কলকাতা, 29 জুন: বউবাজারে মোবাইল চোর সন্দেহে যুবককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ ৷ তদন্তে নেমেই ছাত্রাবাসের আবাসিক ও প্রাক্তন ছাত্র-সহ 14 জনকে গ্রেফতার করলেন কলকাতা পুলিশের হোমিসাইড বিভাগের গোয়েন্দারা । তাদের আজ আদালতে পেশ করা হবে ৷ পাশাপাশি এই ঘটনায় ধৃতদের প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে চাঞ্চল্যকর তথ্য এল লালবাজারের হাতে ।
কলকাতা পুলিশের হোমিসাইড বিভাগ সূত্রে খবর, শুধু ইরশাদ আলমকে চোর সন্দেহে 'পিটিয়ে' হত্যা নয়, দাগী অপরাধীদের মতো ঘটনার পর যাবতীয় তথ্য প্রমাণ লোপাট করার চেষ্টা করে অভিযুক্তরা ৷ নির্মলচন্দ্র সেন স্ট্রিটের যে ছাত্রাবাসে এই ঘটনা ঘটেছে তার পাশেই রয়েছে একাধিক দোকান ৷ সেখানকারই একটি কম্পিউটারের দোকানে সিসিটিভি লাগানো রয়েছে ৷ সেই ক্যামেরায় ঘটনার দিনে যখন টানতে টানতে যুবককে ছাত্রাবাসে নিয়ে আসা হয়, সেই দৃশ্য ধরা পড়েছে ৷ ছাত্রাবাসের পার্শ্ববর্তী ওই দোকানে ঢুকে সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ডিলিট করে দেওয়া হয়েছিল । আর এই কাজ করেছিল ধৃত পড়ুয়ারাই বলে পুলিশের তরফে জানা গিয়েছে ।
লালবাজার সূত্রে খবর, এই ঘটনার তদন্তে পুলিশের হোমিসাইড বিভাগের গোয়েন্দারা আজ সকালে সংশ্লিষ্ট দোকানে আসেন এবং দোকানের মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছেন, যখন ওই যুবককে হোস্টেলে ঢুকে মারধর করা হচ্ছিল তারপরে 14 থেকে কুড়ি জন ছাত্র তাঁর দোকানে এসে কার্যত জবরবস্তি করে সেখানে থাকা সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ চেক করতে চায় । তারা ফুটেজে বের করে দেখতে পায় যে, ইরশাদ আলম নামে ওই যুবককে টানতে টানতে হোস্টেলের ভেতর ঢোকানো হচ্ছে, সেই ভিডিয়ো দোকানের সিসিটিভি ক্যামেরায় বন্দি হয়ে গিয়েছে । দোকান মালিকের কথা অনুযায়ী, ওই পড়ুয়াদের মধ্যে বেশ কয়েকজন তাঁর কম্পিউটারে বসে দোকানের সিসিটিভি ক্যামেরার সেই ভিডিয়ো ডিলিট করে দেয় ।
জানা গিয়েছে, ইতিমধ্যেই ইরশাদ আলমের ময়নাতদন্তের প্রাথমিক রিপোর্ট লালবাজারের গোয়েন্দাদের হাতে এসেছে । সেই রিপোর্ট অনুযায়ী, যুবককে ভোতা এবং ভারী কিছু দিয়ে মাথায় বারংবার আঘাত করা হয় । তাঁর পায়ে এবং হাঁটুতে একাধিকবার আঘাত করে দুটি পা ভেঙে দেওয়া হয় । পরে যুবকের হাত এবং বুকেও মারধর করা হয় । চিকিৎসকদের সঙ্গে পুলিশ কথা বলে জানতে পেরেছে, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে ইরশাদের মৃত্যু হয়েছে । যদিও ময়নাতদন্তের পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট আসতে কয়েক ঘন্টা সময় লাগবে বলে জানা গিয়েছে ।
এই বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কলকাতা পুলিশের হোমিসাইড বিভাগের এক উচ্চপদস্থ আধিকারিক বলেন, "ঘটনার খবর পেয়ে সেদিন যখন পুলিশ ছাত্রাবাসে ঢুকতে যায় সেখানে আধিকারিকদের কার্যত দাঁড় করিয়ে রাখা হয় । কিছুটা দেরিকে সেখানে প্রবেশ করতে হয় পুলিশকে । ফলে পুলিশ যদি আগে সেখানে ঢুকতে পারতো সেক্ষেত্রে তাড়াতাড়ি ইরশাদ আলমকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যেত ৷ আর তা হলে হয়তো চিকিৎসার সুযোগ পেতেন তিনি এবং প্রাণেও বেঁচে যেতেন ৷"
জানা গিয়েছে, ধৃতদের বিরুদ্ধে খুন, তথ্য প্রমাণ লোপাট, অস্ত্র আইন-সহ একাধিক ধারা চাপিয়েছে কলকাতা পুলিশ । হোমিসাইড বিভাগের গোয়েন্দাদের পাশাপাশি স্থানীয় মুচিপাড়া থানার তরফ থেকেও এই ঘটনায় একটি পৃথক তদন্ত চলছে । ওই তদন্তের প্রক্রিয়ার শীর্ষে রয়েছেন কলকাতা পুলিশের ডিসি(সেন্ট্রাল)-সহ বেশ কয়েকজন অ্যাসিস্ট্যান্ট পুলিশ কমিশনার পদমর্যাদার আধিকারিক । এই ঘটনার আর কারা কারা যুক্ত রয়েছে, তাও খতিয়ে দেখছেন লালবাজারের গোয়েন্দারা । শুক্রবার রাতে ঘটনাস্থলে তল্লাশি চালিয়েছে পুলিশ ৷ সেখান থেকে ক্রিকেট খেলার একাধিক ব্যাট উদ্ধার হয়েছে বলে জানা গিয়েছে ।
লালবাজার সূত্রে খবর, উদ্ধার হওয়া ব্যাটগুলির মধ্যে একটি ব্যাট ভাঙা অবস্থায় মিলেছে । ইতিমধ্যেই সংশ্লিষ্ট ছাত্রাবাসে তল্লাশি অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে অভিযুক্তদের চিহ্নিতকরণের চেষ্টা করছে পুলিশ । এই বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের এক উচ্চপদস্থ আধিকারিক বলেন, "আমরা ছাত্রাবাসের প্রত্যেকের বয়ান পৃথক পৃথকভাবে নেওয়ার চেষ্টা করছি এবং সেই বয়ান একে অপরের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করছি । তাঁদের বক্তব্যে কোনওরকমের অসংগতি মিললে পদক্ষেপ নেওয়া হবে ।" এছাড়াও মৃতের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও ইতিমধ্যেই কথা বলেছেন তদন্তকারীরা । মৃতের পরিবারের সদস্যের অভিযোগ, যুবককে হাত-পা বেঁধে ছাত্রাবাসে নিয়ে গিয়ে নির্মম অত্যাচার করা হয়েছে ।
শুক্রবার মোবাইল ফোন চোর সন্দেহে নির্মলচন্দ্র সেন স্ট্রিটের একটি ছাত্রাবাসে নিয়ে গিয়ে যুবককে হাত-পা বেঁধে গণধোলাইয়ের অভিযোগ ওঠে ৷ ঘটনায় মৃত্যু হয় বেলগাছিয়ার বাসিন্দা ইরশাদ আলম (37) নামে ওই যুবকের ৷ হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, যুবকের বুকে, হাতে এবং মাথায় গভীরভাবে আঘাতের চিহ্ন ছিল । তাঁর পা ভেঙে গিয়েছিল বলেও খবর ৷ এলাকার বাসিন্দারা প্রথমে পুলিশকে খবর দেয় ৷ স্থানীয় বউবাজার থানা এবং মুচিপাড়া থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে ওই যুবককে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসে ৷ কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি ৷ চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন ।
নির্মলচন্দ্র সেন স্ট্রিটের আগে খাস কলকাতায় যাদবপুর-সহ একাধিক ছাত্রাবাসে অত্যাচারের অভিযোগ সামনে এসেছে ৷ এর ফলে পুলিশ নড়েচড়ে বসেছে ৷ শুক্রবারের ঘটনার পর শহরের বাকি সরকারি ছাত্রাবাসগুলিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা খতিয়ে দেখা হচ্ছে ৷ ছাত্রাবাসে একের পর এক ঘটনা কেন ঘটছে তার তদন্তে নেমেছে লালবাজার ৷