কলকাতা, 24 নভেম্বর:শহরের এক পাঁচতারা হোটেলে চলছে শিল্পী নাতাশা দত্ত রায়ের একক চিত্র প্রদর্শনী । নারী ও প্রকৃতিকে সম্বল করেই তাঁর দুটি সোলো সিরিজ রয়েছে 'কমিউভার' চিত্র প্রদর্শনীতে । নাতাশা দত্ত রায় পেশায় একজন শিশু সুরক্ষা পরামর্শদাতা, আর নেশায় শিল্পী । নিজের শিল্পীসত্ত্বা নিয়ে নানা কথা জানালেন ইটিভি ভারতকে ৷
ইটিভি ভারত: কবে থেকে আঁকার হাতেখড়ি ?
নাতাশা: ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকি । ক্লাস ফাইভে আঁকার স্কুলে ভর্তি হই । তারপর ক্লাস সেভেনে শিলচর, অসমের শিল্পী শ্যামল সেনের কাছে টানা 6 বছর ছবি আঁকা শিখেছি । উনি যেভাবে যা শিখিয়েছেন, সেটাই আমার শিল্পী হওয়ার সম্বল ।
শিল্পী নাতাশা দত্ত রায়ের প্রদর্শনী (নিজস্ব ভিডিয়ো) ইটিভি ভারত: আঁকা নিয়ে উচ্চশিক্ষা কোথায় ?
নাতাশা: আমার ছবির পুরো প্রশিক্ষণ বাড়িতেই, শিল্পী শ্যামল সেনের কাছে । প্রথমে কিছু বছর বঙ্গীয় সঙ্গীত পরিষদ থেকে, পরে ললিত কলায় বিশারদ (ফিফথ ইয়ার) সুরনন্দন ভারতী থেকে । এরপর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন জেইউ পেইন্টিং ক্লাবের সক্রিয় সদস্য ছিলাম ।
বর্তমানে শিল্পী মিহির কয়ালের তত্ত্বাবধানে আর্ট হাইভ গ্যালারির স্টুডিয়োতে নিয়মিত চর্চা করি ।
ইটিভি ভারত:শিল্পী হিসেবে পরিপক্ক হতে কে বা কোন জিনিসটা বেশি সাহায্য করেছে ?
নাতাশা: আমার গুরু শ্যামল সেন ছোটবেলায় কখনও বলতেন না যে কী আঁকব । উনি এসে একটি কবিতা বা গানের কিছু লাইন শোনাতেন, আর তা শুনে তাঁর ছাত্রছাত্রীদের মনে যে ছবিটা ভেসে উঠত, আমরা সেইটাই আঁকতাম । উনি তারপর সেটাই কারেকশন করে দিতেন ৷ এই ইমাজিনেশন এবং ভিজুয়ালাইজেশন আমাকে শুধু ছবির বিষয় সম্পর্কে নয়, তার কম্পোজিশন এবং কালার প্যালেটের বিষয়েও সাহায্য করে । ইমাজিনেশন ইজ দ্য কি ! স্যার বলতেন, "প্রতিটি ছবি একটি সৃষ্টি, সৃষ্টিকর্তা আমরা নই, আমরা তার মাধ্যম মাত্র । ছবি আগেই তৈরি হয়ে আছে, শুধু ক্যানভাসে নামাতে হবে তাকে ।"
ইটিভি ভারত: কোন মাধ্যমে কাজ করতে বেশি উপভোগ করেন ?
নাতাশা: অ্যাক্রিলিক এবং জল রং ।
ইটিভি ভারত: এই প্রদর্শনীতে কেমন সাড়া পাচ্ছেন ?
নাতাশা: আশানুরূপ সাড়াই পাচ্ছি ।
ইটিভি ভারত: এখানে 'মন পাখি' এবং 'ট্যাপেস্ট্রি অফ লাইক অ্যান্ড নেচার' দুটি বিষয়ে সোলো সিরিজ চলছে আপনার । দুটিরই সুন্দর সৃষ্টি দেখলাম । কতদিন সময়ে লেগেছে তৈরিতে ৷ এই ভাবনা দুটির প্রেরণা কী ?
নাতাশা: মন পাখি সিরিজটা 2023-এর মাঝামাঝি থেকে শুরু । আর ট্যাপেস্ট্রি সিরিজ 2024-এর কাজ । আমার শিল্পকর্মের মূল বিষয় হচ্ছে নারী ও প্রকৃতি । নারীসত্ত্বা, নারীর বিভিন্ন অনুভূতি ও তার সংগ্রাম এবং প্রকৃতির সঙ্গে তার যে সামঞ্জস্য রয়েছে, সেইটাই আমার শিল্পকর্মের অনুপ্রেরণা ও প্রেক্ষাপট ।
শিল্পী নাতাশা দত্ত রায়ের একক চিত্র প্রদর্শনী (নিজস্ব চিত্র) ইটিভি ভারত: একটা সময়ে পায়রার মাধ্যমেও চিঠি দেয়া-নেয়া হত । সিনেমাতেও তা দেখানো হয়েছে একাধিকবার । পাখির ভাবনা কেন ?
নাতাশা:'মন পাখি' বাংলা সাহিত্যে বহুল ব্যবহৃত একটি উপমা, যা একজনের মনের স্বাধীনতা ও অন্তর্লীন আকাঙ্ক্ষাকে কাব্যিকভাবে উপস্থাপন করে, যা প্রায়শই মুক্ত আকাশে উড়ন্ত একটি পাখির সঙ্গে তুলনা করা হয় । এই সিরিজটি আটটি চিত্রকলার একটি সংগ্রহ, যা প্রেমে পড়া এক নারীর বিভিন্ন অনুভূতি ব্যক্ত করে । পাখিটি নারীর আবেগের প্রতীক এবং রঙের প্যালেটের মাধ্যমে তার অনুভূতি ও প্রেমের যাত্রার ধাপগুলোকে তুলে ধরা হয়েছে ।
ইটিভি ভারত: শিল্পীর আঁকার মাধ্যমেও প্রতিবাদের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে । আপনার তেমন কোনও সৃষ্টি আছে ?
নাতাশা: আমার চিত্রকর্ম আমার কণ্ঠস্বর, যা নারীত্বের মাধুর্যকে সুচারুভাবে প্রকাশ করে । তার অনন্যতা এবং শক্তিকে উদযাপন করে । আমার শিল্পকর্মের মাধ্যমে নিজের প্রকৃত সত্ত্বাকে তুলে ধরার চেষ্টা করি ক্রমাগত । আমি মনে করি, নারীত্ব কোনও সীমাবদ্ধতা নয়; বরং এটি একটি পরিপূরক শক্তি । নিজেই নিজেকে যদি চিনে নিতে পারি, নিজের নারীশক্তিতে যদি নিজেকে সম্পূর্ণ করতে পারি, তবে সমাজের পুরুষের সঙ্গে প্রতিযোগিতার প্রয়োজন হয় না । প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মের সহাবস্থানে যাপন সহজ হয়ে ওঠে । লিঙ্গ রাজনীতির উপরে মনুষ্যত্ববোধ । প্রতিবাদ নয়, অনুপ্রেরণা ও আশার কন্ঠস্বর আমার ছবি ।
ইটিভি ভারত: ভবিষ্যতে কোন বিষয় নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে আছে ?
নাতাশা: আমার আগামী প্রদর্শনী 2025 সালের 24 জানুয়ারি । সেখানে আমার নতুন সিরিজ 'নিত্যশক্তি' প্রদর্শিত হবে ।
ইটিভি ভারত:শিল্পী না হলে কী হতেন ?
নাতাশা:আমি পেশায় শিশু সুরক্ষা পরামর্শক, নেশায় শিল্পী ।
ইটিভি ভারত: বর্তমান সময়ের তরুণ শিল্পীদের প্রতি আপনার কী পরামর্শ ?
নাতাশা: প্রথম প্রথম শেখার জন্য স্বনামধন্য শিল্পীদের ছবির কপি ওয়ার্ক প্রয়োজনীয়। কিন্তু পরবর্তীতে নিজের সৃজনশীলতাকে ফুটিয়ে তোলার জন্য নিজস্ব স্টাইল বা শৈলী খুব প্রয়োজন এবং সেটা নিজে থেকেই আসবে, যদি সৎভাবে নিরন্তর চর্চা চালিয়ে যাওয়া যায়।