জলপাইগুড়িতে কি আবার ফুটবে পদ্ম (ইটিভি ভারত) জলপাইগুড়ি, 4 এপ্রিল: চা-বাগান, নদী, পাহাড় আর জঙ্গলবেষ্টিত জেলা জলপাইগুড়ি । জেলার প্রতিটি বিধানসভা কেন্দ্রের সঙ্গেই জুড়ে রয়েছে এক একটা নদী । তিস্তা, করোলা, করোতোয়া, জলঢাকা, মাল নদী । কথায় বলে, নদী জানে জেলার প্রতিটি বিধানসভার কথা । জেলার একপাশে রয়েছে বাংলাদেশ, আরেক পাশে ভুটান সীমান্ত ।
চা, জঙ্গল আর পর্যটনে সমৃদ্ধ এই জেলা এক সময় লালদুর্গ নামে পরিচিত ছিল । 2011 সালে পরিবর্তনের হাওয়ায় ভেঙে পড়ল লাল-গড় । তা চলে যায় তৃণমূলের দখলে ৷ কিন্তু 2019 সাল থেকে জলপাইগুড়িতে ক্রমশ পদ্ম ফুটতে শুরু করেছে ৷ 2019 সালের লোকসভা ভোটে জলপাইগুড়ি থেকে জয়ী হয় বিজেপি ৷ সেই সময় এই আসনের সাতটি বিধানসভার মধ্যে ছ’টিতেই এগিয়ে ছিল বিজেপি ।
জলপাইগুড়িতে কি আবার ফুটবে পদ্ম ? (ইটিভি ভারত) তাছাড়া সেবার বিজেপি প্রার্থী ড. জয়ন্তকুমার রায় তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী বিজয়চন্দ্র বর্মনকে বিরাট ভোটের ব্যবধানেও হারিয়ে দেন । ড. জয়ন্তকুমার রায় পেয়েছিলেন 7 লক্ষ 60 হাজার 150 ভোট । তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী পেয়েছিলেন 5 লক্ষ 76 হাজার 141 ভোট। 1 লক্ষ 84 হাজার 4 ভোটে জয়ী হয়েছিলেন বিজেপি প্রার্থী ডা: জয়ন্তকুমার রায় ।
সেই অবস্থা থেকে 2021 সালে বিধানসভায় তৃণমূল খানিকটা ঘুরে দাঁড়ায় । জলপাইগুড়ি লোকসভা কেন্দ্রের জলপাইগুড়ি, রাজগঞ্জ, মালবাজার, মেখলিগঞ্জ বিধানসভা তৃণমূল দখল করে । অন্যদিকে ধূপগুড়ি, ময়নাগুড়ি ও ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি বিজেপি দখল করে । পরে উপ-নির্বাচনে ধূপগুড়িতে জয়ী হয় তৃণমূল ৷ সেখান থেকে কি তৃণমূল আবার জলপাইগুড়ি লোকসভা আসনে জিততে পারবে ? আশাবাদী নেতৃত্ব ৷
তৃণমূল কংগ্রেসের জেলা সভাপতি মহুয়া গোপ বলেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখতে মানুষ আমাদের আশীর্বাদ করবে । মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যে সকল প্রকল্পগুলো নিয়েছেন, তাতে মানুষ ভালোভাবে নিয়েছে । লক্ষ্মী ভাণ্ডার প্রকল্পের টাকা বেড়েছে ৷ রাজ্য সরকার জমির পাট্টা দিচ্ছে ৷ সরকারের লাভ মানুষ পাচ্ছে ৷ ফলে আমাদের প্রার্থী নির্মলচন্দ্র রায় জিতবেন বলে আমরা আশাবাদী ।’’
যদিও পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরিসংখ্যানের নিরিখে লোকসভাতেও কড়া টক্কর হওয়ার ইঙ্গিত রয়েছে তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে ৷ 2023 সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে 80টি গ্রাম পঞ্চায়েতের 1701টি আসনের মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছিল 1086টি আসন, বিজেপি পেয়েছে 475টি আসন, সিপিএম পেয়েছিল 72টি আসন ।
জলপাইগুড়ি জেলা পরিষদের 24টি আসনেই জিতেছে ৷ জেলা পরিষদে মোট ভোট পড়েছিল 10 লক্ষ 51 হাজার 24 । তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছিল 5 লক্ষ 81 হাজার 433 ভোট । বিজেপি পেয়েছিল 4 লক্ষ 42 হাজার 340 ভোট । সিপিএম পেয়েছিল 1 লক্ষ 26 হাজার 5 ভোট । তৃণমূল বিজেপির থেকে 1 লক্ষ 39 হাজার 93 ভোট বেশি পেয়েছিল । 2018 সালে তৃণমূল কংগ্রেস জলপাইগুড়ি জেলায় জেলা পরিষদে ভোট পেয়েছিল 5 লক্ষ 98 হাজার 488 ভোট । পাশাপাশি বিজেপি ভোট পেয়েছিল 3 লক্ষ 48 হাজার 92 ভোট ।
2019 লোকসভা ভোটের ফলাফল (ইটিভি ভারত) সেদিক থেকে বিজেপির ভোট বেড়েছে ৷ আর ভোট কমেছে তৃণমূলের ৷ ভোটের অঙ্কের তৃণমূল কংগ্রেসের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে বিজেপি । আর এই অঙ্কেই বিজেপি জলপাইগুড়িতে এবারও জয়ের আশা দেখছে ৷ জলপাইগুড়ি জেলা বিজেপির সভাপতি বাপী গোস্বামী বলেন, ‘‘আমরা 2019 সালের তুলনায় অনেক বেশী ভোটে আমরা জিতব । ড. জয়ন্তকুমার রায়কে জলপাইগুড়ি লোকসভা কেন্দ্রের মানুষ দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করবেন । কারণ, তাঁর মতো ভদ্র সভ্য সজ্জন ব্যক্তি হয় না । পাঁচ বছরে উনি কাজ করেছেন, তা সবাই দেখেছেন । ফলে আমাদের জয়ন্তকুমার রায় সম্পর্কে পরিচয় করাতে হবে না ।’’
এবার একনজরে দেওয়া নেওয়া যাক, জলপাইগুড়ি লোকসভা আসনের মধ্যে যে সাতটি বিধানসভা রয়েছে, সেগুলিতে রাজনৈতিক সমীকরণ কী অবস্থায় রয়েছে -
জলপাইগুড়ি বিধানসভা: জলপাইগুড়ি সদর বিধানসভা আসন বরাবরই কংগ্রেসের দখলে । বাম আমলেও হাতকেই এই কেন্দ্রে ভোট দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন এই কেন্দ্রের ভোটাররা । 2011 সালে ক্ষমতা পরিবর্তনের ভোটে এই কেন্দ্র 11 হাজার 51 ভোটে এই কেন্দ্র থেকে জয়ী হন প্রাক্তন আমলা কংগ্রেস প্রার্থী সুখবিলাস বর্মা । 2014 লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্র থেকে জয়ী হন তৃণমূল প্রার্থী বিজয়চন্দ্র বর্মন । 2016-র বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের সঙ্গে জোট ভেঙে বামেদের সঙ্গে জোট বাধে কংগ্রেস । প্রার্থী সেই সুখবিলাস । জয়ের ব্যবধান কমলেও 5157 ভোটে এই কেন্দ্র থেকে জয়ী হন সুখবিলাস বর্মা । 2019-এর লোকসভা নির্বাচনে বদলে যায় এই কেন্দ্রের রাজনৈতিক সমীকরণ । তৃণমূল ও বাম-কংগ্রেস জোটকে জোর ধাক্কা দিয়ে এই কেন্দ্রে 39 হাজার 185 ভোটে এগিয়ে থাকে বিজেপি । 2021 সালে এই কেন্দ্রে প্রথম জয় পায় তৃণমূল কংগ্রেসের প্রদীপকুমার বর্মা ।
ময়নাগুড়ি বিধানসভা: পরিবর্তনের ঝড়েও ময়নাগুড়ি বিধানসভা কেন্দ্রে উড়তে দেখা যায় লাল পতাকাকে । 2011 সালে এই কেন্দ্র থেকে জয়ী হন আরএসপি প্রার্থী অনন্তদেব অধিকারী । 2016 সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে দলবদল করে তৃণমূলে এসে এই কেন্দ্র থেকে আবার জয়ী হন তিনি । 2019-এর লোকসভা নির্বাচনে দাপট দেখায় পদ্ম শিবির । লোকসভা ভোটের হিসেবে এই কেন্দ্রে তৃণমূলের তুলনায় 14 হাজার 747 ভোটের ব্যবধানে এগিয়ে ছিল বিজেপি । 2021 সালে বিজেপি প্রার্থী কৌশিক রায় জয়ী হন ।
ধূপগুড়ি বিধানসভা: বামেদের শক্তঘাঁটি বলে পরিচিত ধূপগুড়ি বিধানসভা আসনে পরিবর্তনের ঝড়ে ফাটল ধরাতে পারেনি তৃণমূল কংগ্রেস । 2016 সালে মিতালি রায়ের হাত ধরে এই কেন্দ্র দখলে আসে তৃণমূলের । কিন্তু গত লোকসভায় সিপিএমের হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়া এই জমিতে দারুণভাবে পদ্মের চাষ চিন্তা বাড়ায় শাসক দলের । লোকসভায় 17 হাজার 766 ভোটে এই কেন্দ্রে এগিয়ে ছিল বিজেপি । বিধানসভায় এই ব্যবধান কমানোই চ্যালেঞ্জ ছিল মিতালি রায়ের । কিন্তু 2021 সালে বিজেপি প্রার্থী বিষ্ণুপদ রায় জয়ী হন ধূপগুড়িতে । 2023 সালে বিষ্ণুপদ রায়ের মৃত্যুর পর এই আসনে উপ-নির্বাচনে জয়ী হয় তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী নির্মলচন্দ্র রায় ।
রাজগঞ্জ বিধানসভা: 2009-এর উপ-নির্বাচনেই এই কেন্দ্রে ঘাসফুল ফুটিয়েছিলেন তৃণমূল প্রার্থী খগেশ্বর রায় । পরের দুই নির্বাচনে শুধু জয়ের ব্যবধানই বাড়িয়ে গিয়েছেন তিনি । 2011 সালে 7020 ভোটে জেতেন খগেশ্বর । 2016-তে তা বেড়ে হয় 14 হাজার 677 । 2019-এর লোকসভা নির্বাচনে জেলার সাত বিধানসভা আসনের মধ্যে ছ’টি আসনে যখন গেরুয়া ঝড় চলছে, তখন এই কেন্দ্রে ফুল ফোটাতে পারেনি পদ্ম । লোকসভায় বিজেপির থেকে 4320 ভোটের ব্যবধানে এগিয়ে ছিল তৃণমূল । 2021 সালে ফের জয়ী হন খগেশ্বর রায় ।
ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি বিধানসভা: রাজ্যের হেভিওয়েট মন্ত্রীর গৌতম দেবের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি । 2011 সালে 11 হাজার 236 ও 2016 সালে 23 হাজার 811 ভোটের ব্যবধানে জয়ী হন গৌতম দেব । 2019 সালে এই কেন্দ্রের রাজনীতির সমস্ত অঙ্ক গুলিয়ে দেয় বিজেপি । লোকসভায় তৃণমূলের সঙ্গে 86 হাজার 107 ভোটের ব্যবধান তৈরি হয় বিজেপির । কিন্তু 2021 সালে এই কেন্দ্রে গৌতম দেবকে হারিয়ে দেন বিজেপির শিখা চট্টোপাধ্যায় ।
মালবাজার বিধানসভা: 2011 বিধানসভা নির্বাচনে যে দু’টি কেন্দ্র পরিবর্তন করতে পারেনি তৃণমূল কংগ্রেস তার মধ্যে একটি মাল বিধানসভা আসন । 2011 সালে এই কেন্দ্র থেকে 4 হাজার 216 ভোটে জয়ী হন সিপিএম প্রার্থী বুলুচিক বরাইক । 2016 সালে দলবল করে বুলুচিক চলে আসেন তৃণমূলে । এই কেন্দ্র থেকে প্রার্থী হয়ে 18 হাজার 462 ভোটে জয়ী হন তিনি । 2019-এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ঝড় আছড়ে পড়ে এই কেন্দ্রেও । 24 হাজার 49 ভোটে এই কেন্দ্রে এগিয়ে যায় বিজেপি ৷ তবে 2021 সালে বিধানসভা ভোটে বুলুচিক বরাইক বিজেপি প্রার্থীকে হারিয়ে জয়ী হন ।
মেখলিগঞ্জ বিধানসভা: জলপাইগুড়ি লোকসভা কেন্দ্রের অন্যতম বিধানসভা কোচবিহার জেলার মেখলিগঞ্জ বিধানসভা । 2011 সালে মেখলিগঞ্জ বিধানসভা বামেদের দখলেই ছিল । 2016 সালে তৃণমূল প্রার্থী অর্ঘ্য রায় প্রধান জয়ী হন মেখলিগঞ্জ থেকে ৷ 2021 সালে পরেশ অধিকারী জয়ী হন ৷ রাজ্যের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী করা হয় তাঁকে ৷ 2019 সালে এই লোকসভা আসনেও বিজেপি ভালো লিড পেয়েছিল ৷ বর্তমানে পরেশ অধিকারীর কন্যার চাকরি কেলেঙ্কারি নিয়ে যথেষ্ট বেগ পেতে হতে পারে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল ।
আরও পড়ুন:
- সিএএ কার্যকর হওয়ায় জলপাইগুড়িতে মতুয়াদের উৎসবে অংশ নিলেন বিজেপি সাংসদ
- জলপাইগুড়িতে ভোটের ইস্যু ‘বাংলাদেশ’! তেঁতুলিয়া করিডর চালুর প্রতিশ্রুতি বিজেপির জয়ন্ত রায়ের
- রেল পরিবহণে বিকাশ, আক্ষেপ শিল্পতালুক নিয়ে; জয়ন্ত রায়ের 5 বছরের খতিয়ান