২০১৭ সালের জুনের সাধারণ নির্বাচনের ঠিক ৩০ মাস পরে চলতি বছরের ১২ ডিসেম্বর ফের ভোট হল ব্রিটেনে । ভোটের মাঠে লড়াইটা ছিল কনজ়ারভেটিভ (টোরিয়েস), লেবার, লিবারাল ডেমোক্র্যাটস, স্কটিশ ন্যাশনাল এবং আরও কয়েকটি ছোটো দলের । আর এই লড়াইয়ে জিতল একটাই দল— ব্রেক্সিট! "ভারতের জামাই" বরিস জনসনের নেতৃত্বে ভোটে লড়া কনজ়ারভেটিভরা ব্রেক্সিটের ঢেউয়ে সওয়ার হয়ে ৬৫০টি আসনের মধ্যে ৩৬৫টি জিতল । এই আসন সংখ্যা গতবারের তুলনায় ৪৭টি বেশি । ব্রেক্সিট বিরোধী ৭০ বছরের জেরেমি করবিনের নেতৃত্বে লেবার পার্টি গতবারের তুলনায় ৫৯টি আসন কম পেয়ে থামল মাত্র ২০৩ আসনে ৷ যা ১৯৩৫ সালের পর থেকে সবচেয়ে খারাপ ফল ।
নির্বাচনী ফলাফল একেবারে সঠিক ভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল জনমত সমীক্ষা । প্রধানমন্ত্রী জনসনের উপর মানুষের প্রবল সমর্থন যেন বুঝিয়ে দিল ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে ব্রিটেনের বিচ্ছেদটা ঠিক কতটা চাইছেন সাধারণ মানুষ । যে বিচ্ছেদের বিষয়টা ২০১৬ সালের জুন থেকে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিল এবং যার জন্য দু’জন প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন । মনে করা হচ্ছে, ৩১ জানুয়ারির সর্বাধিক যে ডেডলাইন দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে এ বার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হবে । সময় বলবে, এর ফলে EU-এর বাঁধন খুলতে শুরু করবে কি না ।
এ কথা স্বীকার করতে কোনও বাধা নেই যে এটা EU-এর ইতিহাসে একটা সন্ধিক্ষণ । এটা সেই EU, যা প্রাদেশিক দেশ নিয়ে গঠিত গোষ্ঠীগুলির মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী । ১৯৫৭ সালে ছয়টি দেশ মিলে তৈরি করে ইউরোপিয়ান ইকনমিক কমিটি (EEC) । ব্রিটেন ১৯৭৩ সালে EEC-র সঙ্গে যুক্ত হয় । গত ছয় দশক ধরে বাড়তে বাড়তে EU পরিণত হয়েছিল ২৮টি দেশের একটি খ্রিস্টান প্রধান ক্লাব । EU-তে কিছুটা ধর্মনিরপেক্ষ এবং আধুনিকমনস্ক মুসলিম রাষ্ট্র টার্কির অন্তর্ভুক্তি নিয়ে বহু বার আলোচনা হলেও তা কোনওদিনই বাস্তবায়িত হয়নি।
ব্রাসেলসের থেকে সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধারে ব্রেক্সিটপন্থীরা উল্লসিত হলেও এতে ব্রিটেনের আনন্দিত হওয়ার কিছু নেই । বস্তুত, এক প্রাক্তন প্রবীণ কূটনীতিকের মতে, এর ফলে ব্রিটেন ক্রমশ মধ্য শক্তিধর দেশে পরিণত হবে । সে দিক থেকে বরং স্কটল্যান্ডের অবস্থান অনকটাই বাস্তবসম্মত । ব্রেক্সিট বিরোধী এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নপন্থী স্কটল্যান্ড এখন স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য দ্বিতীয় বার গণভোটে যেতে চাইছে । স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি সেখানে ৪৮টি আসন পেয়েছে, যা গতবারের তুলনায় ১৩টি বেশি । টোরিয়েসরা পেয়েছে ছ’টি আসন, যা গতবারের তুলনায় সাতটি কম এবং লেবার পার্টি পেয়েছে মাত্র একটি আসন, যা গতবারের তুলনায় ছ’টি কম ।
২০১৪ সালে হওয়া প্রথম গণভোটে ৪৫ শতাংশ স্কটিশ স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন । লন্ডনের উপর বিরক্তি যেন তারপর থেকে আরও বেড়ে গেছে । একইভাবে, ব্রেক্সিটের ফলে নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে সীমান্ত সমস্যা বেড়ে যেতে পারে, যদি জনসন সীমান্ত নিয়ে কড়াকড়ি আরও বাড়িয়ে দেন । জনসন কিন্তু প্রথম থেকেই আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে একটা অদৃশ্য সীমান্ত বজায় রাখার পক্ষপাতী ।
এরপর আছে আর্থিক সমস্যা । বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্রেক্সিট নিয়ে কিছু আধিকারিক রঙিন স্বপ্ন দেখালেও এর বিপরীত প্রভাব ব্রিটেনের অর্থনীতিতে পড়বেই । লন্ডনের ইনস্টিটিউট অব ফিসকাল স্টাডিজ়ের মতে, এর ফলে ব্রিটেনের GDP এক ধাক্কায় ৩ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে । অন্য বেশ কিছু অর্থনীতি বিষয়ক সংস্থা আবার GDP-র পতন আরও বেশি হওয়ার আশঙ্কা করছে ।
পাশাপাশি ব্রিটেনকে সুদৃঢ় অর্থনৈতিক পরিকল্পনা করতে হবে, যাতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অ্যামেরিকা, চিন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক আরও মজবুত হয় । বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞের মতে, বিষয়টি একেবারেই সহজ হবে না । এই রকম একটি আত্মরক্ষামূলক পরিবেশে, যেখানে প্রয়োজনটা মূলত ব্রিটেনের, সেখানে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির মতো বিষয়গুলি হয় অতটা সহজে হবে না ৷ আর তা না হলে বিষয়গুলি ব্রিটেনের সুবিধামতো না হওয়াই স্বাভাবিক ।
EU-এর সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করতে লন্ডনের হাতে সময় আছে মাত্র ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত । ২০১৯ সালের ১৭ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী জনসন এবং EU একটি খসড়া চুক্তিতে সম্মত হলেও সেই খসড়া চুক্তি হাউজ় অব কমন্স খারিজ করে দেয় । এই হাউজ় অব কমন্সে টোরিয়েসরা সংখ্যালঘু । তবে এখন জনসনের পক্ষে জনমত হওয়ায় আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যেতে সুবিধা হওয়ার কথা ।
ব্রেক্সিটের ফলে EU থেকে ইংল্যান্ডে সাধারণ মানুষের (প্রশিক্ষিত অথবা প্রশিক্ষণহীন) অবাধ যাতায়াত বন্ধ হয়ে যাবে । এই বিষয়টা নিয়ে বহু দিন মনে মনে গুমরেছে সাধারণ ব্রিটিশরা । ব্রেক্সিট পরবর্তী সময়ে সে দেশের অভিবাসন ব্যবস্থা হয়ে যাবে যোগ্যতা কেন্দ্রিক । সেখানে দেশের বিচার না করে, যাঁর যোগ্যতা বেশি, তিনি বেশি সুবিধা পাবেন । ফলে ভারতীয় এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোনও দেশের বাসিন্দাদের মধ্যে কোনও বিভেদ থাকবে না । এতদিন পর্যন্ত ভারত এবং EU-এর বাইরের কোনও দেশের বাসিন্দাদের টিয়ার ২ ভিসা দেওয়া হত ।
ভোটে জেতার পরপরই বরিস জনসনকে অভিনন্দন জানিয়ে ভারতে আসার অনুরোধ করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি । ১৩ ডিসেম্বর মোদি টুইট করেন, "বরিস জনসনকে অসংখ্য অভিনন্দন, যেভাবে তিনি একটি অসাধারণ জয় পেলেন । তাঁকে আমার হার্দিক অভিনন্দন । আমি আশা করি এরপর ভারত-ব্রিটেন সম্পর্ক আরও মজবুত হবে ।"
মেরিনা হুইলারের সঙ্গে জনসনের বিয়ে হয়েছিল ২৫ বছর আগে । মেরিনার মা একজন ভারতীয় শিখ । এর ফলে জনসন বহু বার বিভিন্ন কারণে ভারতে এসেছেন । মনে করা হচ্ছে, তিনি খুব শীঘ্রই সরকারি সফরে ভারতে আসবেন ।
এই প্রথম বার ব্রিটিশ কমন্সে ১৫ জন ভারতীয় বংশোদ্ভূত MP রয়েছেন । এর মধ্যে সাত জন কনজ়ারভেটিভ পার্টির সদস্য । ঐতিহাসিক ভাবেই ১৫ লাখ ভারতীয়র বেশিরভাগের সমর্থন থাকে লেবার পার্টির দিকে । কিন্তু কাশ্মীর নিয়ে করবিনের অবস্থানের ফলে এই অংশটা লেবার পার্টি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে । কনজ়ারভেটিভ ফ্রেন্ডস অব ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান টোরি পিয়ের এবং রামি রেঞ্জার বলেন, “এ বার ভারতীয়রা কনজ়ারভেটিভদের ভোট দিয়েছেন । কাশ্মীর নিয়ে লেবার পার্টির নীতি ভারতীয়দের একত্রিত হতে সাহায্য করেছে ।”
ভারতের বিদেশমন্ত্রক লেবার পার্টিকে নিয়ে বিরক্ত ছিল । ভারতীয় হাইকমিশন এবং সে দেশের বিশাল ভারতীয় জনগণ লেবার পার্টির থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় । এমনকী লেবার পার্টির MP এবং সমর্থকদের একটি সংগঠন লেবার ফ্রেন্ডস অব ইন্ডিয়ার দেওয়া নৈশভোজের আমন্ত্রণও গ্রহণ করেনি ভারতীয় হাইকমিশন । ২৯ সেপ্টেম্বর হাইকমিশনের পক্ষ থেকে আয়োজিত ভারতীয় দিবস উদযাপনেও ডাকা হয়নি লেবার পার্টির কোনও প্রতিনিধিকে । বিষয়টা তখনই পরিষ্কার হয়ে গেছিল । ভারতীয় বংশোদ্ভূত ভোটাররা যার পূর্ণ সদব্যবহার করেন ভোটের ময়দানে ।
তৎকালীন EEC, পরবর্তী সময়ে হওয়া ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে অনেক পরে নাম লিখিয়েছিল ব্রিটেন । এবং তারাই সবার আগে প্রস্থান করছে । ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন, যাঁর সময়ে ব্রেক্সিটের গণভোট হয়েছিল, তিনি ‘হ্যাঁ’ ভোট ঠেকাতে অক্ষম হয়েছিলেন । এই ঘটনা ব্রিটেনকে খুব খারাপভাবে বিভক্ত করেছে এবং সম্ভবত সে দেশকে বিভাজনের দিকে ঠেলে দিয়েছে । বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা ব্রিটিশ ঔদ্ধত্যের অবধারিত ফল ।