কোভি়ড-১৯ যখন ভারতে পা রেখেছে, তখন কেন্দ্র ও রাজ্যসরকারগুলো একসঙ্গে এটা মহামারীতে পরিণত হওয়া থেকে আটকাতে চাইছে । নিশ্চিত করতে চাইছে, যাতে না হয়। দেশজুড়ে জনতা কার্ফু সফল হওয়ার পরেই, তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্রপ্রদেশ সহ বেশ কয়েকটি রাজ্যের সরকার আন্তঃরাজ্য সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে, গণপরিবহণ থামিয়ে দিয়েছে, এবং নাগরিকদের বাড়িতে থাকার অনুরোধ জানিয়েছে। কেন্দ্র দেশের ৮২টি করোনা আক্রান্ত জেলায় সম্পূর্ণ লক়ডাউন দাবি করলেও, মানুষের উদাসীন আচরণ উদ্বেগজনক। প্রধানমন্ত্রী মোদি পরামর্শ দিয়েছেন, যে লকডাউনের নিয়ম ভাঙা হলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থাও নেওয়া উচিত। এই সমস্ত লকডাউন হল সেই ম্যারাথনের প্রথম কয়েকটি ধাপ, যা করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমাদের মেনে নিতেই হবে। ইতালির মতো দেশ, যাঁরা সেলফ-আইসোলেশনকে গুরুত্ব দেয়নি, এখন ভয়ে কাঁপছে। চিনের ইউহান থেকে উৎপত্তি হওয়া নোভেল করোনাভাইরাস তাৎক্ষণিকভাবে কয়েক হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। বিদেশ থেকে আসা মানুষদের সঙ্গে ঢুকে পড়ার পর, ভারতে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ধাপে রয়েছে। সামাজিক স্তরে সংক্রমণ আটকাতে গেলে, সরকারের নিয়ম অনুযায়ী নাগরিকদের নিজেদের ঘরবন্দি করে রাখতেই হবে। যেখানে ভারতের জনস্বাস্থ্যের অবস্থা কারও অজানা নয়, সেখানে গ্রামগুলিতে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া আটকাতে দ্রুত ব্যবস্থা নিতেই হবে। গ্রামগুলির সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া আর সমস্ত গ্রামে লকডাউন কঠোরভাবে কার্যকর করার ওপরেই দেশের নিরাপত্তা নির্ভর করছে। গ্রামাঞ্চলে, যেখানে দেশের জনসংখ্যার ৬৬ শতাংশ বাস করে, তা রক্ষার দায়িত্ব সরকার এবং নাগরিকদেরই।
মারণ ভাইরাস যখন শিকার খুঁজে বেড়াচ্ছে, তখন কোয়ারেন্টিন কোনও শাস্তি নয়, বরং রক্ষাকবচ। যিনি কোয়ারেন্টিন এড়িয়ে যাচ্ছেন, তিনি আরও কয়েকশো লোকের মধ্যে সংক্রমণ ছড়াতে পারেন। উপসর্গহীন বাহকদের থেকে সংক্রমণ আটকাতে, কোয়ারেন্টিন হল বাধ্যতামূলক। চিনে প্রথম ১০০০ জনের নোভে়ল করোনায় আক্রান্ত হতে সময় লেগেছিল ৬ দিন। পরের চারদিনে সেটা ৫০০০ এবং তার পরের তিনদিনে সেটা ১০ হাজারে পৌঁছে যায়। আমেরিকা এবং স্পেনে প্রথম ১০ হাজার জনের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়েছিল মাত্র দুদিনে। এই সংখ্যাই প্রমাণ করে দিচ্ছে যে সরকার ও নাগরিকদের পক্ষে শিথিলতার কোনও জায়গাই নেই। ২৩ জানুয়ারি হুবেই প্রবেশকে কোয়ারেন্টিন করতে চিনের প্রচেষ্টায় ভাইরাস সংক্রমণ উহানের মধ্যেই আটকে রাখা গেছে। কোরোনার ভরকেন্দ্র উহানে মৃত্যুর হার ছিল ৩.১ শতাংশ, যেখানে বাকি অঞ্চলে তা ছিল ০.১৬ শতাংশ। এখানেই বোঝা যায়, যে, কোয়ারেন্টিনের কৌশল কতটা কার্যকরী। যেভাবে চিন ব্যারিকেড তৈরি করে প্রতিবেশী শহর ও গ্রামগুলোতে যাতায়াত বন্ধ করেছে, তা অনুপ্রেরণার যোগ্য। একই কৌশল অনুসরণ করা হচ্ছে আমেরিকার আলাস্কা প্রদেশেও। এমনকী ইতালিও, যেখানে ৬০০০ মানুষ মারা গেছেন, তারাও অভ্যন্তরীণ যাতায়াতের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে। ভারতকে এই আসন্ন করোনা আক্রমণ থেকে বাঁচাতে গেলে, গ্রামগুলোকে প্রথমেই নিরাপদে রাখতে হবে।
কেউ জানে না, যে কোভিড-১৯-এর ভ্যাকসিন কবে আবিষ্কার হবে। এই মুহূর্তে, সংক্রমণের নির্দিষ্ট কোনও চিকিৎসা নেই। এই সময় সরকারগুলোকে স্বাস্থ্যপরিষেবা বিপর্যয় আটকাতে, লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনরক্ষা করতে হবে। গ্রাম এবং ছোট শহরগুলোকে সেলফ আইসোলেশনে যেতে হবে। স্প্যানিশ ফ্লুতে ভারতে মৃত্যুর সংখ্যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মৃত্যুর সংখ্যার থেকেও বেশি ছিল। এটাই সময়, যখন সরকার ও নাগরিকদের একই পক্ষে থাকতে হবে। এখানে মতানৈক্যের কোনও জায়গা নেই। লকডাউন থাকা গ্রাম ও শহরগুলোতে অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রী যাতে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে পৌঁছতে থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে কেন্দ্র ও রাজ্যের সরকারগুলোকে। দেশের ৫০ কোটি শ্রমিকের মধ্যে, ৮৫ শতাংশই সংগঠিত ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত। গ্রামাঞ্চলে দিনমজুরের সংখ্যাও বেশি। সরকারগুলোর একমাত্র লক্ষ্য হতে হবে তাঁদের প্রয়োজনের দিকটা দেখা, এবং জিনিসপত্রের আকাল প্রতিরোধ করা। যদি ভারতের গ্রামগুলোকে কোভিড-১৯ মহামারী থেকে বাঁচানো যায়, ভারত প্রায় সাফল্যের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাবে। শুধুমাত্র তখনই দেশ কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে সম্মিলিত লড়াই জিতবে, যখন প্রতিটি নাগরিক একসঙ্গে কাজ করবেন।