হুগলি, 18 মে:বিশ্বকবির ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ পড়া নেই এমন বাঙালির সংখ্যা কম। সেখান থেকে ধার করেই বলা যায়, জেন-ওয়াইয়ের কাছে সিঙ্গুর এক স্বপ্নভঙ্গের নাম। তিলোত্তমা কলকাতাকে আরও গতি দিয়েছে যে কয়েকটি সড়ক, তার অন্যতম দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে। কলকাতার দিক থেকে আসা বা কলকাতার দিকে যাওয়া যাত্রীবাহী থেকে পণ্যবাহী, বহু গাড়ি এই রাস্তা ধরেই চলে যায় ঝাড়খণ্ড, বিহার বা আরও দূরে। দিনরাত অবিরত গাড়ির স্রোত। তবে এই রাস্তার ধারে, কলকাতার পার্শ্ববর্তী একটি অঞ্চলের কেউ কেউ এখনও মনে করেন, এই গাড়ির সংখ্যা আরও অনেকটা বাড়তে পারত। বাড়ত আরও অনেক মানুষজনের আনাগোনা।
"অনেক বেশি গাড়ির চলাচল হত এখানে, কত লোক আসত!" সিংঘের ভেড়ির বাসিন্দা বনমালী পালের দৃষ্টি দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে পেরিয়ে অন্যপারের ঘাসের প্রান্তরে হারিয়ে যায়। সেই পোড়ো জমির দিকে। যা 2011-তে বাংলার রাজনৈতিক সমীকরণ আমূল বদলে দিয়েছিল। তবে আজকের সিঙ্গুর, আজকের সিংহের ভেড়ি, বেড়াবেড়ি, বাজেমেলিয়ার অধিকাংশ মানুষজন আর না-হওয়া ন্যানো গাড়ির কারখানা নিয়ে কথা বলেন না। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে আগামী 20 তারিখ আবারও তাঁরা ভোটার লাইনে দাঁড়াবেন। ওইদিন হুগলি লোকসভা কেন্দ্রে ভোট।
2019 সালে তৎকালীন সাংসদ রত্না দে নাগকে হারিয়ে বিজেপি প্রার্থী লকেট চট্টোপাধ্যায়ের জেতা অনেকের কাছেই ছিল বড় চমক। তবে সেটাই প্রথম নয়। এর আগেও হুগলিতে উড়েছিল গেরুয়া পতাকা। 1952 সালে দেশে প্রথম নির্বাচনের সময় এই আসন থেকে জিতেছিলেন অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভার প্রার্থী নির্মল চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এরপর থেকে টানা 2009 পর্যন্ত বামেদের দুর্ভেদ্য ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছিল হুগলি ।
মাঝে মাত্র একবার যতিচিহ্ন পড়ে। 1984 সালে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির মৃত্যুর পরের ভোটে এই আসনে জিতেছিল কংগ্রেস। একটা সময় হুগলির সংসদীয় আসনের সঙ্গে এখানকার সিপিএম সাংসদ রূপচাঁদ পালের নাম কার্যত সমার্থক হয়ে গিয়েছিল। বদল আসে 2009 সালে।
2004 সালের পর থেকে ভরা বাম আমলেও হুগলি নিয়ে ক্রমশ চিন্তিত হয়ে উঠেছিলেন সিপিএম নেতৃত্ব। এককালের নিশ্চিত আসন শিল্পতালুক হুগলিতে ততদিনে ঘটে গিয়েছে বেশ কয়েকটি ঘটনা। দেশকে আইকনিক অ্যাম্বাসাডর গাড়ি দেওয়া হিন্দমোটর কারখানা বন্ধের মুখে। বন্ধ শাহগঞ্জের ডানলপ কারখানাও। রিষড়া থেকে ত্রিবেণী পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা পাট শিল্পের অবস্থাও বেশ শোচনীয়। কাপড়ের মিল থেকে সার তৈরির কারখানাগুলির অবস্থাও বলার মতো নয়। এমনই বিষম দৃশ্যের প্রেক্ষাপটে আবির্ভাব সিঙ্গুর-উপাখ্যানের।
সপ্তমবার বিধানসভা নির্বাচনে জিতে সিঙ্গুরে টাটাদের নিয়ে এসে কারখানা করার পরিকল্পনা করে বাম সরকার। প্রায় হাজার একরের কাছাকাছি জমি অধিগ্রহণের পরিকল্পনা হয়। প্রথম থেকেই আপত্তি জানান তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। হাতে ধানের শিস নিয়ে নিজের প্রতিবাদ ধ্বনিত করেন লোকসভাতেও। এরই মধ্যে কারখানা তৈরি শুরু হয়। 2006 সালের ডিসেম্বর মাসে আমরণ অনশন শুরু করেন মমতা। তাতেও কারখানা নির্মাণ বন্ধ হয়নি। 2008-এর জানুয়ারিতে জমি অধিগ্রহণের পক্ষেই রায় দিয়েছিল কলকাতা হাইকোর্ট। তবে নিজের অবস্থান থেকে সরে আসেননি মমতা।
সে বছর মে মাসের পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় মাথা তুলে দাঁড়ায় তৃণমূল। ততদিনে নন্দীগ্রামের ঘটনাও ঘটে গিয়েছে। একদিকে গ্রামে নির্বাচনী সাফল্য, অন্যদিকে সমাজের বিভিন্ন স্তরে তৈরি হওয়ার চাপকে কাজে লাগিয়ে অগস্টে নয়া রাজনৈতিক কর্মসূচি শুরু করলেন মমতা। কলকাতার বুকে শুরু হল অনির্দিষ্টকালের ধরনা। সামগ্রিক চাপের মুখে পরের মাসে কাজ বন্ধ করল টাটারা। সমস্যার সমাধানে উদ্যোগী হয়েছিল বাম সরকার। বিরোধী নেত্রীর সঙ্গে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে আলোচনা চলল। মাত্র দু'দিনের মধ্যেই বোঝা গেল এই আলোচনা থেকে সমাধান সূত্র বেরবে না।