একটা সময় ছিল, যখন আমরা কলের মিস্ত্রি বা বাড়ির প্রয়োজনে ইলেকট্রিশিয়ান ডাকতে রাস্তার মোড়ে যেতাম । আর এখন এই কাজের জন্য আমরা নির্ভর করি অ্যাপের উপর । আর্বান ক্ল্যাপ, জাস্ট ডায়াল বা সুলেখা অনলাইনের মতো অ্যাপের মাধ্যমে যোগাযোগ করা হলে যে কোনও পেশাদার মিস্ত্রি একেবারে আপনার বাড়িতে এসে উপস্থিত হবেন । এমনকী, ছুতোর বা পরিচারকও আজকাল অনলাইনে মেলে । আগেকার দিনে কোথাও যাওয়ার প্রয়োজনে ট্র্যাভেল এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাদের তরফে ড্রাইভার ও গাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হত । আর এখন এই কাজ আমরা ওলা বা উবারের মতো অ্যাপের সাহায্যে সহজেই করে ফেলতে পারি । সুইগি বা জ়োম্যাটো অর্ডার দেওয়ার কিছু ক্ষণের মধ্যেই আমাদের কাছে খাবার পৌঁছে দিচ্ছে । এই সব কিছু সম্ভব হচ্ছে শুধুমাত্র ইন্টারনেটের বিপুল উন্নতির জন্য । অ্যামেরিকায় যাঁরা কিছু সময়ের জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্মে কাজ করেন, তাঁদের গিগ শ্রমিক বলা হয় । সরবরাহ ও খাদ্য শিল্পে আমাদের দেশেও এই গিগ শ্রমিকদের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে । সুইগির মতো বিশাল মাপের খাদ্য সরবরাহের অনলাইন সংস্থা ইতিমধ্যেই 2 লাখ 10 হাজার খাদ্য সরবরাহকারী কর্মী নিয়োগ করেছে । সম্প্রতি তারা জানিয়েছে যে, খুব শীঘ্রই তারা এই সংখ্যটা পাঁচ লাখে নিয়ে যাবে । একটি সমীক্ষা জানাচ্ছে, ওলা বা উবারের মতো বেসরকারি পরিবহণ সংস্থায় কাজ করেন প্রায় 15 লাখ চালক ।
শুধুমাত্র গাড়ি চালক, কলের মিস্ত্রি বা ছুতোরের মতো কম দক্ষ কর্মীই নন, অনলাইনে এখন সুদক্ষ পেশাদারদেরও চুক্তির ভিত্তিতে পাওয়া যায় । কোন প্রোজেক্ট কতটা দীর্ঘ তার উপর নির্ভর করে যে সমস্ত পেশাদাররা চুক্তির ভিত্তিতে কাজ করেন তাঁদের ফ্রিল্যান্সার বা ফ্লেক্সি ওয়ার্কার বলা হয় । TCS, ইনফোসিস, উইপ্রো বা HCL-এর মতো বড় তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা অ্যানালিটিক্স, অটোমেশন, কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার মতো ক্ষেত্রে এই ধরনের ফ্লেক্সি ওয়ার্কারদের ব্যবহার করছে । ইন্ডিয়ান স্টাফিং ফেডারেশন (ISF) জানাচ্ছে, তথ্যপ্রযুক্তি এবং তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর শিল্পে 2018 সালে কাজ করেছেন প্রায় 5 লাখ শ্রমিক । এই সংখ্যাটা 2021 সালে 7 লাখ 20 হাজারে গিয়ে পৌঁছোবে বলে মনে করা হচ্ছে । ISF জানাচ্ছে, সব ধরনের ক্ষেত্র মিলিয়ে ভারতে ফ্লেক্সি বা গিগ ওয়ার্কারের সংখ্যা প্রায় 33 লাখ । এই সংখ্যাটা 2021 সালে 61 লাখ হবে বলে মনে করা হচ্ছে । এই শ্রমিকদের প্রায় 55 শতাংশ কাজ করেন ব্যাঙ্কিং, বিমা এবং তথ্যপ্রযুক্তি ও তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর শিল্পে । ফ্লেক্সি বা ফ্রিল্যান্স কাজ তৈরির ক্ষেত্রে অ্যামেরিকা, চিন, ব্রাজ়িল ও জাপানের পরেই রয়েছে ভারত । ISF আশা করছে, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ, কর্নাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, গুজরাত এবং তেলাঙ্গানায় এই ধরনের শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে । একটি রিপোর্ট বলছে, দেশের 70 শতাংশ সংস্থা কোনও না কোনও সময় তাদের প্রোজেক্টের জন্য গিগ শ্রমিকদের পরিষেবা নিয়েছে ।
2018 সালে বিশ্বজুড়ে গিগ শ্রমিকদের মোট বাজার ছিল 20 হাজার 400 কোটি মার্কিন ডলারের । এর মধ্যে অর্ধেক বাজার দখল করে রয়েছে সরবরাহ সংস্থাগুলি । মনে করা হচ্ছে 2023 সালের মধ্যে এই বাজার 45 হাজার 500 কোটি মার্কিন ডলারের অর্থমূল্যে গিয়ে পৌঁছোবে । ভারতে ফ্রিল্যান্সার বাজার 2025 সালের মধ্যে 3 হাজার কোটি মার্কিন ডলারে (প্রায় 2 লাখ 10 হাজার কোটি টাকা) গিয়ে পৌঁছোবে বলে মনে করা হচ্ছে । আজ বিশ্বে প্রতি চার জন ফ্রিল্যান্সারের এক জন ভারতীয় । স্টার্টআপ সংস্কৃতির ফলে প্রতি বছরই গিগ শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েই চলেছে । কিন্তু এটা ভাবলে একেবারেই ভুল হবে যে, এই শ্রমিকরা কম বেতনে কাজ করেন । পেপ্যাল-এর একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, সঠিক কাজ জানা ফ্রিল্যান্সাররা বছরে 20 থেকে 60 লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করেন । তবে, সব গিগ শ্রমিকদের আয় এরকম বিপুল নয় । যাঁরা খুব ভালো প্রশিক্ষিত পেশাদার একমাত্র তাঁরাই এই বিপুল আয় করতে পারেন । মোবাইল ডেভেলপমেন্ট, ওয়েব ডিজ়াইনিং, ইন্টারনেট রিসার্চ এবং ডেটা এন্ট্রির মতো কাজে গিগ শ্রমিক নেওয়া হয় । কোনও কোনও পার্ট টাইম কাজের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত দক্ষতার চেয়েও বেশি দেখা হয় সৃজনশীলতা । চাকরির আবেদনপত্র, প্রবন্ধ লেখা, অনলাইনে গান বা নাচের ক্লাস করিয়েও আয় করা সম্ভব ।
এটা সত্যি যে, পূর্ণ সময়ের শ্রমিকদের মতো এই সব গিগ বা আংশিক সময়ের শ্রমিকদের কাজের নিরাপত্তা, নির্দিষ্ট আয় বা অবসরকালীন সুবিধা নেই । কিন্তু আজকের যুগে যেখানে একটা চাকরি খুঁজে পাওয়াই শ্রমসাধ্য হয়ে উঠেছে সেখানে বেকারদের কাছে কিছুটা আশার আলো দেখাচ্ছে এই সব চাকরি । এই কারণেই বহু অদক্ষ শ্রমিক গিগ পদ্ধতিতে কাজ খোঁজার চেষ্টা করছেন । এই কাজের সবচেয়ে বড় সুবিধা হল, সহজ শর্তে কাজ । ফ্রিল্যান্সারের প্রয়োজন অনুযায়ী তিনি কোনও কাজ যখন খুশি শুরু করতে পারেন বা বন্ধ করে দিতে পারেন । এই ধরনের গিগ অতিরিক্ত আয়ের রাস্তারও খোঁজ দেয় । সুইগি, জ়োম্যাটো, ওলা বা উবারে যাঁরা কাজ করেন তাঁদের বেশিরভাগই গ্রামের । তাঁরা তাঁদের আয় থেকে একটা অংশ বাঁচিয়ে পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দেন । কেউ আবার গাড়ি কিনে তা ওলা বা উবারকে লিজ়ে দিয়ে দিচ্ছেন । যদিও EMI এবং রক্ষণাবেক্ষণের খরচ বাদে খুব একটা বিশেষ লাভ হয় না । খুবই কম বেতনের অভিযোগে 2018 সালে ওলা এবং উবারের চালকরা আন্দোলন করেছিলেন ।
আয় বৃদ্ধির জন্য ফ্রিল্যান্সাররা অত্যধিক পরিমাণে চাকরি পরিবর্তন করেন । তাঁদের এই প্রচেষ্টাকে সাহায্য করছে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম । প্রায় সব ক্ষেত্রেই সেলস ও মার্কেটিংকে অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়া হয় । সেলসের জন্য প্রধানত কর্মী নিয়োগ করে ব্যাঙ্কিং, ফিনান্স, বিমা, FMCG এবং ওষুধ শিল্প । এদের বেশিরভাগেরই বয়স কম এবং তাঁরা বাইক বা স্কুটারে করে ঘুরে ঘুরে জিনিস বিক্রি করেন । 20 থেকে 29 বছর বয়সি এই সব তরুণ গিগের মাধ্যমে অন্য ক্ষেত্রের কাজে আকৃষ্ট হয়ে পড়ছেন । মনে করা হচ্ছে, 20 থেকে 45 শতাংশ সেলস কর্মী বহু দিন এই ক্ষেত্রে কাজ করে এখন গিগের মাধ্যমে অন্য কিছু করার চেষ্টা করছেন । ডিজিটাল শিক্ষা ও কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার উপর নির্ভর করে এখন বহু ডিজিটাল সংস্থা ফ্রিল্যান্সের মাধ্যমে কর্মী নিতে চাইছে । 2018 সালে বাজারে আসা হ্যালো ভেরিফাই সংস্থা জানিয়েছে যে, তারা 110টি সংস্থার 50 লাখ আবেদন খতিয়ে দেখেছে । এই সব সংস্থার মধ্যে রয়েছে ওলা, অ্যাক্সিস ব্যাঙ্ক এবং ইনফোসিসের মতো সংস্থাও । প্রযুক্তির উন্নতির ফলে যে যাচাই প্রক্রিয়া করতে বহু দিন লেগে যেত তা এখন সম্ভব হচ্ছে মাত্র কয়েক মিনিটে ।
যদিও ভারতীয় যুবসমাজ স্থায়ী চাকরি পছন্দ করে, মনে করা হচ্ছে, প্রায় 56 শতাংশ নতুন চাকরি হবে অস্থায়ী এবং চুক্তিভিত্তিক । প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সংগঠিত ক্ষেত্রের চাকরি ক্রমেই অসংগঠিত ক্ষেত্রে পরিণত হচ্ছে । অস্থায়ী কর্মীদের কোনও ছুটি থাকে না । অতিরিক্ত কাজের জন্য ওভারটাইম থাকে না । স্বাস্থ্য বিমা থাকে না । আর সবথেকে বড় বিষয় হল চাকরির কোনও নিশ্চয়তা থাকে না । বর্তমানে যে শ্রম আইন আছে তাতে ফ্রিল্যান্সের বিষয়ে কিছুই বলা নেই । এর ফলে বিভিন্ন সংস্থা এই ধরনের কর্মী নিয়োগ করে উল্লেখযোগ্যভাবে নিজেদের খরচ অনেকটাই কমিয়ে ফেলতে পেরেছে । চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের কাজের পরিবেশের উন্নতির উদ্দেশ্যে 2019 সালের 11 ডিসেম্বর লোকসভায় সামাজিক সুরক্ষা কোড পেশ হয়েছে । এই কোডে চুক্তিবদ্ধ কর্মী অথবা গিগ কর্মী, যাঁরা খাবার সরবরাহের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের প্ল্যাটফর্ম ওয়ার্কার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে । এই সব কর্মীদের জীবন, স্বাস্থ্য ও দুর্ঘটনা বিমার ব্যবস্থা করতে সংস্থাগুলিকে নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্র । তাঁদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা ফান্ডও তৈরির কথা ভাবা হচ্ছে । কিন্তু এই কোডে ন্যূনতম মজুরি, সাধারণ ছুটি, অসুস্থতার জন্য ছুটির বিভিন্ন বিধিকে না রাখা একটা মস্ত বড় ভুল । অ্যামেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় সম্প্রতি একটি বিল পাশ হয়েছে যার মাধ্যমে উবার এবং অন্য সংস্থাগুলিকে তাদের চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের সাধারণ কর্মী হিসেবে দেখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে । গিগ শ্রমিকদের ন্যূনতম অধিকার দেওয়ার উদ্দেশ্যে একটি আইন পাশ করেছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন । এই দুই উদাহরণ থেকে শিক্ষা নিতে হবে ভারতের সামাজিক সুরক্ষা কোডকে ।
সুইগি এবং জ়োম্যাটোতে নিজেদের পরিষেবার বিনিময়ে ভালো আয় করছেন শহর ও মফস্বলের গৃহবধূরা । খাদ্যরসিকদের জন্য রয়েছে নানি ঘর, হোম ফুডি, কারিফুলের মতো একাধিক অ্যাপ । এই সব অ্যাপের সাহায্যে গৃহবধূরা নিজেদের রান্নাঘরকে ক্লাউডের সঙ্গে যুক্ত করছেন । 2022 সালের মধ্যে কারিফল অ্যাপ প্রস্তুতকারক বেন ম্যাথিউ নিজেদের ক্লাউডে 10 লাখ গৃহবধূর রান্নাঘর যোগ করতে চাইছেন । 2012 সালে প্রতিষ্ঠিত রেবেল ফুডস ইতিমধ্যেই 301টি ক্লাউড কিচেন এবং 2 হাজার 200 অনলাইন খাবার সরবরাহকারী রেস্তোরাঁয় খাবার দিচ্ছে । ভারতের ক্লাউড কিচেন ব্যবসা খুব শীঘ্রই 100 কোটির গণ্ডি পেরিয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে । ভারতের বৃহত্তম খাদ্য সরবরাহকারী স্টার্ট আপ সুইগি ইতিমধ্যেই 1 হাজার ক্লাউড কিচেন তৈরি করে ফেলেছে এবং তার জন্য 250 কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ফেলেছে ।