বিশ্ববিদ্যালয় কেবলমাত্র উচ্চশিক্ষার পীঠস্থান নয়, বরং এটি হল সেই স্থান যা উদ্ভাবনী কল্পনাশক্তির তরতাজা বাতাস বয়ে আনে । সৃষ্টিবিলাসী মনকে বিকাশের ডানা দেয় এবং সমাজের মানবসম্পদকে তার পূর্ণ ক্ষমতা মেলে ধরতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। তা, আজকাল এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অবস্থা কেমন? অধিকাংশই অপর্যাপ্ত তহবিল এবং অপ্রতুল শিক্ষাকর্মীর অভাবে কার্যত ধুঁকছে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অবস্থা নিয়ে পার্লামেন্টারি স্ট্যান্ডিং কমিটির রিপোর্ট মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের কাছে একটা বড় ধাক্কা ছিল। চলতি অর্থবর্ষে উচ্চ শিক্ষা দফতরের তরফে যেখানে ৫৮,০০০ কোটি টাকা দাবি করা হয়েছিল, সেখানেই সাম্প্রতিক কেন্দ্রীয় বাজেটে এর জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল মাত্র ৩৯,০০০ কোটি টাকা। জরুরি সাধারণ সুযোগসুবিধা প্রদান থেকে শুরু করে শিক্ষক, শিক্ষিকা এবং ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যার প্রয়োজনীয় অনুপাতের লক্ষ্যপূরণের জন্য ও নতুন নতুন শিক্ষাগত পদ সৃষ্টি করার জন্য এই বরাদ্দ অত্যন্ত কম ছিল। আর তা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করার পাশাপাশি স্ট্যান্ডিং কমিটি বিভিন্ন স্তরে শূন্যপদের সম্পর্কেও তাদের রিপোর্টে বিশদে জানিয়েছিল। তাদের দাবি, NIT-এ শূন্যপদের সংখ্যা ৩৭.৭ শতাংশ, কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতেও প্রায় একই হার এবং IIT-গুলিতে ২৯ শতাংশেরও বেশি শূন্যপদ রয়েছে—সব মিলিয়ে বর্তমানে যার সংখ্যা অন্তত ৭৮,০০০। গড় হিসাবে, অন্তত এক তৃতীয়াংশ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক, শিক্ষিকা নেই। এই সমস্যার মূল কারণ তুলে ধরতে গিয়ে নীতি আয়োগের সদস্য ভিকে সারস্বত বলেছেন, এক বছর মেয়াদে দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে আর্থিক বরাদ্দের তুলনা যদি চিনের সঙ্গে করা হয়, তাহলে দেখা যাবে সে দেশে যেখানে এই কাজে ১০ লাখ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়, সেখানে আমাদের দেশে বরাদ্দের পরিমাণ চিনের তুলনায় বিশাল সমুদ্রের মাত্র একটি ফোঁটা জলের সমতুল। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে স্ট্যান্ডিং কমিটি ত্রুটি খুঁজে পেয়েছে শিক্ষা দফতরের কাজের ধরন এবং কাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, তা নির্ণয়ের যুক্তিতে। যেমন শিক্ষা দফতরের তরফে উচ্চশিক্ষার জন্য বরাদ্দ তহবিল থেকে ৫০ শতাংশেরও বেশি অর্থ প্রদান করা হয় IIT, IIM এবং NIT-গুলিকে। আর ৪৯ শতাংশ অর্থ প্রদান করা হয় ৮৬৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে, যেখান থেকে দেশের অন্তত ৯৭ শতাংশ পড়ুয়া শিক্ষা গ্রহণ করে। এছাড়াও স্থানীয় আরও নানা সমস্যায় অন্তঃদেশীয় শিক্ষাক্ষেত্র জর্জরিত হয়ে পড়েছে।
বেশ কয়েক দশক আগে ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশনের চেয়ারম্যান ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান বলেছিলেন যে, যত সময় যাবে, উচ্চশিক্ষার ভিত মজবুত করার জন্য তত বেশি উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে সেই লক্ষ্যপূরণ করা যায়। কিন্তু একের পর এক সরকার ক্ষমতায় এলেও দেশগঠনে উচ্চশিক্ষায় গুরুত্বদানের বিষয়টি সেই অবহেলাতেই পড়ে থেকেছে। যার জন্য বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে অধ্যাপক, অধ্যাপিকার শূন্য পদ এতটা বেড়ে গিয়েছে। নীতি আয়োগ সম্প্রতি এই প্রস্তাব দিয়েছে যে, প্রতি বছর বিদেশ থেকে যাতে অন্তত ২ লাখ পড়ুয়া ভারতে পড়তে আসে, তার জন্য বিশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হবে। বিদেশি পড়ুয়াদের শিক্ষাগ্রহণের পছন্দসই গন্তব্য হিসাবে এই প্রতিষ্ঠান বিশ্বে ২৬-তম স্থানে রয়েছে। গত বছর ঠিক এই সময়ই মোদি সরকার প্রস্তাব দিয়েছিল, ‘স্টাডি ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্পের পরিধি আরও বাড়িয়ে ৩০টি দেশে ছড়িয়ে দিতে যাতে আরও বেশি সংখ্যক ছাত্রছাত্রী এর প্রতি আকৃষ্ট হয়। কিন্তু বাস্তবে সমস্যা হল, উপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন যোগ্য প্রার্থীর হদিশ পাওয়া, বিশ্ববিদ্যালয়গুলির শূন্যপদে ছাড়াও নবনির্মিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে যাঁদের নিয়োগ করা যেতে পারে। অথচ দেখা গিয়েছে, P.Hd করেছেন বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি রয়েছে, এমন প্রার্থীরাও সাক্ষাৎকার পর্বে অত্যন্ত খারাপ ফল করছেন। আর এ সবই আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, দেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির অবস্থা বর্তমানে কতটা খারাপ। অযোগ্য প্রতিষ্ঠান এবং প্রতিনিধি সংক্রান্ত এই সব সমস্যার মোকাবিলা করে যোগ্য ব্যক্তির হাতে দেশের পরবর্তী প্রজন্মকে শিক্ষিত করে তোলার ভার তুলে দেওয়াই হল প্রকৃত চ্যালেঞ্জ। উচ্চশিক্ষায় অধ্যপনার মানোন্নয়নের জন্য দু’বছর আগে, UGC-র (ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশন) তরফে একটি নয়া নির্দেশিকা প্রস্তুত করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে জাল P.Hd-র অগুণতি ঘটনা সামনে এসেছে, যা উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে তুলেছে। এই পরিস্থিতিতে প্রকৃত সমাধান হল শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং এই বিষয়ে গভীর বোঝাপড়ার কথা মাথায় রেখে একটি দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি তৈরি করা এবং তা অনুসরণ করা।
শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন নতুন সৃষ্টিশীল উদ্ভাবনা এবং মানবসম্পদের বিকাশের উপর জোর দেওয়ার কেন্দ্র সরকারের উৎসাহে শ্রমউৎপাদনের হারের পাশাপাশি গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট তথা GDP-ও বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশগঠনে উচ্চশিক্ষা একটা বড় ভূমিকা পালন করে কারণ তার ফলে একের পর এক নতুন প্রজন্ম শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে, গর্বে মাথা তুলে দাঁড়ানোর জমি পায়। অথচ সৃষ্টির গোড়া থেকে শিক্ষার মতো এমন মহান একটি ক্ষেত্রকে হীনবল করে রাখা হয়েছে। UNESCO-এর এক পুরনো সমীক্ষার ফল অনুযায়ী, স্কুলে পঠনপাঠনের নিম্ন মানের দরুণ ভারত ১৫ বছর ধরে পিছিয়ে রয়েছে অথচ এই দেশেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে ১.৫ মিলিয়নেরও বেশি স্কুল। পরিকাঠামো থেকে শুরু করে শিক্ষক-অধ্যাপক নিয়োগ— সব দিকেই সক্রিয়তার অভাব লক্ষিত হয়েছে, যার ফলে শিশুদের সহজাত প্রতিভা অবহেলিত হচ্ছে। যতক্ষণ না দেশের ১৯,০০০ টিচার ট্রেনিং প্রতিষ্ঠানে রমরমিয়ে চলা ফাঁকিবাজি দূর হচ্ছে, ততক্ষণ শিক্ষার মানোন্নয়ন হবে না। বিশ্বের যে ৭৪টি দেশে নানা স্তরে শিক্ষক, শিক্ষিকার ঘাটতি রয়েছে, সেই তালিকায় ভারত রয়েছে একেবারে প্রথম সারিতে। আর এর জন্য শিক্ষার মানহানি হচ্ছে। বিদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে কর্মরত এক লাখেরও বেশি স্বদেশীয় শিক্ষক, শিক্ষিকাদের (যাঁদের P.Hd ডিগ্রি রয়েছে), চিন দেশে ফেরানোর চেষ্টা করছে বিশাল অঙ্কের বেতন দেওয়ার লোভনীয় প্রস্তাব দিয়ে। ভারতেও যোগ্য পদ, উপযুক্ত বেতন এবং প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে উচ্চশিক্ষিত এবং যোগ্য শিক্ষক, শিক্ষিকাদের দেশে ফিরিয়ে আনার যথেষ্ট প্রয়োজনীয়তা আছে। নয়া জাতীয় শিক্ষা নীতির খসড়া প্রস্তাবে যে প্রগতিশীল সম্প্রদায়ভিত্তিক পরিকাঠামো গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে, তা তৃণমূল স্তর থেকেই শুরু হওয়া উচিত। উচ্চ শিক্ষার সঠিক দিশা হল গুণগত সুশিক্ষা গ্রহণ। আর এই ধরনের শিক্ষাই হল দেশের সর্বব্যপী বিকাশের প্রকৃত কাণ্ডারী।