আসানসোল, 29 জুলাই: ফের নতুন ক'রে বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যুর গল্প প্রতিস্থাপিত করার চেষ্টা শুরু হয়েছে । প্রতিবছর জানুয়ারি আর অগাস্ট মাস এলেই এই দাবি উঠতে শুরু করে । এবছর অগাস্ট আসার আগেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে চিঠি দিয়েছেন নেতাজির পরিবারের সদস্য চন্দ্রকুমার বসু । তিনি দাবি করেছেন, 1945 সালের 18 অগাস্ট বিমান দুর্ঘটনাতেই নেতাজির মৃত্যু হয়েছে । শুধু তাই নয়, রেনকোজি মন্দিরে রাখা চিতাভস্ম দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকারের কাছে অনুরোধ করেছেন তিনি । আর চন্দ্রকুমার বসুর এই দাবির পরেই ফের ক্ষুব্ধ নেতাজির গবেষক ও নেতাজিপ্রেমীরা ।
নেতাজি গবেষক জয়ন্ত চৌধুরী (নিজস্ব ভিডিয়ো) বিশিষ্ট নেতাজি গবেষক তথা লেখক ও মুখার্জি কমিশনের সাক্ষ্যদাতা জয়ন্ত চৌধুরী যুক্তি দিয়ে ইটিভি ভারতকে বলেন, "1945 সালের 18 অগাস্ট গোটা পৃথিবীতে সামরিক বা অসামরিক কোনও বিমান দুর্ঘটনাই ঘটেনি । বিমান দুর্ঘটনায় তাই নেতাজির মৃত্যুর গল্প একটি সর্বৈব মিথ্যে । এই গল্প নেতাজির পরিকল্পনাতেই সাজানো হয়েছিল ।"
ইটিভি ভারতকে বিশেষ সাক্ষাৎকারে নেতাজির গবেষক জয়ন্ত চৌধুরী বলেন, "বিভিন্ন সময়ে যে তদন্ত হয়েছে, সে তদন্ত রিপোর্টগুলো যদি আমরা দেখি, তাহলে প্রত্যক্ষদর্শী বলে যাঁরা নিজেদেরকে দাবি করছেন, তাঁরা বিভিন্ন কথা বলে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছেন । কেউ বলছেন, প্লেনটা উপরে ওঠার পরে ভেঙে পড়েছে, কেউ বলছেন অনেক উঁচু থেকে ভেঙে পড়েছে, কেউ বলছেন টেকঅফ করার আগেই ভেঙে গিয়েছে । মৃত্যুর সময় নিয়েও অনেক ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে । কেউ বলছেন, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু রাত আটটায় মারা গিয়েছেন, কেউ বলছেন রাত 12টায় তিনি প্রয়াত হন ৷ একেক জন একেক রকম কথা বলেছেন । একজন মানুষের মৃত্যু হলে একটাই দিন হবে, একটাই সময়ে হবে, একটাই কারণে হবে । কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটেছে ।
18 অগাস্ট আমরা সামরিক বাহিনীর শ্মশানের যে রিপোর্ট পাই, তাতে আমরা দেখি সামরিক বাহিনীর ইচিরো অকুরো নামে এক বাইশ বছরের যুবক মারা গিয়েছে । সেটাকেই নেতাজি বলে চালানোর চেষ্টা হয়েছে । একাধিক ডেথ সার্টিফিকেট বানানো হয়েছে । তাতেও নানা বিভ্রান্তি ।
চিতাভস্ম নিয়ে নেতাজির পরিবারের কথা বলতে গিয়ে গবেষক জয়ন্ত চৌধুরী বলেন, "নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর দাদা শরৎচন্দ্র বসু, সুরেশচন্দ্র বসু, সুনীল বসু - এরা কেউই মানেনি চিতাভস্মের গল্প । গান্ধিজিতো মানেনইনি । এমনি জওহরলাল নেহেরু বলেছিলেন, নেতাজির মৃত্যুর কোনও প্রমাণ নেই । নেতাজির সেজদাদা সুরেশচন্দ্র বসু প্রমাণ করেছিলেন, বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু হয়নি । এমনকি ওই প্লেনে নেতাজির সহযাত্রী বলে কথিত হবিবুর রহমান অ্যাঙলো অ্যামেরিকান ফোর্সকে বিভ্রান্ত করতে মৃত্যুর নানা সময় বলেছিলেন । কিন্তু পাকিস্তানে গিয়ে তিনিই সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেন, 1945 সালের 18 অগাস্ট কোনও বিমান দুর্ঘটনাই ঘটেনি । অ্যাঙলো আমেরিকান ফোর্স প্রথমে বিশ্বাস করলেও পরবর্তীকালে তাঁদের চিন্তাভাবনার পরিবর্তন ঘটে এবং তাঁরা বুঝতে পারেন যে, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস অ্যাংলো আমেরিকান ফোর্সকে বিভ্রান্ত করতেই এই প্লেন দুর্ঘটনার গল্পের পরিকল্পনা করেছিলেন ।''
তদন্ত কমিটির রিপোর্ট নিয়ে বলতে গিয়ে গবেষক ও মুখার্জি কমিশনের ডিপোনেন্ট জয়ন্ত চৌধুরী জানান, "আমরা শাহনাজ এবং খোসলা কমিটি কমিশনের রিপোর্ট দেখেছি । সেই দুটি কমিশনেরই রিপোর্ট একপেশে ছিল। তারা গভীরভাবে অনুসন্ধান করেননি কিন্তু মুখার্জি কমিশনের ডিপোনেন্ট হিসেবে আমি অনেক তথ্য দেখেছি । জাস্টিস মনোজকুমার মুখোপাধ্যায় সঠিকভাবে রায় দিয়েছিলেন যে. সেদিন কোনদিন অন্তর ঘটনার ঘটেনি। তাইওয়ান সরকারের তাইপে'র মেয়র কিন্তু লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন তাদের রেকর্ডে এরকম কোনও বিমান দুর্ঘটনার তথ্য নেই।"
জাপানের রেনকোজি মন্দিরে থাকা চিতাভস্ম নিয়ে গবেষক জয়ন্ত চৌধুরী জানান, "অ্যাঙলো আমেরিকান গোয়েন্দার রিপোর্টে স্পষ্ট উঠে এসেছে যে চিতাভস্ম রেনকোজি মন্দিরে রাখা হয়েছে তা মানুষের নয়, কোন পশুর হতে পারে । জাস্টিস মনোজ মুখার্জিও বলেছিলেন, চিতাভস্মের কথা পরে, যেখানে সেদিন সারা পৃথিবীতে কোনও বিমান ভেঙে পড়েনি, সেখানে মৃত্যুর গল্প আসে কোথা থেকে। তাই পরিবারের মানুষজন তাঁর মৃত্যু নিয়ে মিথ্যাচারের গল্পের থেকে যদি নেতাজি আদর্শ প্রচারে এগিয়ে আসেন। তাহলে দেশবাসী তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবেন ।"