দিল্লি : আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার তরফে একটি নতুন সমীক্ষা করা হয়েছে । তাতে দেখা গিয়েছে যে 2019 সালে ভারতের জেলগুলিতে বিচারের অপেক্ষায় ছিল 69.০৫ শতাংশ বন্দী । অথচ জেলে একজন বন্দী পিছু রোজ 118 টাকা খরচ হয় ।
প্রিজ়ন স্ট্যাটিসটিক্স ইন্ডিয়া 2019 এর সাম্প্রতিক রিপোর্টের ভিত্তিতে কমনওয়েলথ হিউম্যান রাইটস ইনিসিয়েটিভ (CHRI) এর তরফে দশটি সূচক বিশ্লেষণ করা হয় । আর তা হল, জেলে বন্দীর সংখ্যা, কত শতাংশ বন্দী বিচারাধীন, বিচারধীন বন্দীরা কতদিন ধরে জেলে রয়েছেন, মহিলা ও জেল (বন্দী ও কর্মী সব মিলিয়ে), শিক্ষা, বন্দীদের জাতি ও ধর্ম সংক্রান্ত পরিচয়, জেলের কর্মী, অপরাধ অনুযায়ী বন্দীদের সংখ্যা, জেলে পরিদর্শন, বন্দীদের উপর খরচ এবং জেলে মৃত্যু ।
2019 সালে ভারতের জেলগুলির পরিস্থিতি নিয়ে CHRI যে বিশ্লেষণ করেছিল, তার থেকে 10 টি তথ্য তুলে ধরা হল :
•4.78 লাখ বন্দী রয়েছে এবং জায়গার তুলনায় বেশি বন্দী থাকার হার 18.5 শতাংশ ।
•জেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে 18.8 লাখ বন্দীকে । তাদের মধ্যে 4.3 শতাংশ মহিলা ।
•19913 জন মহিলা বন্দী রয়েছে । এর মধ্যে 1543 জন মহিলার সঙ্গে শিশু রয়েছে । সেই শিশুদের সংখ্যা 1779 ।
•69.05 শতাংশ বন্দী বিচারের অপেক্ষায় রয়েছে । এর মধ্যে এক চতুর্থাংশ ইতিমধ্যে এক বছর জেলে কাটিয়ে ফেলেছে ।
•116 জন বন্দী আত্মহত্যা করেছে । 7349 জন মানসিক অবসাদে ভুগছে ।
•5608 জন বন্দী বিদেশি নাগরিক । তার মধ্যে 832 জন মহিলা ।
•1775 জন বন্দী জেলেই মারা গিয়েছে । এর মধ্যে 1544 জন অসুস্থতা বা বয়সের কারণে মারা গিয়েছে ।
•কর্মীদের মধ্যে 30 শতাংশ পদ শূন্য রয়েছে । জেলের কর্মীদের মোট সংখ্যার মধ্যে মাত্র 12.8 শতাংশ মহিলা ।
•জেলের কর্মীদের সঙ্গে বন্দীদের সংখ্যার অনুপাত 7:1 । বন্দী পিছু সংশোধনকারী কর্মীর অনুপাত 628:1 । বন্দী পিছু স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কর্মীর অনুপাত 243:1 ।
•গড়ে বন্দী পিছু রোজ 118 টাকা করে খরচ করা হয় জেলে ।
CHRI রিপোর্ট অনুযায়ী, 2019 সালে জেলে বন্দী সংখ্যার হার ছিল 118.5 শতাংশ । যা গত পাঁচ বছরে সর্বাধিক ছিল ।
যদি জেলের ধরনের নিরিখে এই পরিসংখ্যান দেখা যায়, তাহলে দেখা যাবে যে জেলার জেলগুলিতে এই হার 129.1 শতাংশ এবং কেন্দ্রীয় জেলগুলিতে এর হার 123.9 শতাংশ ।
রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির ভিত্তিতে দিল্লিতেই সর্বাধিক জেলবন্দী রয়েছে । সেখানে এর হার 174.9 শতাংশ ।
8টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের জেলগুলিতে বন্দীর সংখ্যার হার 150 শতাংশের বেশি । এই রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলি হল, দিল্লি (174.9শতাংশ), উত্তর প্রদেশ (167.9 শতাংশ) , উত্তরাখণ্ড (159 শতাংশ), মেঘালয় (157.4 শতাংশ), মধ্যপ্রদেশ (155.3 শতাংশ), সিকিম (153.8 শতাংশ), মহারাষ্ট্র (152.7 শতাংশ) ও ছত্তিশগড় (150.1 শতাংশ) ।
গত পাঁচ বছরে জেলে বন্দীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে 14.1 শতাংশ । সেই তুলনায় জেলের ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে 10.1 শতাংশ । আর এই বছরগুলিতে বিচারধীন বন্দীর সংখ্যা 17.2 শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে ।
2019 সালের শেষে দেশের 1350 টি জেলে মোট বন্দীর সংখ্যা ছিল 4 লাখ 78 হাজার 600 জন । আর তার মধ্যে বিচারাধীন বন্দীর সংখ্যা ছিল 3 লাখ 30 হাজার 478 জন ।
CHRI এর রিপোর্ট বলছে, ‘‘2015 সাল থেকে 2018 সালের মধ্যে বিশ্বের বন্দীর সংখ্যা 3.7 শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে (বিশ্বের জেলগুলিতে 2019 সালে কত বন্দী ছিল, তার তথ্য পাওয়া যায়নি) ।’’
‘‘2015 সাল থেকে 2018 সালের মধ্যে বিশ্বের জেলগুলিতে 3 লাখ 86 হাজার 485 জন বন্দীকে বিশ্বের জেলগুলিতে পাঠানো হয়েছে । ওই সময়ের মধ্যে ভারতে এই সংখ্যাটা হল 46 হাজার 461 জন (12 শতাংশ) । কারাবাসের হারের নিরিখে এক লাখ জনসংখ্যায় বন্দী রয়েছে 35 শতাংশ । 223 টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান 211 নম্বর স্থানে । বিশ্বের জেল বন্দীর সংখ্যার একটা বড় অংশ ভারতের হলেও এটা দেখিয়ে দিচ্ছে যে জনসংখ্যার নিরিখে সারা বিশ্বের মধ্যে ভারতের কারাবাসের হার অনেক কম ।’’
ওই রিপোর্ট অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে অন্ধ্রপ্রদেশ ও নাগাল্যান্ড, এমন দুইটি রাজ্য যারা তাদের জেলে বন্দীর সংখ্যা কম করতে পেরেছে । 2015 সাল থেকে 2019 সালের মধ্যে 13টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে জেল বন্দীর সংখ্যা 20 শতাংশ বৃদ্ধি হয়েছে । জেলে বন্দীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে সিকিম (59.4 শতাংশ) এবং জম্মু ও কাশ্মীরে (57.6 শতাংশ) ।
CHRI এর বিশ্লেষণ বলছে যে জেলে মোট যত বন্দী আছে তার মধ্যে 68.3 শতাংশ হিন্দু বন্দী । যেখানে দেশে হিন্দু জনসংখ্যা 79.8 শতাংশ । অন্যদিকে মুসলিমদের জনসংখ্যা 14.2 শতাংশ । আর মুসলিম বন্দী রয়েছে 18.3 শতাংশ । 2.3 শতাংশ জনসংখ্যার নিরিখে খ্রিস্টান বন্দীদের হার 2.9 শতাংশ । শিখদের জনসংখ্যা 1.7 শতাংশ। শিখ বন্দীর হার 2.8 শতাংশ । অন্যান্য ধর্মের মানুষের মধ্যে থেকে জেলে বন্দী হওয়ার হার 1 শতাংশ ।
CHRI এর রিপোর্ট বলছে, ‘‘যে কোনও ধর্মের মধ্য থেকে গত পাঁচ বছরে জেলে বন্দীর নিরিখে সবচেয়ে প্রথমে রয়েছে মুসিলমরা । 12.1 শতাংশ মুসলিম জেল বন্দী হয়েছে ।’’
‘‘অন্যদিকে হিন্দু বন্দীদের সংখ্যা কমে গিয়েছে 12.7 শতাংশ । সমস্ত ধর্মের মধ্য থেকে বিচারাধীন বন্দীর নিরিখে সবচেয়ে প্রথমে রয়েছে মুসলিমরা । তাদের ক্ষেত্রে এই হার 70.8 শতাংশ ।’’
তপশিলি জাতিদের জনসংখ্যায় হার 20 শতাংশ । আর বন্দীদের জাতিগত হিসেব ধরলে তাদের হার 21.2 শতাংশ । 11.4 শতাংশ জেল বন্দী তপশিলি উপজাতির অন্তর্ভুক্ত । জনসংখ্যায় তপশিলি উপজাতির হার 9 শতাংশ ।
CHRI এর ডিরেক্টর সঞ্জয় হাজারিকা ETV ভারতকে জানান যে এই বিশ্লেষণ প্রমাণ করছে যে ভারতে ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় ভারসাম্যহীনতা অব্যাহত রয়েছে ।
হাজারিকা বলেন, ‘‘এটা দেখাচ্ছে যে অধিকাংশ মামলাF শেষ হয়নি । ট্রায়াল কোর্টগুলির উপর যে বোঝা তৈরি হচ্ছে, তার জেরে পুরো ব্যবস্থাতেই মামলার বোঝার ভার বৃদ্ধি পাচ্ছে ।’’
CHRI এর এই রিপোর্ট তৈরি করেছেন সিদ্ধার্থ লাম্বা । তিনি সংস্থার প্রজেক্ট অফিসার । তিনি যদিও জানান যে যে 10 টি বিষয়কে উল্লেখ করা হয়েছে । তার নিরিখে কিছু রাজ্য উন্নতি করেছে ।
লাম্বা বলেন, ‘‘জাতীয় স্তরে 10 জনের মধ্যে সাত জনের এখনও দোষীসাব্যস্ত হওয়া বাকি আছে । কিন্তু কিছু কিছু রাজ্য আছে যেখানে এই সংখ্যাটা 10 এর মধ্যে 7 এর নিচে রয়েছে ।’’
তিনি এর সঙ্গে যোগ করেন, ‘‘উদাহরণ হিসেবে অরুণাচলপ্রদেশের কথা বলা যেতে পারে । সেখানে 10 জনের মধ্যে চার জন বন্দী এখনও দোষীসাব্যস্ত হয়নি । অন্যদিকে এই সংখ্যাটা ত্রিপুরা, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে 10 এর মধ্যে 5 ।’’