পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / state

'কেয়াপাতার নৌকো' গড়ে সাজিয়ে দেওয়ার কাজ করে চলেছেন হাওড়ার বোটম্যান

জেট যুগে বাহন বিপ্লবে অস্তিত্বের সঙ্কটে নৌকা ৷ নদীমাতৃক বাংলার ঐতিহ্যকে সযন্তে আঁকড়ে রেখেছেন বোটম্যান স্বরূপ ভট্টাচার্য ৷ গড়ছেন রকমারি 'আদরের নৌকা'র ক্ষুদ্র সংস্করণ ৷

ETV BHARAT
কেয়াপাতার নৌকো গড়ে চলেছেন হাওড়ার বোটম্যান (নিজস্ব চিত্র)

By ETV Bharat Bangla Team

Published : 4 hours ago

কলকাতা, 19 নভেম্বর: ছুটি হলে রোজ ভাসাই জলে/কাগজ-নৌকাখানি ৷ নৌকায় চেপে শিশুমনের কল্পনার জগতে ভেসে যাওয়ার গল্প শুনিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ৷ তাল দিঘিতে ভাসিয়েছেন কেয়াপাতার নৌকো ৷ শৈশব হোক বা যৌবন, এই জলযান জীবনতরী হয়ে বারবার শুনিয়েছে সমাজজীবনের কথা ৷ আমি চান্দেরই সাম্পান যদি পাই/সাত সাগরে পাড়ি দিয়া তরে নিইয়া যাই ৷ জেট যুগের বাহন বিপ্লবে নদীমাতৃক বাংলাতেও অস্তিত্বের সংকটে এই ঐতিহ্যের যান ৷ তবে ইতিহাস আঁকড়ে 'আদরের নৌকা'র অবয়ব বানিয়ে বাংলার সংষ্কৃতির ইতিহাস লিখে চলেছেন নৌকা বিশারদ স্বরূপ ভট্টাচার্য ৷

নদীমাতৃক বাংলায় বাহন হিসেবে নৌকার চলন কবে শুরু হয়েছিল, তার সাল তারিখ কেউ হলফ করে বলতে পারি না । তবে জীবনের প্রয়োজনে প্রাত্যহিক নামচায় নৌকার বিবর্তন আমরা ঘটিয়েছি অবস্থা বুঝে ব্যবস্থায় । আজ তার ব্যবহার কোনও রকমে টিকে রয়েছে । হারিয়ে যাওয়া নৌকার তালিকা এবং তা ব্যবহারের কারণগুলি একে একে নিজের সৃষ্টিতে তুলে ধরছেন ড. স্বরূপ ভট্টাচার্য ।

'কেয়াপাতার নৌকো' গড়ে চলেছেন বোটম্যান (নিজস্ব ভিডিয়ো)

নৃতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করেছেন । বাগবাজারের আদি বাসিন্দা হলেও বর্তমানে হাওড়ায় থাকেন । বাগবাজার মানেই ভোলা ময়রা, সারদাদেবী, সিস্টার নিবেদিতা, গিরিশ ঘোষ, দূর্গাপুজো এবং বাংলার দিকপাল সঙ্গীতজ্ঞদের বাস । সেখানে থেকে নৌকার ইতিকথা নিয়ে গবেষণা এবং তাদের বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াসে পঞ্চাশোর্ধ মানুষটির নিরলস প্রচেষ্টা অব্যাহত । কেন ?

ছাদের উপর নিজের ওপেন এয়ার স্টুডিয়োতে বসে কাজ করতে করতে স্বরূপ ভট্টাচার্য বললেন, "আসলে, 1995 সালে আমি নৃতত্ব নিয়ে স্নাতকোত্তর করার পরে 1997 সালে একটি সেমিনারে অংশ নিয়েছিলাম । সেখানে নৌকা নিয়ে আলোচনা শুনে বুঝলাম, এই বিষয় নিয়ে কেউ কাজ করেনি । ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার সুযোগ রয়েছে । সেই থেকে লেগে আছি ৷" তাঁর বাবা ছিলেন বিখ্যাত ভাস্কর মাধব ভট্টাচার্য । তাঁকে ছোটবেলায় দেখেছিলেন মূর্তি গড়ার কাজে নিমগ্ন থাকতে । বাবার মতো ভাস্কর হননি । তবে নৌকার অবয়ব মিনিয়েচার ফর্মে বানিয়ে তাদের বাঁচিয়ে রাখার কাজটি মনোযোগ সহকারে করে চলেছেন ।

নৌকার ক্ষুদ্র সংস্করণ বানাচ্ছেন হাওড়ার বোটম্যান (নিজস্ব চিত্র)

চারিদিকে অবিরাম যান্ত্রিক ক্যাকোফোনি । তাঁর মাঝে স্বরূপ ভট্টাচার্য একা বসে লড়াই করে চলেছেন নদীমাতৃক বাংলার অন্যতম আদি সত্যকে বাঁচিয়ে রাখতে । এই নৌকা তাঁর যাপন, আশ্রয়, আবেগ । অবিন্যস্ত কাঁচাপাকা চুল ঠিক করতে করতে তিনি বলেন, "সাধারণ লোক দু নৌকায় পা রেখে চলেন, আমি তো হাজার নৌকায় পা দিয়ে চলছি ৷"

বানিয়েছেন পাল তোলা নৌকা, ডিঙা, সাম্পান (নিজস্ব চিত্র)

একটুও না থেমে তিনি আরও বলেন, "বাংলায় নৌকা বৈচিত্র্য থাকবেই । এত নদী, এত জল, এত রকমের তার বৈচিত্র্য । তাই মেরলি, গলুইয়া, হলা, বতালি, কোষা, বেতনাই, ধোলাই, বাছাড়ি, সুলতানি, খোরোকিস্তি, পাটিয়া, ছোট্, শালতি, পাউকিয়া, কাইলে বাছাড়ি, মালো বাছাড়ি, ডিঙি, জেলে ডিঙি, ডুঙ্গা, ডোঙ্গা - এই সব নৌকো এখনও আছে । নৌকার অবয়বে কোথাও যেন একটা ভাস্কর্যের বিষয়টি লুকিয়ে রয়েছে । নৌকা শুধু নৌকা নয়, তাতে জড়িয়ে আরও অনেক কিছু ।"

তাঁর কথায়, "নৌকা সমাজের একটি সিম্বলিক রিপ্রেজেন্টেশন । নৌকা কখনও মেয়ে, কখনও মা, কখনও সে ঘরের বউ । এইসব নিয়েই আমার কাজ । যেখানে সমাজ বিজ্ঞান জড়িয়ে । পৃথিবী জুড়ে নৌকা রয়েছে । কিন্তু নদীমাতৃক বাংলার নৌকার বৈচিত্র্য পৃথিবীতে বিরল । এটা আমার কথা নয় । পুরো বাংলা হচ্ছে নৌকার স্বর্গরাজ্য । জেমস হর্নেল, ব্যাসিল গ্রেনহিল, সর্ন ম্যাগগিলরা নৌকা নিয়ে কাজ করেছেন । তাঁদের পাশে আমি বাঙালি হিসেবে কাজ করাটা আমার পক্ষে সহজ, কারণ সেই ভাষাটা আমি জানি ।"

রকমারি নৌকার মিনিয়েচার (নিজস্ব চিত্র)

নৌকা বলতে একটা মোচার খোলের অবয়ব সামনে ভেসে ওঠে । কিন্তু নৌকার অবয়ব ঠিক এতটা সহজ কিছু নয় । নদীর চরিত্র ও প্রয়োজন অনুসারে নৌকার আকার ও আকৃতি বদলে যায় । গেস্ট স্কলার হিসেবে ডেনমার্কের ভাইকিং শিপ মিউজিয়ামে কাজ করতে গিয়ে তিনি দেখেছিলেন, ওখানকার গবেষকরা মাটি খুঁড়ে নৌকা বের করছেন । তখন তাঁদের স্বরূপ ভট্টাচার্য বলেন, তাঁর দেশে নৌকা এখনও জলে ভেসে বেড়ায় । তাঁরা যে নৌকা মাটি খুঁড়ে বের করছেন, তা বাংলার নদীতে বিদ্যমান ।

স্বরূপ ভট্টাচার্য বলেন, "নৌকার ভিন্ন নাম যেমন রয়েছে, তেমনই তার কাজ ঐতিহ্য দুটোই আলাদা । যেমন ধরুন চাঁদ নৌকা । এই নৌকাটি চলে বাংলাদেশের কক্সবাজার অঞ্চলে । আবার মহাজনী নৌকা চলে আমাদের বাগবাজার গঙ্গায় । যেখানে তারা বড় ওজনের মাল নিয়ে গন্তব্যে ভেসে যায় । নৌকা সমুদ্রে চলবে নাকি নদীতে চলবে, তার উপর নির্ভর করে তার গঠনশৈলী । বলাগড়ের ডিঙি নৌকা পনেরো থেকে কুড়ি হাতের হয় । সব জায়গাতে চলে । সব কাজে চলে । উত্তরবঙ্গের কোষা নৌকার তলাটা চ্যাপ্টা । কারণ তিস্তা অত গভীর নয় । তলাটা গোল হলে মাটির সঙ্গে লেগে যাবে । আবার টাকি হাসনাবাদের কাছে চলে 28 হাতের জেলে ডিঙি । এই নৌকা কিন্তু রায়মঙ্গল নদীতে চলবে না । কারণ আড়াই হাতের ঢেউকে মাথায় নিতে হবে । তার মাপ 28 হাত । তাই নৌকাকে বড় হতে হবে । নইলে জল ঢুকে যাবে । আসলে নৌকা যে বানায়, যে ক্রয় করে, যে চালনা করে এবং যে চড়ে যায়, সব কিছু মিলে মিশে যায় এই কাঠের খোলে । অর্থাৎ জীবনের একটা চক্র আবর্তিত হতে থাকে ৷"

নৌকা বিশারদ স্বরূপ ভট্টাচার্য (নিজস্ব চিত্র)

বাংলাদেশের জাদুঘরে রয়েছে 179 ধরনের নৌকা । এপার বাংলায় রয়েছে 30 ধরনের নৌকা । কিছু অবলুপ্ত হয়েছে । এই নৌকা তৈরির আলাদা ভাষাও রয়েছে । মিস্ত্রিরা বলেন, 'নৌকার রাগ কতটা হবে ?' রাগ হল এখানে নৌকার শিয়ার । অর্থাৎ নৌকার দুপাশ কতটা গভীর হবে । এই প্রযুক্তি নৌকার কারিগররা বংশ পরম্পরায় বয়ে নিয়ে চলেছেন ।

নৌকা তত্ত্বে বিশারদ স্বরূপ ভট্টাচার্য ইতিমধ্যে দেশ বিদেশে ছুটে বেড়াচ্ছেন বাংলার প্রাচীনতম জলযানের অস্তিত্ব ইতিহাস টিকিয়ে রাখতে । এই কাজে তিনিই বর্তমানের ধারক বাহক । নৌকার মিনিয়েচার তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন কোভিডের সময় । অবয়বের মধ্যে দিয়ে অস্তিত্বের ছবি তুলে ধরার ভাবনা যেমন ছিল, তেমন উপার্জনের তাগিদও ছিল । স্বরূপ ভট্টাচার্যের কথায়, "আমি তো কোনও বই লিখিনি । আমার এই অবয়বের মধ্যেই ভালোবাসা লুকিয়ে নৌকার প্রতি ৷" নৃতত্ত্ববিদ্যার মননকে সামাজিক তত্ত্ব ধরে রাখার কাজে ব্যবহার করে নৌকার ইতিকথা লিখে চলেছেন স্বরূপ ভট্টাচার্য । যা ভবিষ্যতের দলিল ।

ABOUT THE AUTHOR

...view details