চেন্নাই: মহাকাশ গবেষণা দপ্তর সম্প্রতি চেন্নাইয়ের একটি ছোট রকেট সংস্থা অগ্নিকুল কসমস প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে, যারা ইসরোর কেন্দ্রগুলির সুযোগসুবিধা ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা পাবে ।
-মহাকাশ দপ্তরের কথায়, ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল স্পেস প্রোমোশন অ্যান্ড অথরাইজেশন সেন্টার (ইনস্পেস) তৈরি হওয়ার পর এধরণের চুক্তি এই প্রথম স্বাক্ষরিত হল । ইনস্পেস হল এমন একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা যা মহাকাশে ভারতের তৎপরতায় বেসরকারি সংস্থাগুলোকেও অংশীদার করবে ।
-এই চুক্তির আওতায় অগ্নিকুল কসমস তাদের লঞ্চ ভেহিকল ও রকেট ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের জন্য ইসরোর কেন্দ্রগুলি থেকে প্রযুক্তিগত সহায়তা পাবে ।
কয়েকদিন পরেই সিজগি স্পেস টেকনোলজিস প্রাইভেট লিমিটেড, যা পিক্সেল বলে পরিচিত, তারা মহাকাশ দপ্তরের বাণিজ্যিক শাখা নিউস্পেস ইন্ডিয়া লিমিটেডের সঙ্গে হাত মিলিয়ে, সামনের বছরের গোড়ার দিকেই ইসরোর পোলার স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল ব্যবহার করে তাদের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহকে মহাকাশে পাঠাবে ।
পিক্সেলের পরিকল্পনা রয়েছে, 2022 সালের শেষের মধ্যেই তাদের 30 টি ছোট আর্থ অবজারভেশন স্যাটেলাইটের ঝাঁক ‘ফায়ারফ্লাই’কে মহাকাশে পাঠানোর ।
আরও পড়ুন : ইসরোর মহাকাশ প্রযুক্তি কোনও ব্যক্তিবিশেষকে দেবে না নিউস্পেস ইন্ডিয়া
এছাড়াও মহাকাশ দপ্তর 3 টি খসড়ানীতি এনেছে– মহাকাশভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থার খসড়ানীতি (স্পেসকম পলিসি 2020), মহাকাশ ভিত্তিক রিমোট সেন্সিং খসড়ানীতি এবং সংশোধিত প্রযুক্তি হস্তান্তর নীতির গাইডলাইন । এগুলোর উদ্দেশ্য, যাতে মহাকাশ ক্ষেত্রে বেসরকারি সংস্থাগুলো আরো বড় ভূমিকা নিতে পারে ।
মহাকাশ দপ্তরের সচিব ও ইসরো চেয়ারম্যানকে শিবন বলেন, যান ও রকেট উৎক্ষেপণ, মহাকাশ অনুসন্ধান সম্পর্কিত নীতি এবং একটি সার্বিক মহাকাশ আইনেরও ঘোষণা করা হবে ।
প্রথমার্ধ কিছুটা নিষ্প্রভ থাকার পর, দ্বিতীয়ার্ধ কিছুটা চিত্তাকর্ষক হয়ে ওঠে, যখন কেন্দ্র সরকার মহাকাশ ক্ষেত্রকে বেসরকারি সংস্থাগুলোর জন্য খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ।
2020-র শুরুতেই শিবন বলেছিলেন যে ইসরো 25 টি উৎক্ষেপণের পরিকল্পনা নিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে-
1.আদিত্য-এল ওয়ান স্যাটেলাইট, জিও ইমেজিং স্যাটেলাইট (জিস্যাট-1)
2.ছোট উপগ্রহ উৎক্ষেপণ যান (এসএসএলভি) বা ছোট রকেটের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন (বহন ক্ষমতা 500 কেজি)
3.দেশে তৈরি পারমাণবিক ঘড়ি সমেত নেভিগেশন স্যাটেলাইট এবং ইন্ডিয়ান ডেটা রিলে স্যাটেলাইট সিস্টেম (আইডিআরএসএস)
4.ইলেকট্রিক প্রোপালশন সমেত জিস্যাট-20 স্যাটেলাইট
আরও পড়ুন : পৃথিবী থেকে সরে দুই শক্তিধরের লড়াই চাঁদ-মঙ্গলের মাটিতেও
শিবন আরও বলেন যে, 2020-21 সালে ভারত তার তৃতীয় চন্দ্রাভিযান, ‘চন্দ্রযান-3’ শুরু করবে এবং চন্দ্রপৃষ্ঠে একটি ল্যান্ডার অবতরণের চেষ্টা করবে ।
-এই বছরটা ইসরোর জন্য ভালোই শুরু হয়েছিল, যখন 17 জানুয়ারি 3357 কেজির যোগাযোগ উপগ্রহ জিস্যাট-30কে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির আরিয়ান স্পেস রকেট আরিয়ান ফাইভের মাধ্যমে উৎক্ষেপণ করা হয় ।
-ইসরো তার রোবট বা হাফ হিউম্যানয়েড ‘বোমমিত্র’কেও সামনে আনে, যা তার মহাকাশে মানুষ পাঠানোর ‘গগনযান’ প্রকল্পের অংশ ।
আরও পড়ুন : কার্টোস্যাট-3 সহ 14টি কৃত্রিম উপগ্রহ নিয়ে মহাকাশে PSLV-C 47
ইসরোর প্রথম ধাক্কাটা আসে 4 মার্চ, যখন প্রযুক্তিগত কারণে জিস্যাট-ওয়ানের উৎক্ষেপণের একদিন আগে তা বাতিল করতে হয় ।
কী ত্রুটি হয়েছিল, এবং তা সংশোধন করা হয়েছে কিনা, সে ব্যাপারে ইসরো এখনও কিছু জানায়নি । এটাও জানা যায়নি যে, দুর্দান্ত ক্যামেরাযুক্ত এই উপগ্রহ কবে উৎক্ষেপণ হবে ।
তারপর দেশ ও দেশের বাইরে কোভিড-19 লকডাউন শুরু হয়ে গেল, ধাপে ধাপে যার প্রভাব পড়ল এসএসএলভি তৈরি, জিস্যাট-1 উৎক্ষেপণের মতো ইসরোর মূল পরিকল্পনাগুলোতে । ভারতের প্রথম হিউম্যান স্পেস ফ্লাইট মিশন গগন যানের পরীক্ষামূলক রকেট উৎক্ষেপণও পিছিয়ে গিয়েছে ।
-এরমধ্যে ইসরোর ক্ষেত্রে দুটো সদর্থক বিষয় ঘটেছে– মহাকাশের জন্য প্রয়োজনীয় পোশাক, বা লিকুইড কুলিং অ্যান্ড হিটিং গারমেন্ট (এলসিএইচজি)-এর ভারতীয় স্বত্ব নিশ্চিত করা এবং হাইল্যান্ড লুনার সয়েল সিমুল্যান্ট বা সাধারণভাবে বললে চাঁদের মাটি তৈরিতে তাদের পদ্ধতির স্বীকৃতি ।
-16 মার্চ কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ ঘোষণা করেন যে, ভারতের মহাকাশ অভিযানে বেসরকারি সংস্থাগুলোও সামিল হবে এবং স্যাটেলাইট, উৎক্ষেপণ ও মহাকাশভিত্তিক পরিষেবাগুলোতে তাদের ভূমিকা পালন করবে ।
-তিনি আরো বলেন যে, বেসরকারি সংস্থাগুলোর জন্য নীতিগত ও নিয়ন্ত্রণমূলক পরিবেশ তৈরি করা হবে । গ্রহান্তরে অভিযান, মহাকাশযাত্রা সহ অন্যান্য ভবিষ্যৎ প্রকল্পগুলোও বেসরকারি ক্ষেত্রের সামনে খুলে দেওয়া হবে, এবং একটি নমনীয় তথ্য নীতি আনা হবে, যার মাধ্যমে বিভিন্ন দিক খতিয়ে দেখার পর প্রযুক্তি সংস্থাগুলোকে রিমোট-সেন্সিং ডেটা দেওয়া হবে ।
24 জুন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা ইন-স্পেস গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়, যার মাধ্যমে ইসরো নতুন প্রযুক্তির গবেষণা ও উন্নয়ন, বিভিন্ন অভিযান এবং মহাকাশচারীদের মহাশূন্যে পাঠানোর কর্মসূচিতে জোর দিয়েছে ।
-ভারতীয় পরিকাঠামোকে ব্যবহার করে বেসরকারি সংস্থাগুলোকে কাজ করার সুযোগ করে দেবে ইন-স্পেস ।
-মহাকাশ দপ্তরের বাণিজ্যিক শাখা নিউ স্পেস ইন্ডিয়া লিমিটেড, মহাকাশ গবেষণার কাজকে সরবরাহ ভিত্তিক মডেল থেকে চাহিদা ভিত্তিক মডেলে পরিবর্তিত করবে, যাতে দেশের মহাকাশ-সম্পদের সম্পূর্ণ ব্যবহার করা যাবে ।
আরও পড়ুন : রঙ্গোলিতে চন্দ্রযান-2, ISRO-কে শুভেচ্ছা সুরাতের শিল্পীদের
স্যাটসার্চের চিফ অপারেটিং অফিসার নারায়ণ প্রসাদ বলেন, “সবথেকে ভালো হল একটা স্বাধীন নিয়ন্ত্রক সংস্থা তৈরি, যা নতুন উঠে আসে বেসরকারি সংস্থাগুলোর কাজের ক্ষেত্র প্রস্তুত করবে ।” তিনি আরো বলেন, স্বাধীন নিয়ন্ত্রক সংস্থা থাকলে একবারের ঘোষণার বদলে নিয়মিত পর্যালোচনা ও সংস্কারের জায়গা তৈরি হবে ।
-বর্তমান ব্যবস্থা অনুযায়ী, ইন-স্পেসের প্রযুক্তি, আইনি, নিরাপত্তা বিষয়ে নিজস্ব অধিকরণ থাকবে, যা নজরদারির পাশাপাশি বেসরকারি ক্ষেত্রের চাহিদাগুলোও খতিয়ে দেখবে এবং সমন্বয়সাধন করবে ।
-শিবন বলেছেন, ইন-স্পেসের নিজস্ব বোর্ড থাকবে, এবং শিল্পমহল, শিক্ষাজগৎ ও সরকারের প্রতিনিধিরা থাকবেন ।
তাঁর মন্তব্য, “শুরুতে ইন-স্পেসে বর্তমান ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত মানুষরাই থাকবেন । পরে বাইরের লোকেদেরও নেওয়া হবে । মহাকাশ দপ্তরের জন্য বাজেট বরাদ্দ থেকে এর নিজস্ব তহবিল গঠন হবে । নতুন সংস্থায় খুব বেশি অর্থ বরাদ্দ নাও থাকতে পারে ।”
-এরমধ্যে ইসরো 7 নভেম্বর তাদের স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ কর্মসূচি ফের শুরু করেছে । পোলার স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল ব্যবহার করে ভূ-পর্যবেক্ষক উপগ্রহ ইওএস-1, আগে যার নাম ছিল রিস্যাট-টুবিআরটু ও অন্যান্য 9 টি বিদেশি স্যাটেলাইটকে কক্ষপথে পাঠিয়েছে ।
-এই নিয়ে ইসরো মোট 328 টি বিদেশি স্যাটেলাইটকে মহাকাশে পাঠাল, যার সবকটির ক্ষেত্রেই ফি নেওয়া হয়েছে ।
-17 ডিসেম্বর ইসরো তার পিএসএলভি-সি50 রকেটের সাহায্যে মহাকাশে পাঠিয়েছে ভারতের 42 তম যোগাযোগ উপগ্রহ সিএমএস-1কে (আগে নাম ছিল জিস্যাট-12আর) ।
এটাই ছিল 2020তে ভারতের শেষ স্পেস মিশন । শিবন বলেছেন যে, 2021 সালের প্রথম ত্রৈমাসিকেও ইসরো ব্রাজ়িলের আমাজ়োনিয়া স্যাটেলাইটের বাণিজ্যিক উৎক্ষেপণের মাধ্যমে আয় করবে । পাশাপাশি 3 টি ভারতীয় উপগ্রহকেও পাঠানো হবে ।
আরও পড়ুন : মহাকাশে নজরদারি, নিরাপত্তায় এবার নিজস্ব উপগ্রহ ভারতীয় সেনার
শিবন বলেছিলেন, “ফেব্রুয়ারির শেষে অথবা মার্চের শুরুতে আমরা আমাদের পোলার স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল সি-51 (পিএসএলভি-সি51) মহাকাশে পাঠাব । মূল পে লোড হিসেবে থাকবে ব্রাজ়িলের ভূ-পর্যবেক্ষক স্যাটেলাইট আমাজ়োনিয়া ।”
তিনি যোগ করেন, “পিএসএলভি-সি51 মিশন ইসরোর কাছেই শুধু নয়, দেশের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ, তার কারণ এই রকেটে থাকবে ‘আনন্দ’ নামে একটি ভূ-পর্যবেক্ষক উপগ্রহ, যা তৈরি করেছে পিক্সেল নামে 1 টি ভারতীয় সংস্থা (সিজগি স্পেস টেকনোলজিস নামে নথিভূক্ত)” ।
এই মিশনে থাকবে যোগাযোগ উপগ্রহ স্যাটিস্যাট, যা তৈরি করেছে চেন্নাইয়ের স্পেস কিডজ ইন্ডিয়ার পড়ুয়ারা । থাকবে তিনটি ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একসঙ্গে তৈরি করা ইউনিস্যাটও ।
শিবনের কথায়, আদিত্য এলওয়ান উপগ্রহ উৎক্ষেপণ, চন্দ্রযান-3, মহাকাশচারীদের নিয়ে গগনযান ও এসএসএলভি তৈরির আগে ইসরোর রীতিমতো ব্যস্ত কর্মসূচি রয়েছে ।
-শিবন আরও বলেন যে, এসএসএলভি বহন করবে ইওএস-02-কে (ভূ-পর্যবেক্ষক উপগ্রহ) আর জিওসিনক্রোনাস স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল-এফ10 (জিএসএলভি) নিয়ে যাবে ইওএস-3-কে ।
-অন্যান্য যে উপগ্রহগুলি উৎক্ষেপণের জন্য তৈরি, তা হল জিআইস্যাট ও মাইক্রোস্যাট-টুএ ।