কোভিড-19 প্যানডেমিকের সময় লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক তাঁদের বাড়ির পথ ধরেছিলেন সেই সমস্ত শহর থেকে, যেখানে তাঁরা জীবন যাপনের জন্য এসেছিলেন ৷ খাবার ও জলের আশায় তাঁদের বাড়িতে ফেরার পথে শহর থেকে কয়েকশো কিলোমিটার হাঁটতে দেখে অনেকের চোখে জল এসেছিল ৷ কোরোনা আমাদের সামনে তুলে ধরল যে, গরিব ঠিকা শ্রমিকদের বেঁচে থাকার জন্য শহরের দিকে ঠেলে না দিয়ে তাঁদের নিজেদের অঞ্চলেই জীবন যাপনের ব্যবস্থা করে দেওয়া উচিত ৷ এই পরিস্থিতিতে যখন ভালো জীবন যাপন এবং কাজ গ্রামে তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না, তখন লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতি বছর দূরে চলে যাচ্ছেন শুধুমাত্র নিজেদের রুজিরুটির খোঁজে ৷ যখন শুধুমাত্র শহরেই এই সুবিধাগুলি পাওয়া যাচ্ছে, তখন কি গান্ধিজির গ্রাম স্বরাজের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হচ্ছে ৷ 60 লক্ষেরও বেশি মানুষ যাঁরা গ্রামে বসবাস করেন, তাঁদের স্বাধীনভাবে বাঁচতে দিয়ে এবং আর্থিকভাবে স্বনির্ভর ও স্বক্ষমতা দেওয়ার জন্য প্রযুক্তি একটা বড় সাহায্যকারী হয়ে উঠতে পারে ৷ জনশিক্ষা মঞ্চের (জন ভিগনান ভেদিকা) সাহায্যে সরকার ও বেসরকারি অংশিদারিত্বে এমন কিছু একটা তৈরি করা উচিত যাতে গ্রামীণ এলাকার মানুষদের জন্য কার্যকরী হয়ে ওঠে ৷ ভারতে গত দশ বছরে গ্রাম থেকে শহরের দিকে চলে যাওয়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে ৷ একাধিক হিসেবে জানা গিয়েছে, গত কয়েক বছরে 7.2 কোটি থেকে 11 কোটি মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে গিয়েছেন ৷ এই হিসেব অনুযায়ী ভারতের অবস্থান চিনের ঠিক পরে ৷ চিনেই পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ৷
গান্ধেয় গ্রাম স্বরাজ
গান্ধীজির গ্রাম স্বরাজের আদর্শ অনুযায়ী, গ্রামের বিকাশের জন্য নতুন মডেলে গ্রামগুলিকে আর্থিকভাবে স্বনির্ভর করে গড়ে তুলতে হবে ৷ দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরে আসার পর মহাত্মা গান্ধি চম্পারণ (1917), সেভাগ্রাম (1920) এবং ওয়ার্ধার মতো গ্রামীণ আন্দোলনগুলিতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ৷ এর প্রধান লক্ষ্য ছিল গ্রামীণ স্তরে রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ করা এবং অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য গ্রামের পরিবেশকে অনুকূল করে গড়ে তোলা ও পরিকাঠামো গড়ে তোলার সময় সামাজিক সাম্যবাদ বজায় রাখা ৷ স্বনির্ভর এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভাবে সমান অধিকার আছে এমন গ্রামের উর্বর জমি পর্যন্ত গণতন্ত্রের শিকড় পৌঁছে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধি ৷ গ্রাম স্বরাজ কেবল তখনই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে যখন প্রতিটি গ্রাম পৃথক গণতন্ত্রের সত্তা হিসাবে কাজ করে । এটি নিজেই একটি স্বাধীন দেশ, যা নিজেদের প্রয়োজন এবং চাহিদাগুলি পূরণ করার জন্য প্রতিবেশি গ্রামগুলির সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করে । প্রতিটি গ্রামকে সম্পদের দিক থেকে স্বনির্ভর এবং পারষ্পরিক বোঝাপড়ার বৈশিষ্ট্যের উপর বেঁচে থাকতে হবে , এর উপরই জোর দিয়েছিলেন গান্ধিজি ৷ গ্রাম স্বরাজ্যের অর্থ হল সেই গ্রাম যেখানে সেখানকার বাসিন্দারা স্থানীয়ভাবে কাজ করেন এবং উচ্চমানের উৎপাদনশীলতার সঙ্গে ভালো আয় করেন । গান্ধিজি বুঝতে পেরেছিলেন যে প্রযুক্তিই হল গ্রামীণ উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি । বেশিরভাগ মানুষ জানেনই না তিনি তৎকালীন ব্রিটিশ এবং ভারতীয় সংবাদপত্রগুলিতে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন যে, যদি কেউ ঐতিহ্যবাহী চরকাকে প্রযুক্তিগত সুক্ষতার সঙ্গে তৈরি করতে পারেন, তাহলে তাঁকে তিনি এক লক্ষ টাকা পুরস্কার দেবেন (যা বর্তমানে 2.5 কোটি টাকার সমান !) ৷
ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি, এপিজে আবদুল কালাম একটি উন্নয়নমূলক প্রকল্পের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, যার মাধ্যমে গ্রামগুলিকে আধুনিক সময়ের সুযোগ সুবিধা সরবরাহ করা যেতে পারে । তিনি বলেছিলেন যে 50 থেকে 100 টি গ্রামকে যদি একটি কমপ্লেক্সের আকারে গড়ে তোলা যায়, তাহলে যৌথ ব্যবস্থা এবং বাজার তৈরি করা যেতে পারে । এই কমপ্লেক্সটিকে ‘পুরা কমপ্লেক্স’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছিল । কালাম প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে প্রযুক্তির মাধ্যমে এই সমস্ত কমপ্লেক্সগুলির সমস্ত চাহিদাকে একসঙ্গে যোগ করার জন্য , এরমধ্যে রাস্তাঘাট, আবাসন, থাকার ব্যবস্থা, স্টোরেজের সুবিধা, বিজ্ঞান এবং অর্থনীতির মতো বিষয়গুলি থাকবে ৷ যেগুলিকে এক ছাতার তলায় এনে গ্রামের বাসিন্দাদের একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে এবং পারস্পরিক উন্নতিতে সাহায্য করার কাজে ব্যবহার করতে পারবে ৷ এই সংযোগগুলির সাহায্যে গ্রাম এবং শহরগুলি সহজেই উন্নয়নের পথে হাঁটতে পারবে । কালাম 2004 সালের জানুয়ারিতে চণ্ডীগড়ে অনুষ্ঠিত ভারতীয় জাতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের 90 তম কংগ্রেসের সামনে এই মডেলটি উপস্থাপন করেছিলেন । তিনি ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, স্বনির্ভর গ্রামের ভিত্তিকে শক্তিশালীভাবে স্থাপন করতে পারলে ভারত অর্থনৈতিকভাবে উচ্চতর শিখরে পৌঁছতে সক্ষম হবে । এই পুরা প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল 30 কিলোমিটার এলাকার মধ্যে কয়েকটি গ্রামকে সংযুক্ত করতে পারবে এবং একটি বাসে কমপ্লেক্সের মধ্যে থাকা সমস্ত গ্রামে যাওয়া যাবে এমন একটি রিং রোড তৈরি করা । এর মাধ্যমে শহরগুলির উপর চাপ কমে যাবে এবং পুরা গ্রাম কমপ্লেক্সগুলির মধ্যে আবাসিক সুবিধার বিকাশ হবে । এর ফলে গ্রামগুলির মধ্যে স্থানান্তর বৃদ্ধি পাবে এবং গ্রাম থেকে শহরে স্থানান্তর কমে যাবে । কালাম প্রস্তাব করেছিলেন, এই ধরনের উচ্চাভিলাষী প্রকল্পটি বাস্তবায়িত করতে হলে প্রত্যেক কমপ্লেক্স পিছু 130 কোটি টাকা করে খরচ করতে হবে ৷ এভাবে সাত হাজার পুরা কমপ্লেক্স সরকারি ও বেসরকারি অংশিদারিত্বে তৈরি করতে হবে ৷ কালাম দীর্ঘদিন ধরে পুরা গ্রাম কমপ্লেক্সের শহরগুলিতে উচ্চমানের জীবন যাত্রার ব্যবস্থা করার চেষ্টা করেছেন ।
মানবিক মডেল
নানাজি দেশমুখ স্বাবলম্বী গ্রাম তৈরি করার জন্য একটি সম্পূর্ণ মানবিক মডেল গড়ে তুলেছিলেন ৷ দেশমুখ এই মডেলটি দেশের 500টি গ্রামে বাস্তবায়িত করেছিলেন ৷ এর মধ্যে বিশেষত উল্লেখযোগ্য মধ্যপ্রদেশের চিত্রকূট অঞ্চল ৷ এই মডেলের অবিচ্ছেদ্য অংশ হল বেকারত্ব মুক্ত গ্রাম তৈরি করা, দারিদ্র দূরীকরণ, স্থানীয়ভাবে আইনী বিরোধ নিষ্পত্তি করা, বিধবাদের আবার বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা ৷ দেশমুখের মডেল গ্রামগুলিকে কমপ্লেক্সে পরিণত করার এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষামূলক সুযোগ সুবিধা তৈরির প্রস্তাব দেয় । এই মডেলটিতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারকে ব্যাপক ভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে । বর্তমানে আর্টিফিসিয়াল ইন্টালিজেন্স ও ইন্টারনেট কৃষিক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য ব্যাপকভাবে সারা বিশ্বে ব্যবহার করা হয় ৷ এই প্রযুক্তিগুলি আমাদের কৃষকদের সারা বিশ্বের বাজারে ফসলের দামের বিষয়ে জানতে সাহায্য করে ৷ বিদেশে চাষবাসে প্রয়োগ করা হচ্ছে, এমন আধুনিক পদ্ধতি সম্পর্কে আমাদের কৃষকদের তথ্য সরবরাহ করে । এর মাধ্যমে কৃষকরা আরও ভালো ফলন এবং বেশি আয়ের বিষয়টি সুনিশ্চিত করতে পারে ৷ দেশমুখ মডেল ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের ক্ষমতায়নের জন্য নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত 10 হাজার কৃষি উৎপাদক সমিতির কর্মসূচির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ । গান্ধি, কালাম এবং দেশমুখের গ্রামীণ উন্নয়নের স্বপ্নের বাস্তবায়নের জন্য তহবিল বাড়াতে ‘আত্ম-নির্ভর’ বন্ড ছাড়ার বিষয়ে কেন্দ্রের বিবেচনা করা উচিত । বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলি অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে যে ঋণ দেয়, তার একটা অংশ অবশ্যই বন্ডগুলি কেনার জন্য ব্যয় করতে হবে । আমাদের যুবদের একেবারে ছাত্রাবস্থা থেকে গ্রামের উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণের জন্য প্রস্তুত করা দরকার । ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিক্যাল এবং বিজনেস স্কুলগুলির পাঠ্যক্রম সেই অনুযায়ী তৈরি করতে হবে । পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তির প্রয়োগ করতে হবে গ্রামে ৷
মহান নেতাদের দেখিয়ে যাওয়া পথে চলছি
ভারতে প্রতি চারজন শ্রমিকের মধ্যে একজন পরিযায়ী, যিনি জীবিকার সন্ধানে নিজের গ্রাম বা শহর থেকে অন্য শহরে চলে যান ৷ কোরোনা সংকট বিশ্ববাসীর কাছে দেখিয়ে দিয়েছে যে, কীভাবে প্রতিদিন পরিযায়ী শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান আরও খারাপ হচ্ছে । অনুমান করা হচ্ছে, লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক নিজেদের বাড়ি ফিরে এসেছেন ৷ তাঁদের সাহায্যের জন্য কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারগুলির প্রচেষ্টা তাঁদের কোনওরকম সহায়তা করছে বলে মনে হয় না । এটা অনেকটা সমুদ্রে জল দেওয়ার মতো । রোজকার রুজিরুটির জন্য মানুষ যাতে শহরে স্থানান্তরিত না হয়, তার জন্য অবিলম্বে পদক্ষেপ করা উচিত । তখনই এই লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব, যখন গ্রামগুলি অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে । বর্তমান সঙ্কটকে অবশ্যই একটি সুযোগে রূপান্তরিত করতে হবে এবং জরুরি ভিত্তিতে নতুন উন্নয়নের মডেল তৈরি করা উচিত । সৌভাগ্যবশত, এই ধরনের একাধিক বিকল্প মডেল ইতিমধ্যে আমাদের অনেক মহান জাতীয় নেতা আমাদের কাছে উপস্থাপন করে গিয়েছেন । মহাত্মা গান্ধি, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আবদুল কালাম এবং সমাজতান্ত্রিক নেতা নানজি দেশমুখের মতো দেশপ্রেমিক দ্বারা প্রস্তাবিত গ্রামীণ উন্নয়নের এই মডেলগুলি সহজেই গ্রহণ করা যেতে পারে ৷