কলকাতা, 15 জানুয়ারি: রেশন দুর্নীতি মামলায় জামিন পেলেন প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতপ্রিয় মল্লিক ৷ আদালত সূত্রে খবর, 25 হাজার টাকার দু'টি বন্ড এবং 50 লক্ষ টাকার একটি ব্যক্তিগত বন্ড জমা দিতে হবে জ্যোতিপ্রিয় ওরফে 'বালু'কে । 2023 সালে 27 অক্টোবর রেশন দুর্নীতি মামলা তাঁকে গ্রেফতার করেছিল ইডি ৷ বুধবার তাঁর জামিন মঞ্জুর করল নগর দায়রা আদালত ৷
প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রীর আইনজীবীরা জানিয়েছেন, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের বিরুদ্ধে আলাদা কোনও মামলা নেই ৷ তাই আগামিকাল, 16 জানুয়ারি তিনি জেল থেকে মুক্তি পাবেন ৷ এর আগের দিন শুনানিতে রেশন দুর্নীতি মামলার দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল আদালত, তদন্ত প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন বিচারক ৷ বিচারক কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডিকে জোত্যিপ্রিয় মল্লিকের থেকে পাওয়া চিঠি নিয়ে প্রশ্ন করেন ৷ সেদিনই বিচারকের মন্তব্যে তাঁর জামিন পাওয়ার ইঙ্গিত মিলেছিল বলে আইনজীবীরা জানিয়েছিলেন ৷
জামিন পেয়েছেন জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, সেই বিষয়ে বললেন তাঁর আইনজীবী শ্যামল ঘোষ (ইটিভি ভারত)
বিচারক প্রশান্ত মুখোপাধ্যায় বলেন, "এমন একটা চিঠি যা আপনারা বাজেয়াপ্ত করেননি ৷ এমন চিঠি যাতে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়েছে অথচ আপনারা কাগজে-কলমে চিঠি বাজেয়াপ্ত দেখাননি ৷ চিঠি এলো কোথা থেকে ? শুধু মুখে বললে হবে ? গোটা মামলাটা যখন এই নথির উপর নির্ভর করে, তাই কি না আপনারা বাজেয়াপ্ত করেননি ৷"
ইডির উদ্দেশে বিচারক আরও বলেন, "আপনারা রেশন দুর্নীতির কথা বলছিলেন, অনাহারে তো কেউ মারা যায়নি ? কেউ এসে অভিযোগ করেনি ? আপনারা তো চুরির তদন্ত করছিলেন, রেশন দুর্নীতি কী করে পেলেন ? ইডি মনে করলেই হবে না, বিশ্বাস করলে হবে না, বিষয়টা যখন আদালতে তখন আদালতকে বিশ্বাস করাতে হবে ৷"
এর জবাবে ইডির বক্তব্য ছিল, "পরিস্থিতির আউটকাম লেটার ৷" তাতে ক্ষুব্ধ বিচারক বলেন, "ছ'টা এফআইআর নির্দিষ্ট করে দিচ্ছে না যে ভীষণ বড় দুর্নীতি হয়েছে, বৃহৎ আকারে ভুল বোঝানো বা মিথ্যে বোঝানো হয়ে থাকলে উপভোক্তাদের উপর তার প্রতিফলন থাকবে ৷ কেউ রেশন পায়নি বা না খেয়ে মারা গিয়েছে এমন তো হয়নি !"
বিচারক আরও বলেন, "মিলে সার্চ করে নথি পেলেন ৷ যদি পিডিএস নিয়ে র্যাকেট চলে, তাহলে তো আপনাকে সেটা প্রমাণ করতে হবে ৷" ইডির আইনজীবী পাল্টা বলেন, "তদন্ত চেয়ারে বসে হয় না ৷ এখানে অ্যানেটেনা নেই যে, কার কী আছে সেটা বলে দিতে পারব ৷ তার জন্য গোটা বিষয়ে তদন্ত চলছে ৷ পুরো তৈরি কেক নয় যে একবারে খাবো ৷ কিন্তু ফ্রুট কেক তো বটেই ৷ আমরা সুপারম্যান নই ৷ আপনি যে গতিবেগ আশা করেছিলেন, আমরা হয়তো সেটা করতে পারিনি ৷"
বিচারক বলেন, "আমি সুপারম্যান হতে বলছি না ৷ যুক্তিযুক্ত হলেই হলো ৷" জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বিচার বিভাগীয় হেফাজতে এসএসকেএমে ছিলেন ৷ আদালতের নির্দেশে সেখানে নিরাপত্তায় সিআরপিএফ মোতায়েন করা ছিল ৷ সেখানে যদি কোনও চিঠি পাওয়া যায়, তাহলে সেটা জেলের ডায়রিতে নথিভুক্ত হওয়া উচিত ৷ জেল কর্তৃপক্ষকে এড়িয়ে কীভাবে তা তদন্তকারী অফিসারের কাছে পৌঁছয়, সেই প্রশ্নও তুলেছিলেন বিচারক ৷
2023 সালের রেশন দুর্নীতি মামলায় প্রথম গ্রেফতার হন রাজ্যের প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ৷ তাঁর সল্টলেকের বাড়িতে দীর্ঘক্ষণ তল্লাশি চালানোর পর শেষে 27 অক্টোবর ভোরে বালুকে গ্রেফতার করে ইডি ৷ বালুকে গ্রেফতারের আগে উত্তর 24 পরগনার ব্যবসায়ী বাকিবুর রহমানকে গ্রেফতার করেছিলেন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার গোয়েন্দারা ৷ তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি একজন ব্যবসায়ী হলেও বিভিন্ন প্রভাবশালীদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে তাঁর কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়েছিল ৷ এই প্রভাবশালীদের মধ্যে ছিলেন অন্যতম রাজ্যের তৎকালীন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ৷
এর আগে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতির কথা তুলে ধরে একাধিকবার আদালতে জামিনের আবেদন করেছিলেন ৷ কিন্তু কোনও ভাবেই তাঁর জামিন মঞ্জুর হয়নি ৷
আজ জ্যোতিপ্রিয়র জামিন মঞ্জুর করে ব্যাঙ্কশাল কোর্ট ৷ তবে জামিনের শর্ত অনুযায়ী, রেশম দুর্নীতি মামলায় অভিযুক্ত প্রাক্তন মন্ত্রীকে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার সঙ্গে তদন্তে সবরকমের সহযোগিতা করতে হবে ৷ পাশাপাশি রাজ্য ছেড়ে যাওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট সংস্থা এবং স্থানীয় প্রশাসনকেও জানাতে হবে বালুকে ৷ এছাড়া জ্যোতিপ্রিয়র পাসপোর্টও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জমা দিতে হবে ৷ হেফাজতে থাকাকালীন একাধিক সময় শারীরিক অবস্থার অবনতির জন্য জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক হাসপাতালে ভর্তি হন ৷ পরে তিনি প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগারে ছিলেন ৷
এদিকে রেশন দুর্নীতি মামলায় একের পর এক অভিযুক্ত বাকিবুর রহমান, শঙ্কর আঢ্যরা আগেই জামিন পেয়েছেন ৷ একা জ্যোতিপ্রিয়ই ছিলেন জেলে ৷ আদালতে বালুর আইনজীবী বাকিবুর-শঙ্করের জামিনকে হাতিয়ার করে তাঁর মক্কেলের মুক্তির পক্ষে সওয়াল করেছেন ৷ আইনজীবী বলেছেন, "জ্যোতিপ্রিয় অসুস্থ ৷ জেলের বাইরে চিকিৎসার প্রয়োজন ৷" উল্টোদিকে জামিন আটকাতে মরিয়া ইডির দাবি ছিল, "জ্যোতিপ্রিয় দুর্নীতির গঙ্গাসাগর ৷ কিং মেকার ৷ তিনি জেলের বাইরে বেরলে তদন্তকে প্রভাবিত করতে পারেন ৷ কিন্তু এদিন বিচারকের সামনে ইডির এই যুক্তি ধোপে টেকেনি ৷"
বিশেষ ইডি আদালতের বিচারকের পর্যবেক্ষণ, তদন্ত প্রক্রিয়া চলছে ৷ কিন্তু তার জন্য় রাজ্যের প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রীকে হেফাজতে রাখার প্রয়োজন নেই ৷ এখনই মামলার ট্রায়াল শুরুর সম্ভাবনাও নেই ৷ তাই জ্যোতিপ্রিয়কে জামিন দিতে সমস্যা নেই ৷ তবে এই জামিন শর্তসাপেক্ষ ৷ জেলমুক্তির পরও কয়েকটি বিষয় তাঁকে মেনে চলতে হবে ৷ তদন্তকারী আধিকারিকদের সহযোগিতা করতে হবে ৷ বিচারপ্রক্রিয়ায় নিয়মিত উপস্থিত থাকতে হবে ৷ সাক্ষীদের প্রভাবিত করা চলবে না ৷ পাসপোর্ট-ভিসা জমা রাখতে হবে ৷ আদালতের অনুমতি ছাড়া রাজ্যের বাইরে যেতে পারবেন না ৷