বিভিন্ন সময়ে ভোট পিছিয়ে যাওয়া বা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ব্যত্যয় তো বটেই, 1987 সালের পর থেকে কাশ্মীরে অস্থির পরিস্থিতির সবচেয়ে বড়ো এবং সর্বপ্রথম শিকার নির্বাচনী প্রক্রিয়া । ভোটে জিতে আসা রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ছিল একেবারেই সাধারণ ঘটনা । বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আক্রমণ নেমে আসত সেই সব রাজনৈতিক নেতাদের উপর যাঁরা কি না কাশ্মীরকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে বর্ণনা করতেন । এপর্যন্ত জম্মু ও কাশ্মীর সাক্ষী থেকেছে অন্তত 5 হাজার রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীর মত্যুর ঘটনার । হিংসা নয়, এঁরা সবাই নির্বাচনের মাধ্যমে সেখানকার যাবতীয় সমস্যার সমাধানের পক্ষে সওয়াল করতেন ।
এই অবস্থাতে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল জম্মু ও কাশ্মীরে জেলা উন্নয়নের নির্বাচন (DDC) যেন উপত্যকার সমগ্র রাজনৈতিক চিত্রটাকেই আমূল বদলে দিল । দশকের পর দশকের ধরে চলতে থাকা রক্তাক্ত হিংসার পর বৈধ নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যাবতীয় সমস্যার সমাধান খোঁজার চেষ্টা করছে উপত্যকা । নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বয়কট বা বর্জন করা থেকে যাবতীয় সমস্যা সমাধানে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে সেই নির্বাচনকেই বিশ্বাস করার এই সমগ্র প্রক্রিয়ার মূল ভিত্তি কিন্তু লুকিয়ে আছে 2019 সালের 5 অগাস্টের সেই সিদ্ধান্তর মধ্যে । সেদিন কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা লোপ পায় এবং গোটা অঞ্চলকে দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হয় যার মধ্যে একটিতে বিধানসভা থাকলেও অপরটিতে তা রাখা হয়নি ।
যে সব রাজনৈতিক দল এত দিন নির্বাচনে অংশ নিত তাদের কাজটা কিছুটা কঠিন করে দেওয়া হয় কারণ তাদের মূল অ্যাজেন্ডাই ছিল এলাকার বিশেষ মর্যাদা লোপের বিরোধী । তারা বেশি কিছু করা বা আওয়াজ তোলার আগেই কেন্দ্রীয় সরকার জন সুরক্ষা আইন (Public Safety Act) অনুযায়ী সেই সব দলের নেতাদের হয় জেলবন্দি করেছে, না হলে তাঁদের গৃহবন্দি করেছে এবং তাঁদের বাড়িগুলিকেই প্রায় জেলে পরিণত করেছে । এই সব নেতাদের মধ্যে ছিলেন তিন জন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্য মন্ত্রিসভার সদস্য, প্রাক্তন সাংসদ প্রমুখ । এই সব নেতাদের মুক্তির পর BJP শাসিত সরকার ভেবেছিল যে কাশ্মীরের প্রাদেশিক দলগুলি ফের নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ভেস্তে দেওয়ার উদ্দেশ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলির সঙ্গে হাত মেলাবে । কিন্তু তাদের ভুল প্রমাণ করে সেই সব প্রাদেশিক দল এক যোগে শাসক BJP-র বিরুদ্ধে জোট তৈরি করে ফেলল । এর ফলে সম্ভবত BJP কিছুটা শঙ্কিত হল । সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে, চলতি DDC নির্বাচনে BJP-র বিরুদ্ধে যে সব প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, তাঁদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে । শাসকদলের এই সঙ্কীর্ণ রাজনীতি এবং দুর্ভাগ্যজনক কার্যকলাপের বিষয়গুলি সেভাবে সামনে আসার আগেই নির্বাচনী আধিকারিকরা জানিয়ে দিলেন যে, এই সব প্রতিবন্ধকতা কেবলমাত্র নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ের জন্যই ।
কাশ্মীরে DDC (জেলা উন্নয়ন কাউন্সিল)-এর নির্বাচনের প্রথম পর্যায়ে ভোটারদের বিপুল সাড়া দেওয়ার নির্বাচনী বিশেষজ্ঞদের একটা বড় অংশের ধারণা, এই অঞ্চলের মানুষের কাছে ভোট বয়কট বা বর্জন আর কোনও সমাধান নয় । আর এই পট পরিবর্তনের ফলে যেনো নিঃশ্বাস ফেলার বাড়তি সুযোগ পাচ্ছেন গুপকার অ্যালায়েন্সের সদস্যরা । সমাজে যেন তাদের গ্রহণযোগ্যতা অনেকটাই বেড়ে গেছে ।
প্রায় কোনও দ্বিধা বা অবিশ্বাস ছাড়াই নারী পুরুষ নির্বিশেষে সব বয়সের ভোটারদের দেখা গেছে টেলিভিশনে মুখ দেখাতে । সাধারণ ভোটারদের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে অবিশ্বাস থাকলে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলি যেভাবে এতবছর নির্বাচন বয়কটের ডাক দিত এবং ভোট বয়কট করত, এবারও তা সম্ভব হত ।
370 ধারা বিলোপ নিয়ে তৈরি হওয়া জটিলতারও সমাধানে এই প্রক্রিয়া প্রয়োগ করা যেতে পারে । নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা সব দলেরই 5 অগাস্টের সেই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের বিষয়ে নিজস্ব বক্তব্য রয়েছে । BJP এবং তাদের বি টিম আলতাফ বুখারির নেতৃত্বাধীন আপনি পার্টি বোঝানোর চেষ্টা করছে যে 370 ধারা বিলোপের সিদ্ধান্ত সঠিক এবং তাতে এলাকার উন্নতি হয়েছে বা ভবিষ্যতে হবে । অন্যদিকে গুপকার অ্যালায়েন্সের দলগুলি চেষ্টা করছে এলাকায় আবার বিশেষ মর্যাদা ফিরিয়ে আনার । কাদের উদ্দেশ্য সাধিত হল, তা বুঝতে আমাদের ভোটের ফলাফল বেরনো পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে ।