ETV Bharat / bharat

কোভিড-১৯ শক্তিশালী করবে বিগ ব্রাদার

যেভাবে আমাদের সরকারগুলো কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে লড়াই করছে, তার প্রশংসা করতেই হবে। কয়েকজন রাষ্ট্রপ্রধান, সমস্ত মতবিরোধ ঝেড়ে ফেলে, ভাইরাসের বিরুদ্ধে মানবতার লড়াইয়ে একজোট হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। আমরা যারা পৃথিবীর অধিবাসী, তাঁদের বলা হচ্ছে, যে করোনাবাইরাসের বিরুদ্ধে লড়তে৷ আমাদের সামনে এআই বা জৈবপ্রযুক্তির মতো বিকল্প রয়েছে।

author img

By

Published : Mar 27, 2020, 3:11 PM IST

Can COVID-19 be used to empower Big Brother
কোভিড-১৯ শক্তিশালী করবে বিগ ব্রাদার

ইন্দ্রশেখর সিং

"একমাত্র আইন নির্ধারিত পদ্ধতি ব্যতীত, কোনও ব্যক্তি তাঁর জীবন অথবা ব্যক্তিগত স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হবেন না।'' ২১ ধারা, ভারতীয় সংবিধান।

যেভাবে আমাদের সরকারগুলো কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে লড়াই করছে, তার প্রশংসা করতেই হবে। কয়েকজন রাষ্ট্রপ্রধান, সমস্ত মতবিরোধ ঝেড়ে ফেলে, ভাইরাসের বিরুদ্ধে মানবতার লড়াইয়ে একজোট হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। আমরা যারা পৃথিবীর অধিবাসী, তাঁদের বলা হচ্ছে, যে করোনাবাইরাসের বিরুদ্ধে লড়তে৷ আমাদের সামনে এআই বা জৈবপ্রযুক্তির মতো বিকল্প রয়েছে।

যখন পুরো পৃথিবী আক্ষরিক অর্থেই অবরুদ্ধ, তখন চিন থেকে আমেরিকার সরকার করোনা ভাইরাস আক্রান্তদের সনাক্ত করতে, ফোনের ব্যক্তিগত তথ্য ঘাঁটার অনুমতি দিচ্ছে এআই এবং ডেটা অ্যানালিটিক্স সংস্থাগুলোকে, ব্যবহার করা হচ্ছে ফেশিয়াল রেকগনিশন প্রযুক্তিও। এমন রিপোর্ট সামনে এসেছে, যে টেনসেন্ট আর আলিবাবার মতো সংস্থা এধরণের প্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে চিন সরকারের সঙ্গে কাজ করছে। মানুষের ট্রাভেল হিস্ট্রি, সংক্রমিত এলাকায় কতটা সে কতটা সময় কাটিয়েছে, তার কথোপকথনের বিবরণ -- এমন তথ্য সংগ্রহ করতে বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করছে চিন সরকার। এক কথায় বললে, প্রতিটি ব্যক্তির সম্পর্কে সমস্ত তথ্য এআই ও অ্যাপ মারফত তাঁরা জানে। ভারতেও, আক্রান্তদের খুঁজে বার করতে করোনা অ্যাপ ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে। চিনে তথ্য সংগ্রহের সঙ্গে সঙ্গে, অ্যালগরিদমের মাধ্যমে সেইসব মানুষদের হেলথ কোড দেওয়া হয় -- হলুদ, লাল ও সবুজ। কালার কোড বুঝিয়ে দেয়, সেই লোকটিকে কোয়ারেন্টিন করা হবে কি না, লোকটি গণপরিবহণ ব্যবহার করতে পারবে কি না। এই তথ্য সংগ্রহের বেশিরভাগই নাগরিকদের ইচ্ছায় হয় না। আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স সরকারকে রিপোর্ট দেয়, যে কোনও ব্যক্তি অসংলগ্ন উত্তর দিচ্ছেন কি না, অথবা সোজাসুজি মিথ্যে কথা বলছেন কি না। এরপর কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সরকার গোপনীয়তার রীতিনীতিকে পাশ কাটিয়ে গিয়েছে, আর ফলাফল পেতে মানুষের ফোন, কম্পিউটার, পাবলিক ক্যামেরায় উঁকিঝুঁকি দেওয়ার খোলাখুলি অধিকার দিয়েছে বেসরকারি সংস্থাগুলোকে। চিনে রয়েছে একটি বিস্তৃত ''কালো আয়নার মতো এবং অন্ধকার'' সোশ্যাল ক্রেডিট সিস্টেম, যা প্রতিটি পদক্ষেপ ও আচরণের ওপর নজরদারি চালানোর অনুমতি দেয়। যদি আচরণ রাষ্ট্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, আপনি পুরস্কৃত হবেন, অন্যথায় আপনি ট্রেনেও চাপতে পারবেন না।

পশ্চিমের দিকে যদি তাকাই, ইংল্যান্ডে স্কাই নিউজের রিপোর্ট বলছে, "সরকার মোবাইল পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থা ওটু-র সঙ্গে কাজ করছে স্মার্টফোন লোকেশন বিশ্লেষণ করতে, যাতে বোঝা যায়, মানুষ সামাজিক দূরত্বের নির্দেশ ঠিকমতো অনুসরণ করছেন কি না।" ইজরায়েল একধাপ এগিয়ে মোবাইল নজরদারি ব্যবহার করে গ্রাহকদের মেসেজ পাঠিয়ে বলছে, যে তাঁরা সংক্রমিত, না সংক্রমিত নন। ফেসবুক, গুগলের মতো সোশাল মিডিয়া সংস্থাও সরকারগুলোকে আমাদের তথ্য দিয়ে তাঁদের দায়িত্ব পালন করছে। তাই আপনি যেখানেই থাকুন না কেন, করোনা ভাইরাস সঙ্কট বিগ ব্রাদারকে সুযোগ করে দিয়েছে সবসময় আপনার ওপর নজর রাখার। আর মনে রাখবেন, এটা "জনস্বাস্থ্য আর আপনার ভালোর জন্য"। আর আমাদের তো কিছুই লুকোনোর নেই।

ঝুঁকি ক্রমশ বাড়ছে, কারণ আমেরিকা-চিন বাণিজ্য যুদ্ধ এআই-নির্ভর প্রযুক্তির একটা নতুন দিগন্তে প্রবেশ করেছে। দুটি দেশের কাছেই এআই-নির্ভর নজরদারি এবং মেডিক্যাল প্রযুক্তির বিপুল ক্ষমতা রয়েছে। সিলিকন ভ্যালির বন্ধু নন বলেই পরিচিত ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন কোভিড-১৯-এর জন্য গণনজরদারি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ব্লু ডট নামে একটি সংস্থার সাহায্য নিয়েছেন। শুধু সময়ের অপেক্ষা, যখন মাইক্রোসফটের মতো বিরাট সংস্থাগুলো হোয়াইট হাউসের সঙ্গে সখ্যতা বাড়িয়ে সেইরকম নজরদারি ব্যবস্থা তৈরি করবে, যা আপনার প্রতি মিনিটে হৃদস্পন্দনের তথ্যও সরকারকে দিয়ে দিতে পারে। তথ্য সংগ্রহ করতে, এবং সরকারগুলোকে 'যুদ্ধের' মতো ক্ষমতা দিতে, বিশ্বজুড়ে জরুরি ভিত্তিতে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। ব্লু ডটের কামরান খান একটি বিবৃতিতে সংবাদমাধ্যমকে বলেন, আমরা জানি যে ঠিকসময়ে তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারগুলোকে ভরসা করা যায় না। এতে এই ধরণের টেকনোক্র্যাটরা যে সরকারকে এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কতটা অবিশ্বাস করেন, সেটাই প্রতিফলিত হয়।

"ক্ষমতা দুর্নীতি আনে, আর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নিরঙ্কুশ দুর্নীতি নিয়ে আসে"

কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে আমাদের সরকার এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোর সদিচ্ছায় আমার কোনও সংশয় নেই, কিন্তু যে এআই নির্ভর ব্যবস্থা তাঁরা সৃষ্টি করছেন, তাতে আতঙ্কে আমাদের গায়ে কাঁটা দেয়, এবং আমরা প্রশ্ন করতে বাধ্য হই: কোভিড-১৯ চলে যাওয়ার পর এইসব নজরদারি ব্যবস্থার কী কী হবে? গণ নজরদারি ব্যবস্থা চলে যাবে, না আরও পরিবর্তিত হবে? বিশ্বের নাগরিকরা কি নিশ্চিত হতে পারেন, যে এর অপব্যবহার হবে না?

ফাইভ-জি প্রযুক্তির সঙ্গে, এই ব্যবস্থা অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে উঠবে, আর এর প্রভু আমাদের গ্রহেরও অধিপতি হয়ে উঠবেন। আমরা শুধু লিঙ্কনের সেই কথাটাই ভাবতে পারি, "প্রায় সব মানুষই প্রতিকূলতার মধ্যে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে, কিন্তু যদি তুমি কোনও মানুষের চরিত্রের পরীক্ষা নিতে চাও, তার হাতে ক্ষমতা দাও।" কী হবে আমাদের নেতাদের, যখন একটা বোতাম টিপেই তাঁরা আমাদের মাথার মধ্যে ঢুকে পড়তে পারবেন? এই ব্যবস্থা প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দেবে, আর বিশ্বের 'সিজার'-রা যখন রক্তের স্বাদ পেয়ে যাবেন, তখন প্যারেডটা 'অ্যাসটেরিক্স ও রথ'-এর থেকেও বিরাট হবে (২০১৭ সালে প্রকাশিত কমিকে একটি প্যারেডের দৃশ্যে করোনাভাইরাস শব্দটি দেখা গিয়েছিল।)।

পৃথিবীর মানুষকে সাবধান হতে হবে, কারণ কোভিড-১৯-এর উপশমের আড়ালে আরও বড় বিপদ আনাগোনা করছে। এআই নির্ভর নজরদারি আমাদের অনুমতিক্রমেই আমাদের জীবনে ঢুকে পড়ছে। ভয় যত জাঁকিয়ে বসছে, তত প্রতিবেশীরা একে অপরের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। এশীয় বংশোদ্ভূত মানুষরা হিটলারের ইহুদিতে পরিণত হচ্ছেন। বর্ণবিদ্বেষের খবর যত বাড়ছে, বিশ্বজুড়ে আমরা একটা বিশৃঙ্খলার মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছি। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে, যাতে করোনা ঘৃণা ও আতঙ্কে আর একটা হলোকস্টে না মদত দিতে পারে, যাকে শক্তি জোগাচ্ছে প্রযুক্তি। দুটি বিশ্বযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর পর আমরা এই শিক্ষা পেয়েছি, যে প্রযুক্তি গণহত্যার কাজেও ব্যবহার হতে পারে। গ্যাস চেম্বার হোক বা পরমাণু বোমা, তারা সবাই সেইসময়ের উন্নত প্রযুক্তির নিদর্শন ছিল, যা নারকীয় উদ্দেশ্যে কাজে লাগানো হয়েছে। ইলন মাস্ক এবং স্টিফেন হকিংয়ের মতো প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানজগতের নক্ষত্র, এবং আরও বিজ্ঞানীরা এআই-এর বিপদ নিয়ে বিশ্বকে সতর্ক করেছেন। মাস্ক তো এও বলেছেন, যে এআই পরমাণু অস্ত্রের চাইতেও বেশি বিপজ্জনক। আমাদের এআই নির্ভর প্রযুক্তির যথেচ্ছ ব্যবহার কমাতে হবে, বিশেষ করে সেইসব অ্যাপ্লিকেশনের যা আমাদের গোপনীয়তা এবং অধিকাররগুলোকে লুঠ করে। এআই নির্ভর নজরদারি ব্যবস্থার মতো বেসরকারি টেকনোক্র্যাটিক যন্ত্র গণতন্ত্র, গোপনীয়তা এবং মানবতাকে বিপন্ন করছে। এই সঙ্কট তাদের সমস্ত নিয়মকানুন থেকে মুক্ত করে দেওয়ার অজুহাত হতে পারে না, আমাদের আগেভাগেই এইসব সংস্থা ও প্রযুক্তির সঙ্গে বোঝাপড়ায় আসতে হবে।

আমরা সবাই সহমত, যে করোনা সঙ্কটকে যে কোনও মূল্যে প্রতিহত করতে হবে, কিন্তু আমাদের সাবধানে থাকতে হবে, যাতে ওষুধটাই পরের রোগের কারণ হয়ে না দাঁড়ায় -- নজরদারি চালানো রাষ্ট্র। আজকের আপতকালীন ক্ষমতা, ভবিষ্যতে অপব্যবহারও করা হতে পারে। তাহলে হয় আমাদের স্বাধীনতা রক্ষার্থে সরকারগুলো এআই এবং বেসরকারি ডেটা সংস্থাগুলোকে আইনের আওতায় আনুক, নয়তো একটা অরওয়েলীয় সকালে ঘুম ভেঙে আবিস্কার করুক যে, "যদি তুমি কোনও কিছু গোপন করতে চাও, তাহলে তোমাকে তা নিজের থেকেও লুকিয়ে রাখতে হবে।"

ইন্দ্রশেখর সিং

"একমাত্র আইন নির্ধারিত পদ্ধতি ব্যতীত, কোনও ব্যক্তি তাঁর জীবন অথবা ব্যক্তিগত স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হবেন না।'' ২১ ধারা, ভারতীয় সংবিধান।

যেভাবে আমাদের সরকারগুলো কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে লড়াই করছে, তার প্রশংসা করতেই হবে। কয়েকজন রাষ্ট্রপ্রধান, সমস্ত মতবিরোধ ঝেড়ে ফেলে, ভাইরাসের বিরুদ্ধে মানবতার লড়াইয়ে একজোট হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। আমরা যারা পৃথিবীর অধিবাসী, তাঁদের বলা হচ্ছে, যে করোনাবাইরাসের বিরুদ্ধে লড়তে৷ আমাদের সামনে এআই বা জৈবপ্রযুক্তির মতো বিকল্প রয়েছে।

যখন পুরো পৃথিবী আক্ষরিক অর্থেই অবরুদ্ধ, তখন চিন থেকে আমেরিকার সরকার করোনা ভাইরাস আক্রান্তদের সনাক্ত করতে, ফোনের ব্যক্তিগত তথ্য ঘাঁটার অনুমতি দিচ্ছে এআই এবং ডেটা অ্যানালিটিক্স সংস্থাগুলোকে, ব্যবহার করা হচ্ছে ফেশিয়াল রেকগনিশন প্রযুক্তিও। এমন রিপোর্ট সামনে এসেছে, যে টেনসেন্ট আর আলিবাবার মতো সংস্থা এধরণের প্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে চিন সরকারের সঙ্গে কাজ করছে। মানুষের ট্রাভেল হিস্ট্রি, সংক্রমিত এলাকায় কতটা সে কতটা সময় কাটিয়েছে, তার কথোপকথনের বিবরণ -- এমন তথ্য সংগ্রহ করতে বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করছে চিন সরকার। এক কথায় বললে, প্রতিটি ব্যক্তির সম্পর্কে সমস্ত তথ্য এআই ও অ্যাপ মারফত তাঁরা জানে। ভারতেও, আক্রান্তদের খুঁজে বার করতে করোনা অ্যাপ ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে। চিনে তথ্য সংগ্রহের সঙ্গে সঙ্গে, অ্যালগরিদমের মাধ্যমে সেইসব মানুষদের হেলথ কোড দেওয়া হয় -- হলুদ, লাল ও সবুজ। কালার কোড বুঝিয়ে দেয়, সেই লোকটিকে কোয়ারেন্টিন করা হবে কি না, লোকটি গণপরিবহণ ব্যবহার করতে পারবে কি না। এই তথ্য সংগ্রহের বেশিরভাগই নাগরিকদের ইচ্ছায় হয় না। আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স সরকারকে রিপোর্ট দেয়, যে কোনও ব্যক্তি অসংলগ্ন উত্তর দিচ্ছেন কি না, অথবা সোজাসুজি মিথ্যে কথা বলছেন কি না। এরপর কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সরকার গোপনীয়তার রীতিনীতিকে পাশ কাটিয়ে গিয়েছে, আর ফলাফল পেতে মানুষের ফোন, কম্পিউটার, পাবলিক ক্যামেরায় উঁকিঝুঁকি দেওয়ার খোলাখুলি অধিকার দিয়েছে বেসরকারি সংস্থাগুলোকে। চিনে রয়েছে একটি বিস্তৃত ''কালো আয়নার মতো এবং অন্ধকার'' সোশ্যাল ক্রেডিট সিস্টেম, যা প্রতিটি পদক্ষেপ ও আচরণের ওপর নজরদারি চালানোর অনুমতি দেয়। যদি আচরণ রাষ্ট্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, আপনি পুরস্কৃত হবেন, অন্যথায় আপনি ট্রেনেও চাপতে পারবেন না।

পশ্চিমের দিকে যদি তাকাই, ইংল্যান্ডে স্কাই নিউজের রিপোর্ট বলছে, "সরকার মোবাইল পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থা ওটু-র সঙ্গে কাজ করছে স্মার্টফোন লোকেশন বিশ্লেষণ করতে, যাতে বোঝা যায়, মানুষ সামাজিক দূরত্বের নির্দেশ ঠিকমতো অনুসরণ করছেন কি না।" ইজরায়েল একধাপ এগিয়ে মোবাইল নজরদারি ব্যবহার করে গ্রাহকদের মেসেজ পাঠিয়ে বলছে, যে তাঁরা সংক্রমিত, না সংক্রমিত নন। ফেসবুক, গুগলের মতো সোশাল মিডিয়া সংস্থাও সরকারগুলোকে আমাদের তথ্য দিয়ে তাঁদের দায়িত্ব পালন করছে। তাই আপনি যেখানেই থাকুন না কেন, করোনা ভাইরাস সঙ্কট বিগ ব্রাদারকে সুযোগ করে দিয়েছে সবসময় আপনার ওপর নজর রাখার। আর মনে রাখবেন, এটা "জনস্বাস্থ্য আর আপনার ভালোর জন্য"। আর আমাদের তো কিছুই লুকোনোর নেই।

ঝুঁকি ক্রমশ বাড়ছে, কারণ আমেরিকা-চিন বাণিজ্য যুদ্ধ এআই-নির্ভর প্রযুক্তির একটা নতুন দিগন্তে প্রবেশ করেছে। দুটি দেশের কাছেই এআই-নির্ভর নজরদারি এবং মেডিক্যাল প্রযুক্তির বিপুল ক্ষমতা রয়েছে। সিলিকন ভ্যালির বন্ধু নন বলেই পরিচিত ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন কোভিড-১৯-এর জন্য গণনজরদারি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ব্লু ডট নামে একটি সংস্থার সাহায্য নিয়েছেন। শুধু সময়ের অপেক্ষা, যখন মাইক্রোসফটের মতো বিরাট সংস্থাগুলো হোয়াইট হাউসের সঙ্গে সখ্যতা বাড়িয়ে সেইরকম নজরদারি ব্যবস্থা তৈরি করবে, যা আপনার প্রতি মিনিটে হৃদস্পন্দনের তথ্যও সরকারকে দিয়ে দিতে পারে। তথ্য সংগ্রহ করতে, এবং সরকারগুলোকে 'যুদ্ধের' মতো ক্ষমতা দিতে, বিশ্বজুড়ে জরুরি ভিত্তিতে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। ব্লু ডটের কামরান খান একটি বিবৃতিতে সংবাদমাধ্যমকে বলেন, আমরা জানি যে ঠিকসময়ে তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারগুলোকে ভরসা করা যায় না। এতে এই ধরণের টেকনোক্র্যাটরা যে সরকারকে এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কতটা অবিশ্বাস করেন, সেটাই প্রতিফলিত হয়।

"ক্ষমতা দুর্নীতি আনে, আর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নিরঙ্কুশ দুর্নীতি নিয়ে আসে"

কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে আমাদের সরকার এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোর সদিচ্ছায় আমার কোনও সংশয় নেই, কিন্তু যে এআই নির্ভর ব্যবস্থা তাঁরা সৃষ্টি করছেন, তাতে আতঙ্কে আমাদের গায়ে কাঁটা দেয়, এবং আমরা প্রশ্ন করতে বাধ্য হই: কোভিড-১৯ চলে যাওয়ার পর এইসব নজরদারি ব্যবস্থার কী কী হবে? গণ নজরদারি ব্যবস্থা চলে যাবে, না আরও পরিবর্তিত হবে? বিশ্বের নাগরিকরা কি নিশ্চিত হতে পারেন, যে এর অপব্যবহার হবে না?

ফাইভ-জি প্রযুক্তির সঙ্গে, এই ব্যবস্থা অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে উঠবে, আর এর প্রভু আমাদের গ্রহেরও অধিপতি হয়ে উঠবেন। আমরা শুধু লিঙ্কনের সেই কথাটাই ভাবতে পারি, "প্রায় সব মানুষই প্রতিকূলতার মধ্যে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে, কিন্তু যদি তুমি কোনও মানুষের চরিত্রের পরীক্ষা নিতে চাও, তার হাতে ক্ষমতা দাও।" কী হবে আমাদের নেতাদের, যখন একটা বোতাম টিপেই তাঁরা আমাদের মাথার মধ্যে ঢুকে পড়তে পারবেন? এই ব্যবস্থা প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দেবে, আর বিশ্বের 'সিজার'-রা যখন রক্তের স্বাদ পেয়ে যাবেন, তখন প্যারেডটা 'অ্যাসটেরিক্স ও রথ'-এর থেকেও বিরাট হবে (২০১৭ সালে প্রকাশিত কমিকে একটি প্যারেডের দৃশ্যে করোনাভাইরাস শব্দটি দেখা গিয়েছিল।)।

পৃথিবীর মানুষকে সাবধান হতে হবে, কারণ কোভিড-১৯-এর উপশমের আড়ালে আরও বড় বিপদ আনাগোনা করছে। এআই নির্ভর নজরদারি আমাদের অনুমতিক্রমেই আমাদের জীবনে ঢুকে পড়ছে। ভয় যত জাঁকিয়ে বসছে, তত প্রতিবেশীরা একে অপরের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। এশীয় বংশোদ্ভূত মানুষরা হিটলারের ইহুদিতে পরিণত হচ্ছেন। বর্ণবিদ্বেষের খবর যত বাড়ছে, বিশ্বজুড়ে আমরা একটা বিশৃঙ্খলার মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছি। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে, যাতে করোনা ঘৃণা ও আতঙ্কে আর একটা হলোকস্টে না মদত দিতে পারে, যাকে শক্তি জোগাচ্ছে প্রযুক্তি। দুটি বিশ্বযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর পর আমরা এই শিক্ষা পেয়েছি, যে প্রযুক্তি গণহত্যার কাজেও ব্যবহার হতে পারে। গ্যাস চেম্বার হোক বা পরমাণু বোমা, তারা সবাই সেইসময়ের উন্নত প্রযুক্তির নিদর্শন ছিল, যা নারকীয় উদ্দেশ্যে কাজে লাগানো হয়েছে। ইলন মাস্ক এবং স্টিফেন হকিংয়ের মতো প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানজগতের নক্ষত্র, এবং আরও বিজ্ঞানীরা এআই-এর বিপদ নিয়ে বিশ্বকে সতর্ক করেছেন। মাস্ক তো এও বলেছেন, যে এআই পরমাণু অস্ত্রের চাইতেও বেশি বিপজ্জনক। আমাদের এআই নির্ভর প্রযুক্তির যথেচ্ছ ব্যবহার কমাতে হবে, বিশেষ করে সেইসব অ্যাপ্লিকেশনের যা আমাদের গোপনীয়তা এবং অধিকাররগুলোকে লুঠ করে। এআই নির্ভর নজরদারি ব্যবস্থার মতো বেসরকারি টেকনোক্র্যাটিক যন্ত্র গণতন্ত্র, গোপনীয়তা এবং মানবতাকে বিপন্ন করছে। এই সঙ্কট তাদের সমস্ত নিয়মকানুন থেকে মুক্ত করে দেওয়ার অজুহাত হতে পারে না, আমাদের আগেভাগেই এইসব সংস্থা ও প্রযুক্তির সঙ্গে বোঝাপড়ায় আসতে হবে।

আমরা সবাই সহমত, যে করোনা সঙ্কটকে যে কোনও মূল্যে প্রতিহত করতে হবে, কিন্তু আমাদের সাবধানে থাকতে হবে, যাতে ওষুধটাই পরের রোগের কারণ হয়ে না দাঁড়ায় -- নজরদারি চালানো রাষ্ট্র। আজকের আপতকালীন ক্ষমতা, ভবিষ্যতে অপব্যবহারও করা হতে পারে। তাহলে হয় আমাদের স্বাধীনতা রক্ষার্থে সরকারগুলো এআই এবং বেসরকারি ডেটা সংস্থাগুলোকে আইনের আওতায় আনুক, নয়তো একটা অরওয়েলীয় সকালে ঘুম ভেঙে আবিস্কার করুক যে, "যদি তুমি কোনও কিছু গোপন করতে চাও, তাহলে তোমাকে তা নিজের থেকেও লুকিয়ে রাখতে হবে।"

ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.