কলকাতা, 17 জুন: নিশ্চিন্তে ট্রেন-যাত্রা করছিলেন যাত্রীরা । ভেবেছিলেন আর মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে যাবেন শিয়ালদা । তবে তাঁদের সেই আশায় বাধ সাধল কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনা । সোমবার সকালে দার্জিলিংয়ের রাঙাপানিতে একই ট্র্যাকে চলে আসে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস এবং একটি মালবাহী ট্রেন । ওই অঞ্চলে বৃষ্টির জেরে দৃশ্যমানতা অনেকটাই কম থাকায় কাঞ্চনজঙ্ঘা ট্রেনটিতে পিছন দিক থেকে এসে সজোরে ধাক্কা মারে মালবাহী ট্রেনটি । এর ফলে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের পেছনের দিকের তিনটি কামরা ভয়াবহ ভাবে বেলাইন ছিটকে পড়ে অনেকটা দূরে ।
এই রেল দুর্ঘটনা আবারও ট্রেন-যাত্রার নিরাপত্তা নিয়ে একাধিক প্রশ্ন তুলে দিয়েছে । প্রশ্নের মুখে রেলের ‘কবচ’ ব্যবস্থাও । সিগন্যালিংয়ের ভুলে যদি কখনও দু’টি ট্রেন একসঙ্গে একটি লাইনে চলে আসে বা এই ধরনের কোনও সমস্যা হয়, তাহলে অটোমেটিক ট্রেন প্রটেকশন ব্যবস্থায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে ট্রেন থেমে যাবে ৷ একটি ট্রেন যখন অপর ট্রেনের 5 কিলোমিটার দূরত্বে থাকে, তখনই কবচ পেছনের ট্রেনটির গতি কমিয়ে সেটিকে থামিয়ে দেয় । এর ফলে দুর্ঘটনা এড়ানো যায় । এবং কন্ট্রোল রুমেও অ্যালার্ট পৌঁছে যায় ।
তবে এই ক্ষেত্রে তা ছিল না । এ দিন ঘটনাস্থলে পৌঁছে রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব এই কবচ ব্যবস্থা কিভাবে কাজ করে তা বিস্তারিতভাবে বুঝিয়ে বলেন । কিন্তু প্রশ্ন হল, কেন এই ব্যবস্থা ছিল না ? রেল বোর্ডের চেয়ারপার্সন জয়া বর্মা সিনহা একরকম স্বীকার করে নেন যে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস যে পথে আসছিল অর্থাৎ গুয়াহাটি-দিল্লি রুট, সেই লাইনে এখনও কবচ ব্যবস্থা কার্যকর হয়নি ।
তিনি আরও জানান যে দেশের মোট এক লক্ষ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের রেল পথের মাত্র 1500 কিলোমিটার রেল পথে কবচ ব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে । 2024 এর মধ্যে দেশের আরও ছয় হাজার কিলোমিটার রেলপথে কবচ চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে রেল বোর্ডের । এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া-দিল্লি লাইনেও বসানো হবে কবচ ।
অন্যদিকে এ দিন উত্তরবঙ্গে ঘটনাস্থলে যাওয়ার আগে কলকাতা বিমানবন্দরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "প্রশাসনের তরফে অবহেলা চলছে ৷ বারবার রেলে দুর্ঘটনা ঘটছে ৷ এখনও বোধহয় প্রচুর দেহ পড়ে আছে ৷ দুর্ঘটনায় কারও হাতে নেই ৷ তবে আমি অ্যান্টি কলিশন ডিভাইস তৈরি করে দিয়েছিলাম ৷ রেল এখন ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে৷ শিয়ালদায় নিত্যযাত্রীদের প্রচুর সমস্যা ৷ এই দুর্ঘটনা আরও মারাত্মক হতে পারত ৷’’
কবচ নিয়ে প্রশ্ন করেন সাংবাদিকরা৷ তখন মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘আমি রেল মন্ত্রী থাকাকালীন অ্যান্টি কলিশন ডিভাইস করেছিলাম ৷ কোঙ্কন রেলওয়েকে কাজে লাগিয়েছিলাম ৷ প্রত্যেক ট্রেনে তা লাগানো হয়েছিল ৷ ড্রাইভার ঘুমিয়ে পড়লে অ্যালার্ম দেবে৷ দু’টি ট্রেন কাছাকাছি এলে জানিয়ে দেবে ৷ রেলের একটা শ্রী ছিল ৷ এটা সমালোচনা নয়, কিন্তু প্যাসেঞ্জারদের এমন বিছানা দেওয়া হয়, তাতে নোংরা জিনিস থাকে ৷ বাথরুমও খুব নোংরা থাকে ৷ খাবারের মানও খুব বাজে ৷ রেলের বাজেট উঠিয়ে দিয়েছে ৷ রেলের মাধুর্যটাই নষ্ট করে দিয়েছে ৷’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘রেল এখন পেরেন্টলেস৷ শুধু উদ্বোধনের সময় দেখতে পাওয়া যাবে ৷ কত সৌন্দর্যায়ন ৷ রেলে শুধু ফ্যাশন ৷ আমি জানি, রেলের আধিকারিক, ইঞ্জিনিয়ারদের প্রতি খেয়াল রাখা হচ্ছে না ৷ খবরের কাগজ থেকে জানতে পেরেছি পেনশন দেওয়া হচ্ছে না ৷ রেলওয়ে আধিকারিকরা যতটা সম্ভব ভালো করার চেষ্টা করছেন ৷ শুধু নির্বাচনে কী করে কারচুপি করা যায়, তার চেষ্টা করছে ।"
অন্যদিকে পূর্ব রেলের প্রাক্তন মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক সমীর গোস্বামী জানান যে কবচ ব্যবস্থা আপাতত দেশের 1500 কিলোমিটার রেলপথে লাগানো হলেও সেটিও যে একেবারে একশো শতাংশ নিখুঁত তেমনটা কিন্তু নয় । অন্যদিকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যখন রেলমন্ত্রী ছিলেন তিনি যে ব্যবস্থাটি চালু করেছিলেন, তাও কিন্তু পুরোপুরি ভাবে যে দুর্ঘটনা দমন করতে সক্ষম ছিল না । সেটিও পরীক্ষামূলকভাবেই৷ দূরপাল্লার দু’টি ট্রেনে লাগানো হয়েছিল, তবে সেটিও তেমন কার্যকরী হয়নি । এখন পরীক্ষামূলকভাবে 1500 কিলোমিটার পথে চলছে কবচ । তবে অন্যান্য দেশে রেল দুর্ঘটনা এড়াতে যে 100 শতাংশ সঠিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, সেগুলি নিয়ে ভারতেই কথাবার্তা চলছে । পরীক্ষামূলকভাবে শুরু করার কথাও চলছে । আশা করা যায়, ভবিষ্যতে সেই সব 100 শতাংশ নিখুঁত প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই ধরনের ভয়াবহ সব রেল দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হবে ।