পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / state

মালদার আমগাছের প্লাইউডে মজেছে চিন-আমেরিকা, জেলার অর্থনীতিতে নতুন দিগন্তের হাতছানি - MANGO TREE PLYWOOD

সবচেয়ে ভালো দিক হল, একটি গাছ কাটলে তার জায়গায় তিনটি নতুন গাছ লাগানো হচ্ছে ৷ এতে বাগানের পরিসর বাড়বে বলে আশাবাদী চাষিরা ৷

Mango tree plywood
বিদেশে কদর বাড়ছে মালদার আম গাছ থেকে তৈরি প্লাইউডের (নিজস্ব ছবি)

By ETV Bharat Bangla Team

Published : Dec 20, 2024, 8:22 PM IST

Updated : Dec 21, 2024, 9:13 PM IST

মালদা, 20 ডিসেম্বর: এবার শুধু আম নয়, দেশ-বিদেশে কদর বাড়ছে মালদা জেলার আমগাছেরও ৷ কারণ, পুরনো আম গাছ থেকে তৈরি হচ্ছে প্লাইউড, যা রফতানি হচ্ছে বিদেশে ৷ এমনকি একটি গাছ কাটা হলে তার বদলে লাগানো হচ্ছে তিনটি গাছ ৷

আম এবং মালদা ৷ বাস্তবেই একে অন্যের পরিপূরক ৷ মালদা জেলার নাম আমের মাধ্যমেই ছড়িয়েছে সারা বিশ্বে ৷ ভারী শিল্পবিহীন এই জেলায় যা কিছু ভাবনা, মূলত আমকে কেন্দ্র করেই ৷ আমের আচার, আমসত্ত্ব, আমপানা, জেলি, জ্যামের মতো উপজাত কিছু খাদ্যবস্তু এই জেলার কুটিরশিল্পের মধ্যেই পড়ে ৷ এবার আমগাছ নিয়ে অর্থনীতির নতুন দিশা দেখাচ্ছেন জেলার ব্যবসায়ীরা ৷

জেলার অর্থনীতিতে নতুন দিগন্তের হাতছানি (ইটিভি ভারত)

পুরনো আমগাছ থেকে তৈরি প্লাইউড এই স্বপ্ন দেখাচ্ছে ৷ এই প্লাইউডে মজেছে চিন-সহ বিশ্বের নানা দেশ ৷ ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, সদ্য শুরু হওয়া এই ব্যবসা গত বছর 100 কোটি টাকার গণ্ডি ছুঁয়েছে ৷ তাঁরা নিশ্চিত, আগামীতে এই শিল্প জেলার অর্থনীতিকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে ৷ তাঁদের দাবি, এতে জেলার আম চাষেরও উপকার হবে ৷ পরিধি আরও বাড়বে আম বাগানের ৷

কেন্দ্রের রিপোর্ট বলছে, গত আর্থিক বছরে ভারত আর চিনের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ 118.8 বিলিয়ন ডলার ৷ গত বছর গোটা পৃথিবীতে চিনের সঙ্গেই সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য হয়েছে ভারতের ৷ ভারত ও আমেরিকার মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য হয়েছে 118.3 বিলিয়ন ডলারের ৷ এক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে রাশিয়া-সহ অন্য দেশগুলি ৷ চিন আর আমেরিকার সঙ্গে দেশের বাণিজ্যে সামান্য হলেও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে মালদা জেলার আমগাছ থেকে তৈরি প্লাইউড ৷

পুরনো আম গাছ থেকে তৈরি হচ্ছে প্লাইউড (নিজস্ব ছবি)

কেন আমগাছ থেকে তৈরি প্লাইউড ধীরে ধীরে সারা বিশ্বে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ?

ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, এই প্লাইউড একদিকে যেন শক্তপোক্ত, তেমনই নমনীয় ৷ ফলে আমগাছের প্লাইউডকে নানা আকৃতি দেওয়া যায় ৷ যেটা অন্য কোনও প্লাইউডে সম্ভব নয় ৷ তাই এই প্লাইউড দিয়ে যেমন বিভিন্ন ধরনের আসবাবপত্র তৈরি করা যায়, তেমনই নয়া প্রযুক্তির বিভিন্ন সামগ্রী তৈরিতেও কাজে লাগে ৷ অসম্ভব পাতলা এবং মসৃণ প্লাইউডের ক্ষেত্রে এতদিন মালয়েশিয়ার প্লাইউড গোটা বিশ্বে সমাদৃত ছিল ৷ কিন্তু ধীরে ধীরে সেই জায়গা দখল করছে এই জেলার তৈরি আমগাছের প্লাইউড ৷

একটি গাছ কেটে তার বদলে লাগানো হচ্ছে তিনটি গাছ (নিজস্ব ছবি)

দুলাল সরকার এই জেলার অন্যতম রাজনীতিবিদ ৷ তিনি জেলার অন্যতম বড় প্লাইউড ব্যবসায়ীও বটে ৷ জেলায় একাধিক প্লাইউড কারখানা রয়েছে তাঁর ৷ তিনি বলছেন, "আমি ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে ৷ 1979 সালে বরকত সাহেব তাঁর লোকসভা ভোটের জন্য আমাদের দায়িত্ব দিয়েছিলেন ৷ তিনিই আমাকে ব্যবসা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন ৷ 1995 সালে আমি আমের ব্যবসা শুরু করি ৷ পরে বরকতদার পাইপ ফ্যাক্টরির সামনে থাকা একটি প্লাইউড ফ্যাক্টরি আমি কলকাতার মালিকদের কাছ থেকে কিনে নিই ৷ তখন থেকেই প্লাইউডের ব্যবসা করছি ৷ পরে আরও একটি ফ্যাক্টরি বানিয়েছি ৷"

পুরোনো গাছে এখন ফলন কম হয় (নিজস্ব ছবি)

তিনি আরও বলেন, "বিভিন্ন ফার্নিচার বা অন্য কোনও জায়গায় প্লাইউড বাঁকাতে হয় ৷ সেই কাজে আমকাঠের প্লাইউডের বিকল্প নেই ৷ এই প্লাইউড বাকি সমস্ত প্লাই থেকে বেশি নমনীয় ৷ ফলে সহজেই বাঁকানো যায় ৷ আমরা আমকাঠের প্লাইকে বিভিন্ন রাসায়নিক, তাপ প্রয়োগ করে একাধিক নকশায় তৈরি করি ৷ অন্য কাঠের প্লাই থেকে আমকাঠের প্লাই অনেক বেশি দীর্ঘস্থায়ী ৷ আমরা এই প্লাইউড মুম্বই, দিল্লি এবং বেঙ্গালুরুতে বেশি পাঠাই ৷ দিল্লির কিছু ব্যবসায়ী এই প্লাইউড পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রফতানি করে থাকেন ৷"

আম গাছ থেকে তৈরি হচ্ছে প্লাইউড (নিজস্ব ছবি)

তাঁর কথায়, "চিন, আমেরিকা-সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গত আর্থিক বছরে শুধু মালদা থেকে 100 কোটি টাকার প্লাইউড রফতানি হয়েছে ৷ সারা দেশের নিরিখে এই অংকটা কয়েকশো কোটি টাকা ৷ পৃথিবীতে উন্নত প্রজাতির আমকাঠ শুধুমাত্র মালদা, মুর্শিদাবাদ-সহ এই রাজ্যেই পাওয়া যায় ৷ যেসব গাছ পুরনো, ফলন কমে গিয়েছে, সেসব গাছ আমরা কিনি ৷ একটি গাছ কাটা হলে তিনটি নতুন গাছ লাগানো হয় ৷ এতে আম বাগানের পরিসরও বাড়ে ৷ প্লাইউডের এই ব্যবসা আরও বৃদ্ধি পেলে জেলার অর্থনীতি আরও গতিশীল হবে ৷"

জেলার অন্যতম প্লাইউড ব্যবসায়ী তথা মালদা টিম্বার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক মেঘনাদ কর্মকার জানাচ্ছেন, মালদা জেলার প্রতিটি কোনাতেই বড় বড় আম বাগান রয়েছে ৷ কিন্তু বাগানগুলিতে থাকা পুরনো গাছে এখন ফলন কমে গিয়েছে ৷ বন দফতরের অনুমতি নিয়েই সেসব গাছ কাটা হয় ৷ সেখানে তিনটি নতুন গাছ লাগানো হয় ৷ সেই পুরোনো গাছ থেকেই প্লাইউড তৈরি হয় ৷ এখানে তৈরি বিভিন্ন ডিজাইনের প্লাইউড দেশের বিভিন্ন জায়গায় যায় ৷ সেই ক্রেতারা এসব বিদেশে রফতানি করেন ৷

আমগাছের প্লাইউড অনেক শক্তপোক্ত ও নমনীয় হয় (নিজস্ব ছবি)

তাঁর কথায়, "এখনও আমরা সরাসরি এই প্লাইউড বিদেশে রফতানি করতে পারিনি ৷ এই ব্যবসায় লাভ বেশ ভালো ৷ সেকারণে মালদা ও পার্শ্ববর্তী দুই জেলায় দেড়শোর উপর প্লাইউডের কারখানা তৈরি হয়েছে ৷ এতে শুধু জেলার অর্থনীতির বিকাশ ঘটবে না, কর্মসংস্থানের নতুন দিকও খুলে যাবে ৷ আর যে পদ্ধতিতে আমরা এই ব্যবসা করছি, তাতে পরিবেশের উপর কোনও প্রভাব পড়বে না ৷"

এই ব্যবসা যে আগামীতে জেলার অর্থনীতিতে ভালো প্রভাব ফেলবে তা নিয়ে নিশ্চিত জেলার বণিকসভা, মালদা মার্চেন্ট চেম্বার অফ কমার্সের সভাপতি জয়ন্ত কুণ্ডু ৷ তিনি বলছেন, "আগে মালদার আম এবং আমজাত সামগ্রী বাংলাদেশের মাধ্যমে বিদেশে রফতানি হত ৷ কিন্তু আমগাছ থেকে তৈরি প্লাইউড দেশ থেকেই রফতানি হচ্ছে ৷ এই ব্যবসা যে জেলার অর্থনীতিতে নতুন আশা দেখাতে পারে, তা আমরা গত এক বছর ধরেই দেখতে পাচ্ছি ৷"

আমগাছের প্লাইউডকে নানা আকৃতি দেওয়া যায় (নিজস্ব ছবি)

তাঁর সংযোজন, "গত আর্থিক বছরে আমাদের জেলা থেকে প্রায় 100 কোটি টাকার প্লাইউড দিল্লি মারফৎ চিন-সহ নানা দেশে গিয়েছে ৷ এটা এক নতুন দিগন্ত ৷ ব্যবসায়ীরা একটি গাছ কাটলে তিনটি নতুন গাছ লাগাচ্ছেন ৷ অর্থাৎ তাঁরা সরকারি নির্দেশ মেনেই কাজ করছেন ৷ এতে বাগানের পরিসর বাড়বে ৷ নতুন গাছে ফলন বেশি হবে ৷ জেলার বেকার সমস্যারও অনেকটা সমাধান হবে ৷"

গোটা বিষয়টি জেনে উচ্ছ্বসিত জেলার খ্যাতনামা আমচাষি শেখ রহমত আলি ৷ তাঁর বক্তব্য, "আমাদের জেলায় অনেক আমগাছের বয়স 100 থেকে 150 বছর হয়ে গিয়েছে ৷ সেসব গাছের ফলন ক্ষমতাও অনেক কমেছে ৷ আমার ধারণা, সেসব জায়গায় নতুন আমগাছ লাগানো ভালো ৷ এখন অনেক নতুন প্রজাতির আম এসেছে ৷ সেসব প্রজাতির গাছ গ্র্যাফটিং করে তৈরি হয় ৷ তাতে গাছের আকার ছোট হয় ৷ প্রতি বিঘায় 40-50টি গাছ লাগানো যায় ৷ ফলনও এখন অনেক বেশি হয় ৷"

প্লাইউড দিয়ে বিভিন্ন ধরনের আসবাবপত্র তৈরি করা যায় (নিজস্ব ছবি)

তিনি আরও বলেন, "আগে এক বিঘায় চার থেকে ছ'টি গাছ লাগানো হতো ৷ তাছাড়া গাছ ছোট হল পরিচর্যা করার সুবিধে ৷ ঝড়ে সেভাবে ফল পড়ে না ৷ স্প্রে করাও সুবিধে ৷ ফল পাড়ার সময় বড় গাছে শ্রমিকরা উঠতে চায় না ৷ তাদেরও পড়ে যাওয়ার ভয় থাকে ৷ গাছ ছোট হলে সেসব সমস্যা নেই ৷ তাছাড়া প্লাইউড ব্যবসায়ীরা পুরনো একটি গাছ কেটে তিনটি গাছ লাগাচ্ছেন ৷ এতে আমচাষের পরিধি বাড়বে ৷ আমরাও উপকৃত হব ৷ পুরনো গাছের জায়গায় নতুন বাগান তৈরি করতে পারব ৷ এতে পুরনো অনেক প্রজাতির আম বিলুপ্ত হয়ে যাবে ৷ কিন্তু আমাদের পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতেই হবে ৷"

কোতওয়ালি এলাকার মহম্মদ মনিরুজ্জামান একাধারে আমচাষি ও আম কাঠের ব্যবসায়ী ৷ তাঁর কথায়, "পুরনো গাছ রেখে আমাদের কোনও লাভ নেই ৷ এখন নতুন প্রজাতির প্রচুর আম বেরিয়েছে ৷ এতে আমাদের লাভ অনেক বেশি হচ্ছে ৷ তাই আমরা পুরোনো গাছ কেটে দিচ্ছি৷ সেখানে নতুন গাছ লাগাচ্ছি ৷ নতুন বাগানে বিভিন্ন সবজিরও চাষ হচ্ছে ৷ আমরা দু’দিক থেকে উপকৃত হচ্ছি ৷"

মালয়েশিয়ার প্লাইউডের জায়গা দখল করছে আমগাছের প্লাইউড (নিজস্ব ছবি)

জেলা উদ্যানপালন দফতরের ডেপুটি ডিরেক্টর সামন্ত লায়েকের মতে, "আমগাছ বেশি পুরনো হয়ে গেলে তাতে ফলন স্বাভাবিকভাবেই কমে যায় ৷ সেই জায়গায় নতুন বাগান তৈরি করাই বিজ্ঞানসম্মত ৷ বর্তমানে জেলায় প্রায় 31 হাজার 600 হেক্টর জমিতে আম বাগান রয়েছে ৷ তবে ব্যবসায়ীদের লক্ষ্য রাখতে হবে, পুরোনো গাছ কাটা হলে সেখানে যেন সরকারি নিয়ম মেনে অন্তত তিনটি গাছ লাগানো হয় ৷ তাতে আমচাষের পরিধি যেমন বাড়বে, তেমনই আমের উৎপাদনও বৃদ্ধি পাবে ৷"

Last Updated : Dec 21, 2024, 9:13 PM IST

ABOUT THE AUTHOR

...view details