবর্তন আনলেও তার সুফল এখনও পুরোপুরি প্রাপ্ত হয়নি । ফলে অর্থনীতির অচলাবস্থা এখনও পুরোপুরি কাটেনি । উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, গত দুই বছরে দেশের ব্যাঙ্কগুলির ঋণ দেওয়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে 8.8 শতাংশ যা এই সময়কালের মধ্যে সবচেয়ে কম । অ-ব্যাঙ্ক আর্থিক সংস্থাগুলিও (NBFCs) গ্রাম ও ছোটো সংস্থাগুলিকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে । এর ফলে চাষি বা ছোটো ব্যবসায়ীদের মধ্যে নগদের জোগানের অভাব থেকেই যাচ্ছে । তারই প্রভাব পড়ছে বাজারে । ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতি । যার ফলে গত সাত বছরে এই প্রথম বার শহুরে অর্থনীতির চেয়ে গ্রামীণ অর্থনীতির বৃ্দ্ধি কম হচ্ছে ।
গ্রামীণ উন্নতির পুনরুজ্জীবন
গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নতি নিয়ে কথা হলেই অনিবার্যভাবে চলে আসে চাষবাসের প্রসঙ্গ । দেশের মোট জনসংখ্যার 61 শতাংশ গ্রামের বাসিন্দা আর দেশের শ্রমশক্তির 50 শতাংশ চাষ ও তার আনুষঙ্গিক কার্যকলাপের উপর নির্ভরশীল । তাই গ্রামের উন্নতি করতে হলে কৃষির উন্নতি আবশ্যক । গ্রামের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে চাহিদা ও জোগানের মতো প্রাথমিক জিনিসের উপর প্রথমেই নজর দিতে হবে । চাহিদার বৃদ্ধি ঘটাতে সবার আগে প্রয়োজন নগদের জোগান বাড়ানো । এক্ষেত্রে ব্যাঙ্কগুলি যেন গ্রামে কৃষিক্ষেত্র ও ছোট ব্যবসায়ীদের কম সুদে ঋণ দিতে তৈরি থাকে তা সরকারকে দেখতে হবে ।
প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে গ্রামের চাহিদার সমস্যাটি সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে হবে । তারপর ধীরে ধীরে চেষ্টা করতে হবে সেই চাহিদা বাড়ানোর । এই চাহিদা বাড়ানোর প্রাথমিক দাওয়াই হিসেবে এই সব এলাকায় সরকারি খরচের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলে থাকেন অর্থনীতিবিদরা । এর ফলে গ্রামে আয় বাড়বে ও তার হাত ধরে চাহিদাও বাড়বে । তবে এক্ষেত্রে একটি তথ্য দেওয়া প্রয়োজন । এই মুহূর্তে সরকার গ্রামগুলিতে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা বিভিন্ন আয় সহায়তা প্রকল্পে খরচ করছে । এর মানে এই নয় যে এই ধরনের প্রকল্পগুলি বন্ধ করে দেওয়া উচিত । এর থেকে এটা প্রমাণ হয় যে আর্থিক মন্দা কাটাতে শুধুমাত্র সরকারি খরচ বাড়ালেই সমাধান মিলবে না । এগুলি ছাড়াও আরও কিছু পরিকল্পনা করতে হবে যা এই সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান করতে পারে ।
এক্ষেত্রে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলিকে এগিয়ে এসে পদক্ষেপ করতে হবে । খুঁজে বের করতে হবে সেই সব কারণগুলিকে যেগুলি দেশের কৃষিক্ষেত্রকে পঙ্গু করে তুলছে । খামারগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়াতে হবে । কৃষিক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে । এগুলির জন্য প্রয়োজনে বিশেষ খাতের ব্যবস্থা করতে হবে । অন্যদিকে কৃষিজ পরিকাঠামো ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণে বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়াতে হবে । ফলে এইসব ক্ষেত্রে চাকরির সুযোগ বাড়বে । পাশাপাশি গ্রামে উৎপন্ন জিনিসের চাহিদা যেন বাড়ে সে দিকেও খেয়াল রাখতে হবে । এর সঙ্গে কৃষিজ বাজারগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করে চাষিরা যেন তাদের উৎপাদিত দ্রব্যের সঠিক মূল্য পান তারও ব্যবস্থা করতে হবে । এই সব কাজগুলি একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে করতে হবে ।
আর একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে । কৃষিক্ষেত্রে চাষির খরচের তুলনায় চাষি তার শ্রমের মূল্য পাচ্ছেন না । সেক্ষেত্রে শুধুমাত্র চাষিদের আয় দ্বিগুণ করলে সব সমস্যার সমাধান হবে না । সমস্যার সমাধানে বিনিয়োগের পাশাপাশি খরচের পরিমাণও যাতে না বাড়ে সে দিকে নজর দিতে হবে । এর ফলে গ্রামের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়বে । গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নতি হবে । আর গ্রামের অর্থনীতির উন্নতি হলেই দেশের অর্থনীতির উন্নতিও হবে । এখন শুধু প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছার ।