দিল্লি, ১৮ মার্চ : স্বাধীন ভারতে এখনও পর্যন্ত যতজন প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে গেছেন, তাঁদের মধ্যে মনোহর পার্রিকরের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। জঙ্গি ঘাঁটি ধ্বংস করার জন্য প্রথমে মায়ানমার ও পরে পাক অধিকৃত কাশ্মীরে ভারতীয় সেনার সার্জিকাল স্ট্রাইক চালানোর জন্য তাঁকে মনে রাখবে দেশ।
ডিউটির পর কেউ বিশ্রাম করছিলেন। কেউ বা প্রিয়জনের সঙ্গে ফোনে ব্যস্ত ছিলেন। সেসময় হঠাৎ কয়েকজন জঙ্গি বেপরোয়া গুলি চালাতে শুরু করে। মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু শেষ। দিনটা ছিল ২০১৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর। সময় সকাল ৫ টা ৩০ মিনিট। জম্মু- কাশ্মীরের উরি সেনা ছাউনিতে হামলা চালায় কয়েকজন জঙ্গি। ঘটনায় শহিদ হন ২৩ জন জওয়ান। আহত হয়েছিলেন ২০ জন। ঘটনার পর উত্তাল হয়ে ওঠে দেশ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তখন বলেছিলেন, "আমি দেশবাসীকে আশ্বস্ত করছি, এরকম ঘৃণ্য কাজ যারা করেছে তাদের শাস্তি পেতে হবে।"
সেইসময় প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন মনোহর পর্রিকর। ঘটনার পর তিনি বলেন, "বিষয়টি ভীষণ স্পর্শকাতর। বিষয়টি নিয়ে আমি বেশি কথা বলব না। তবে, এই হামলায় যারা জড়িত তাদের রেয়াত করা হবে না বলে প্রধানমন্ত্রী যে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন, তা শুধু বিবৃতি হিসেবেই থেকে যাবে না। কীভাবে শাস্তি দেওয়া হবে তা আমরা দেখছি।" তাঁর এই প্রতিক্রিয়া দেওয়ার ঠিক ৮ দিনের পর অর্থাৎ ২৯ সেপ্টেম্বর উরি হামলার জবার দেয় ভারত। নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে সার্জিকাল স্ট্রাইক চালায় ভারতীয় সেনা। সেখানে একাধিক জঙ্গিঘাঁটি ধ্বংস করে দেয় সেনা। রিপোর্ট অনুযায়ী ২ পাকিস্তানি সেনাসহ ৩৮ জঙ্গি নিকেশ হয় এই অভিযানে। সূত্রের খবর, এই অভিযান চালানোর জন্য সেনাদের কর্ণাটকে দেওয়া বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল।
ঘটনার পর সাংবাদিক বৈঠকে ডিরেক্টর জেনেরাল অফ মিলিটারি অপারেশনস (DGMO) রণবীর সিং বলেন, এই অভিযানে কমপক্ষে ২০টি জঙ্গিঘাঁটি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। সেনাবাহিনীর কাছে বড়সড় জঙ্গি অনুপ্রবেশের খবর ছিল। সেইমতো নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালায় ভারতীয় সেনা। একাধিক জঙ্গির মৃত্যুও হয়েছে।
সার্জিকাল স্ট্রাইকের পর তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পর্রিকর বলেন, "পাক অধিকৃত কাশ্মীরে (PoK) সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল ১৫ মাস ধরে। ২০১৫ সালের ৪ জুন মণিপুরে সেনার উপর হামলার ঘটনায় আমি অপমানিতবোধ করি। এর ঠিক পাঁচ দিন পরে অর্থাৎ ২০১৫ সালের ৯ জুন থেকে সার্জিকাল স্ট্রাইকের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। সেইমতো বিশেষ বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কেনা হয় সরঞ্জাম। পাক সেনার ফায়ারিং ইউনিটের হদিস পেতে ২০১৬-র সেপ্টেম্বরে DRDO-র তৈরি সাথি উইপন লোকেটিং র্যাডার প্রথম ব্যবহার করা হয়। যদিও সরকারিভাবে ওই ব়্যাডার সেনায় অন্তর্ভুক্ত হয় তিন মাস বাদে। ওই র্যাডারের জোরে পাকিস্তানের বাহিনীর ৪০টি ফায়ারিং ইউনিট গুঁড়িয়ে দেয় সেনা।"
উল্লেখ্য, ভারতের প্রথম সার্জিকাল স্ট্রাইক ছিল মায়ানামরে। ২০১৫-র ৪ জুন মণিপুরের চান্দেলে সেনা কনভয়ের ওপর নাগা জঙ্গি গোষ্ঠী NSCN(K)-এর হামলায় মৃত্যু হয় ১৮ জওয়ানের। এই প্রসঙ্গ তুলে পর্রিকর বলেন, "ঘটনাটির কথা জেনে আঁতে ঘা লেগেছিল। অপমান বোধ করেছিলাম। মাত্র ২০০ লোকের জঙ্গিবাহিনী কি না ১৮ ডোগরা জওয়ানকে মেরে দিয়ে গেল! ভারতীয় সেনার অপমান এটা। আলোচনায় বসে আমরা প্রথম সার্জিকাল স্ট্রাইকের পরিকল্পনা করি। ৮ জুন সকালের সেই হামলায় প্রায় ৭০-৮০ জন সন্ত্রাসবাদী খতম হয় ভারত-মায়ানমার সীমান্তে। দারুণ সফল ছিল সেই অপারেশন। একজন মাত্র সেনা পায়ে জোঁকের কামড় খান। বাকিরা অক্ষত ছিলেন। জরুরি পরিস্থিতির জন্য হেলিকপ্টার তৈরি রাখা হয়েছিল, কিন্তু, তা নামানো হয়নি।"
মনোহর পর্রিকর আরও জানান, সেই সময় টিভির পর্দায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা প্রাক্তন সেনাকর্মী রাজ্যবর্ধন রাঠোর এ ধরনের অভিযানের খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করছিলেন। তখন জনৈক টিভি সঞ্চালক তাঁকে প্রশ্ন করেন, "পশ্চিম সীমান্তেও এমন অভিযান চালানোর সাহস, ক্ষমতা কি আপনাদের আছে?" এই প্রশ্ন পর্রিকরকে খোঁচা দিয়ে যায়। তিনি বলেন, “সেদিন কথাটা হজম করে নিয়েছিলাম, মনে মনে ঠিক করেছিলাম, সময় এলেই জবাবটা দেব।"