দার্জিলিং, 25 নভেম্বর: উন্নত শিরে দাঁড়িয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা ৷ তাকে সঙ্গী করেই কু ঝিকঝিকে চেপে 'অ্যাঁকাব্যাঁকা রাস্তা ধরে' এগিয়ে চলা পাহাড়ি পথে ৷ 'টুং, সোনাদা, ঘুম পেরিয়ে' গায়ে মেখে নেওয়া বাতাসিয়া লুপের সোনা রোদ ৷ ঐতিহ্যবাহী টয়ট্রেন যেন শৈশবের দার্জিলিংয়ের স্মৃতির ছায়াসঙ্গী ৷ ব্রিটিশ আমলের এই গৌরবের ইতিহাস আজও সযত্নে লালিত ৷ টয়ট্রেনের হেরিটেজ শিরোপার এবার 25 বছর পূর্তি ৷ তারই উদযাপনে একাধিক নয়া চমক নিয়ে হাজির দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে ৷ চাক্ষুস করা যাবে টয়ট্রেনের 100 বছরের পুরনো ইঞ্জিন ৷
দার্জিলিং ! এই নামটা মাথায় এলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সবুজে ঘেরা শৈলরানি, বাতাসিয়া লুপ আর পাহাড়ের পাকদণ্ডি দিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে ছুটে চলা টয়ট্রেন । মনে পড়ে যায় সইফ আলি খান আর বিদ্যা বালন অভিনীত পরিণীতা ছবির সেই নেপালি গানের প্রিলিউট, 'কস্তো মাজা হ্যায় রেলাইমা, রেমাইলো উকালি উরালি'। দার্জিলিংয়ের টয়ট্রেন বিশ্বের পর্যটনের দরবারে এক বহুল প্রচলিত নাম । যার টানে বারে বারে দেশ বিদেশ থেকে পর্যটকরা ছুটে আসেন । আজও এটি পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ৷ দার্জিলিংয়ের টয়ট্রেন হেরিটেজ শিরোপা নিয়ে নিজের ইতিহাসকে গৌরবের সঙ্গে ধরে রেখেছে ।
টয়ট্রেনের হেরিটেজ শিরোপার 25 বছর পূর্তি উদযাপনে চমক (নিজস্ব ভিডিয়ো) টয়ট্রেনের ইতিহাস
1878 সালে কলকাতার সঙ্গে প্রথম শিলিগুড়ি মিটার গেজ রেললাইনের মাধ্যমে যুক্ত হয় । কিন্তু সেই সময় শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং যাওয়ার জন্য ঘোড়ায় টানা টাঙা গাড়ি ছাড়া আর কোনও অবলম্বন ছিল না । সেইসময় ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানির এক এজেন্ট রেলপথে দার্জিলিংকে যুক্ত করার প্রস্তাব দেন । তৎকালীন গভর্নর অ্যাশলে ইডেন সেই প্রস্তাবে ছাড়পত্র দেন । কিন্তু মিটারগেজের ট্রেন ভারী হওয়ার কারণে ন্যারো গেজের ট্রেন চালানোর উদ্যোগ নেওয়া হয় । গভর্নরের সবুজ সংকেতের পর গিলেন্ডারস আরবাথনট অ্যান্ড কোম্পানি এই রেলপথ নির্মাণ করার কাজ শুরু করে ।
1999 সালের ইউনেস্কো ডিএইচআরকে হেরিটেজ শিরোপা দেয় (নিজস্ব চিত্র) 1880 সালের 23 অগস্ট শিলিগুড়ি-কার্শিয়াং অংশটি চালু হয় । তারপর দার্জিলিং পর্যন্ত লাইনের সম্প্রসারণ করে 1881 সালের 4 জুলাই শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং লাইন চালু হয় । 88 কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে ওই ন্যারো গেজ রেললাইনে । প্রায় 7,200 ফুট উচ্চতায় অবস্থিত ঘুম বিশ্বের সর্বোচ্চ রেলস্টেশন । স্বাধীনতার পর টয়ট্রেনকে ভারতীয় রেল উত্তর পূর্ব সীমান্ত রেলের অধীন দার্জিলিং হিমালয়ান রেলের আওতায় নিয়ে আসে । 1934 সালে ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষতি হয় টয়ট্রেনের । কিন্তু তার পরেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সমস্ত ক্ষতি কাটিয়ে এই টয়ট্রেন সেনাবাহিনীকে খাবার ও সামগ্রী পৌঁছে দেওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । 1999 সালের 5 ডিসেম্বর ইউনেস্কো ডিএইচআরকে হেরিটেজ শিরোপা প্রদান করে ।
টয়ট্রেনের প্রভাব
শুধু পাহাড়ের নয়, গোটা উত্তরবঙ্গের পর্যটন, আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে এই টয়ট্রেনের প্রভাব রয়েছে । টয়ট্রেনের টানেই প্রতি বছর দেশ বিদেশের অগণিত পর্যটক ছুটে আসেন । গড়ে প্রতি বছর ন্যূনতম পাঁচ লক্ষ পর্যটক এই টয়ট্রেনে ভ্রমণ করেন । আর টয়ট্রেনের কারণেই পাহাড়ে পর্যটনে প্রসার ঘটেছে । আরও বেশি সংখ্যক পর্যটক এই টয়ট্রেনের কারণে শৈলরানি দার্জিলিং-সহ গোটা পাহাড় ঘুরতে আসেন ।
টয়ট্রেনের হেরিটেজ শিরোপার 25 বছর পূর্তি (নিজস্ব চিত্র) টয়ট্রেনের পরিষেবা
বিদেশি পর্যটকদের জন্য চার্টার্ড সার্ভিসের পাশাপাশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে রেড পান্ডা সাফারি, শিলিগুড়ি থেকে তিনধারিয়া পর্যন্ত জঙ্গল টি সাফারি, তিনধারিয়া থেকে দার্জিলিং ইভনিং জয়রাইড, দার্জিলিং থেকে ঘুম পর্যন্ত জয়রাইড এবং এনজেপি থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত টয়ট্রেনের পরিষেবা রয়েছে । এইসব পরিষেবার জন্য 13টি স্টিম ইঞ্জিন ও ছয়টি ডিজেল ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়ে থাকে । এছাড়াও ভিস্তাডোম কামরা, চার্টার্ড কামরা রয়েছে । সিনেমার শ্যুটিংয়ের জন্যও টয়ট্রেন ভাড়া দেওয়া হয়ে থাকে । পরিণীতা ও বরফির মতো ফিল্মে এই টয়ট্রেনেই শুটিং হয়েছে । টয়ট্রেনের সমস্ত বুকিং বর্তমানে অনলাইনে হয় ।
প্রতিবন্ধকতা
টয়ট্রেনের পরিষেবার ক্ষেত্রে মাঝেমধ্যেই নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়তে হয় রেল কর্তৃপক্ষকে । 2017 সালে পৃথক রাজ্য গোর্খাল্যান্ডের আন্দোলনের সময় 18 মাস টয়ট্রেন পরিষেবা বন্ধ রাখা হয়েছিল । এছাড়াও পাহাড়ে মাঝেমধ্যেই ধসের ঘটনা ঘটে থাকে। চলতি বছরে তিনধারিয়া, মহানদী-সহ একাধিক জায়গায় ধসের কারণে চার মাস টয়ট্রেন পরিষেবা বন্ধ ছিল । এছাড়াও হেরিটেজ হওয়ার কারণে টয়ট্রেনের ইঞ্জিনগুলো ব্রিটিশ আমলের । ফলে কোনও যান্ত্রিক ত্রুটি হলে সেই ইঞ্জিন সারাতে বেশ বেগ পেতে হয় রেল কর্তৃপক্ষকে ।
100 বছরের পুরনো ইঞ্জিন তুলে ধরা হবে পর্যটকদের মাঝে (নিজস্ব চিত্র) প্রচারের আলোয় আনতে উদ্যোগ
টয়ট্রেনকে আরও বেশি প্রচারের আলোয় আনতে 2020 সাল থেকে ঘুম উৎসবের সূচনা করা হয়েছে । যেখানে দার্জিলিং হিমালয়ান রেল এবং টয়ট্রেনের ব্রিটিশ আমলের ইতিহাসকে পর্যটকদের সামনে তুলে ধরা হয় । চালানো হয় স্পেশাল জয়রাইড । সঙ্গে থাকে পাহাড়ের লোকসংস্কৃতির নাচ-গান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান । চলতি বছরেও একইভাবে 30 নভেম্বর থেকে ওই ফেস্টিভ্যালের সূচনা করা হবে । সেখানে 100 বছরেরও বেশি সময় পুরনো ব্রিটিশ আমলের তিনটি স্টিম ইঞ্জিনের ইতিহাসকে তুলে ধরা হবে ।
দার্জিলিং হিমালয়ান রেলের ডিরেক্টর প্রিয়াংশু বলেন, "ডিএইচআর টয়ট্রেন আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও গর্বের জিনিস । আমরা সবসময় এই হেরিটেজ শিরোপাকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে থাকি । সেইসঙ্গে পর্যটকদের জন্য নানা নতুন পরিষেবা রাখা হয় । আগামীতেও এই পরিষেবা যাতে ভালোভাবে চলে সেদিকে সবসময় রেল কর্তৃপক্ষ তৎপর থাকে । আধিকারিক থেকে কর্মী মিলিয়ে ডিএইচআরের অধীন প্রায় পাঁচশোরও বেশি কর্মীর অবদান রয়েছে ।"
পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু টয়ট্রেন (নিজস্ব চিত্র) কয়েকদিন আগে অস্ট্রেলিয়া থেকে আগত এক পর্যটক জোসেফিন ক্রেসওয়েল বলেন, "আমি গতবারও এসেছিলাম । এত ভালো লেগেছিল যে এবার বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে এসেছি । টয়ট্রেনে চড়ার একটা আলাদাই অনুভূতি রয়েছে । যেন আমরা ইতিহাসে ফিরে যাই । এক রোমহষর্ক অনুভূতি ।"
টয়ট্রেনের হেরিটেজ শিরোপা ধরে রাখতে কম সমস্যায় পড়তে হয় না রেল কর্তৃপক্ষকে । তবে সমস্যা যতই থাক, ব্রিটিশ আমলের এই গৌরবের ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখতে সর্বদা সচেষ্ট রেল কর্তৃপক্ষ । আগামীতে সুচারুভাবে এই টয়ট্রেনের যাত্রা চলুক আর টয়ট্রেনের টানে বারেবারে ছুটে আসুন পর্যটকরা, এই আশাই রাখছে পর্যটনমহল ।