4 মার্চ আমরা পালন করলাম বিশ্ব স্থূলতা দিবস । কেন্দ্রীয় সরকারের ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেল্থ সার্ভে-4 (NFHS4) অনুযায়ী, দেশের বেশিরভাগ রাজ্যে স্থূলত্বের সমস্যা গত 10 বছরে বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ । এই সমস্যা গ্রাম ও শহর উভয়ের ক্ষেত্রেই একই । উদাহরণ স্বরূপ, গোয়ায় পুরুষদের ক্ষেত্রে স্থূলত্ব 15 শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে 32 শতাংশ । তামিলনাড়ুর ক্ষেত্রে স্থূলত্বের এই পরিমাণ হয়েছে 14 থেকে 28 শতাংশ । গুজরাতের ক্ষেত্রে 11 থেকে 20 শতাংশ । হরিয়ানায় 10 থেকে 20 শতাংশ এবং বিহারের ক্ষেত্রে 6 শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে 12 শতাংশ । রিপোর্ট অনুযায়ী, স্থূল হয়েছেন মহিলারাও । অন্ধ্রপ্রদেশের ক্ষেত্রে মহিলাদের স্থূলত্বের পরিমাণ 17 থেকে বেড়ে হয়েছে 33 শতাংশ, অরুণাচল প্রদেশের ক্ষেত্রে 8 থেকে 18 শতাংশ, মণিপুরের ক্ষেত্রে 13 থেকে বেড়ে 26 শতাংশ, হিমাচল প্রদেশের ক্ষেত্রে 13 থেকে 28 শতাংশ । ভারতে স্থূলত্বের ক্ষতিকর প্রভাব অনেকটাই বেশি । আমরা সবাই জানি যে, আমরা ডায়াবিটিসের বিরুদ্ধে এক প্রবল যুদ্ধে উত্তীর্ণ । আর ডায়াবিটিসের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ক্ষতিকর বিষয়টি হল স্থূলত্ব । রিপোর্ট অনুযায়ী, এ দেশে প্রতি 100 জন পূর্ণবয়স্কের মধ্যে (অর্থাৎ যাঁদের বয়স 20-র বেশি) 38 জনের ডায়াবিটিস আছে । 2016 সালে বিশ্বজুড়ে এই গড় ছিল মাত্র 19, যা ভারতের গড়ের অর্ধেক । যদিও সাধারণভাবে 25-এর বেশি BMI থাকলে তাকে স্থূলত্ব বলা হয় । দেশের একটা বড় অংশ রয়েছে যাদের গোপন স্থূলত্ব রয়েছে । গোপন স্থূলত্ব মানে, যাদের স্থূলত্বের সংজ্ঞায় ফেলা না গেলেও তাদের শরীরে, বিশেষ করে পেটের কাছে প্রচুর চর্বি রয়েছে । পুরুষদের ক্ষেত্রে 90 সেন্টিমিটারের সমান বা বেশি এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে 80 সেন্টিমিটারের সমান বা বেশি কোমরের মাপ হলে তাকে স্থূল পেটের অধিকারী বলা হয় । এর ফলে ডায়াবিটিস তো বটেই । বেড়ে যায় উচ্চ রক্তচাপ । হার্টের সমস্যা এবং স্ট্রোকের আশঙ্কাও অনেকটাই বেড়ে যায় ।
এ বার আমরা COVID-১৯ ভাইরাসের সঙ্গে এর তুলনা করতে চাই । আমরা জানি যে, COVID-১৯ ভাইরাসের মোকাবিলায় পরিবহণ ব্যবস্থা, অর্থনীতি, সমাজ ও খাদ্য ব্যবস্থার বিশাল ভূমিকা আছে । আমরা আরও জানি যে, বনাঞ্চল হারিয়ে যাওয়া এবং বন্যপ্রাণীদের সঙ্গে মানুষের মেলামেশা যতই বাড়ছে, ততই ‘জঙ্গলের ভাইরাস’ COVID-১৯ বা SARS-এর উপদ্রব বাড়ছে । এর জন্য আমাদের কখনও কোনও এক জনকে দায়ি করা উচিত নয় । একই ভাবে, স্থূলত্বের জন্য ব্যক্তিবিশেষের দিকে আঙুল না তুলে আমাদের উচিত পরিবহণ, অর্থনীতি, খাদ্য ব্যবস্থার দিকে নজর দেওয়া । যেগুলি এই সমস্যার উৎস এবং কারণ । স্থূলত্বের উদাহরণ না হয়ে স্মার্ট সিটিগুলিকে স্থূলত্ব রুখতে ব্যবস্থা নিতে হবে । স্থূলত্ব কমানোর বাড়তি সুবিধা, শহরে দূষণ নিয়ন্ত্রণ । একটা কথা জেনে রাখা প্রয়োজন যে, স্থূলত্ব , বিশেষ করে বাচ্চাদের স্থূলত্বের ক্ষেত্রে বায়ুদূষণ একটা বড় অনুঘটকের কাজ করে । আমাদের জন্য যারা খাদ্য ও কৃষিপণ্য উৎপাদন করে, সেই সব আর্থ সামাজিক গোষ্ঠীগুলিকে আরও উৎসাহিত করতে হবে । অস্বাস্থ্যকর খাবার ও পানীয়ের ব্যবসা বন্ধ করা, বিশেষত শিশুদের কাছে সে সব পৌঁছে যাওয়া আটকানো বেশ কষ্টকর । তা হলে কি শহুরে জঙ্গল এবং নগর কৃষিকে বাধ্যতামূলক করা হবে? শারীরিক কসরৎ অনেকাংশেই স্থূলত্ব প্রতিরোধ করতে পারে । ‘ফিট ইন্ডিয়া মুভমেন্ট’ শুরু করায় আমরা প্রধানমন্ত্রী ভুয়সী প্রশংসা করি । সুস্থতার লক্ষমাত্রা তখনই ছোঁয়া সম্ভব যখন পরিবেশ আমাদের সুস্থ থাকতে অনুপ্রাণিত করে । সুস্থ শহরে সুস্থ পরিবহণ, সুস্থ রাস্তা, সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা থাকতে হবে এবং অবশ্যই এই সব সুস্থতার উপাদান ভারতে তৈরি হতে হবে ।
সুস্থ পরিবহণ ব্যবস্থায় থাকবে সুস্থ ফুটপাত ও সুস্থ রাস্তা । চওড়া হাঁটার রাস্তা, যা কি না রাস্তার মতো চওড়া, ছয় ইঞ্চির বেশি উচ্চ নয়, এবং র্যাম্প থাকবে, তাকে সুস্থ ফুটপাত বলে । রাস্তা এবং ফুটপাতের দুই ধারে সবুজ ও সতেজ গাছপালা থাকতে হবে যেগুলি প্রাকৃতিক শীতাতপ ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করবে । ভয়ঙ্কর গরমে এই সব গাছের ছায়া শিশু, বৃদ্ধ, নর-নারী নির্বিশেষে প্রশান্তি দেবে । কাজ করবে প্রাকৃতিক অক্সিজেন সিলিন্ডারের মতো । পাশাপাশি থাকতে হবে বিশ্রাম করার জন্য কিছু দূর অন্তর বেঞ্চ এবং পানীয় জলের সুব্যবস্থা । সুস্থ রাস্তার জন্য প্রয়োজন শহুরে রাস্তাগুলোর একটি বা দু’টিকে গাড়ি চলাচলের জন্য রাখা । যথেষ্ট পরিমাণে জেব্রা ক্রশিং রাখা । এই সব জেব্রা ক্রশিংয়ে সিগনালে যথেষ্ট সময় দিতে হবে সব বয়সের মানুষের রাস্তা পেরোনোর জন্য । গাড়ি চলাচলের জন্য রাস্তার সংখ্যা কমালে তা পথচারীদের আরও হাঁটতে, সাইকেল চালাতে উৎসাহিত করবে । এর ফলে মানুষ আরও বেশিক্ষণ রাস্তায় থাকতে পারবে । এর ফলে সমানাধিকার, নৈতিকতা ও ন্যায়বিচারও প্রতিষ্ঠা পেতে সুবিধা হবে । সুস্থ পরিবহণ ব্যবস্থার শর্ত হল ভালো মান ও যথেষ্ট পরিমাণে গণপরিবহণ । দেখা গিয়েছে যে, যাঁরা গণপরিবহণ ব্যবহার করেন, তাঁরা দিনে 8 থেকে 33 মিনিট বেশি হাঁটেন । এর ফলে সুস্থ থাকা সহজ হবে । সুস্থ বিনোদনের জন্য প্রয়োজন শহুরে জঙ্গল বা বিশাল পার্কের, যা প্রত্যেককে সুস্থ থাকতে আরও বেশি অনুপ্রাণিত করবে । সুস্থ আবাসনের জন্য প্রয়োজন প্রচুর ফাঁকা জায়গা, সবুজ, গাছপালা, রেলিং দেওয়া বড় সিঁড়ি, পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা । সুস্থ সামাজিক ব্যবস্থা ও সুস্থ সামাজিক নিয়মের অর্থ, হাঁটা ও সুস্থ থাকা । সুস্থ বিনোদনের জন্য সব ধরনের বয়সের মানুষের জন্য প্রয়োজন শহরে ও গ্রামে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও নাচের একাধিক কেন্দ্র । সুস্থ স্কুলের জন্য প্রয়োজন বিশাল খেলার মাঠ ও আনুষঙ্গিক সুযোগ সুবিধা । নাচের ক্লাস ও শারীরশিক্ষা আবশ্যিক করতে হবে । যারা এই সব ক্লাসে অংশ নেবে তাদের জন্য বিশেষ সুবিধারও ব্যবস্থা করতে হবে । সুস্থ কর্মক্ষেত্রের জন্য প্রয়োজন শরীরচর্চার সুবিধা এবং আদর্শ নীতি । এ সব করা সম্ভব হলে আমরা সঠিকভাবে উন্নত হব । উন্নত হবে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিরও ।
বিঃদ্রঃ উপরের মতামত ETV Bharat বা তার কর্তৃপক্ষের নয়, তা একেবারেই লেখকের নিজস্ব ৷