মালদা, 12 ডিসেম্বর: কয়েকশো বছরের পুরোনো শহর ৷ পুরসভার বয়স 150 বছরেরও বেশি ৷ সময়ের সঙ্গে শহরের আয়তন বেড়েছে ৷ বেড়েছে লোকসংখ্যাও ৷ কিন্তু এখনও এই শহরের সব বাসিন্দা পরিস্রুত পানীয় জল পান না ৷ এই পরিস্থিতিতে এগিয়ে এসেছে গ্রাম ৷ গ্রামই মেটাচ্ছে শহরের তৃষ্ণা ৷
প্রতিদিন অন্তত 30 হাজার লিটার পরিস্রুত পানীয় জল গ্রাম থেকে ঢুকছে ইংরেজবাজারে ৷ ড্রামবন্দি সেই জলেই বেঁচে রয়েছেন শহরের কয়েক হাজার মানুষ ৷ যদিও পুরসভার তরফে দাবি করা হয়েছে, খুব তাড়াতাড়ি এলাকার প্রতিটি কোনায় পরিস্রুত পানীয় জল সরবরাহ করা হবে ৷
শহরবাসীর তৃষ্ণা মেটাচ্ছে গ্রাম (ইটিভি ভারত) যেসব এলাকায় পরিস্রুত পানীয় জলের পাইপ লাইন এখনও পৌঁছয়নি, সেসব জায়গায় ওয়াটার ট্রিটমেন্ট টাওয়ার বসানো হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুরসভা ৷ যদিও পুর কর্তৃপক্ষের এই আশ্বাসে বিশ্বাস করতে পারছেন না ভুক্তভোগীরা ৷ তাঁরা বলছেন, অনেকদিন ধরেই পুর কর্তৃপক্ষ শহরের প্রতিটি জায়গায় পরিস্রুত পানীয় জল পৌঁছে দেওয়ার আশ্বাস দিচ্ছে ৷ কিন্তু এখনও সেই আশ্বাস বাস্তব রূপ পায়নি ৷ তাই না-আঁচালে বিশ্বাস নেই ৷
পরিস্রুত পানীয় জল পান না বাসিন্দারা (নিজস্ব চিত্র) ভূবিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন, মালদা শহর তো বটেই, গোটা জেলার ভূগর্ভস্থ জলে মিশে রয়েছে আর্সেনিক ও ফ্লুরোসিস বিষ ৷ এনিয়ে তাঁরা বহুবার জেলাবাসীকে সতর্ক করেছেন ৷ কিন্তু আর্সেনিক বা ফ্লুরোসিস বিহীন পানীয় জল কোথায় পাবেন পুরসভার 23, 25, 28, 29 নম্বর ওয়ার্ড-সহ আরও কয়েকটি এলাকার মানুষ ? বাধ্য হয়েই তাঁরা পানীয় জল কিনে খান ৷ সেই জল আসে লক্ষ্মীপুর কিংবা অমৃতির পরিস্রুত পানীয় জল প্রকল্প থেকে ৷ প্রতি 15 লিটার জলের ড্রামের জন্য গুনতে হয় 20 টাকা ৷ কিছু মানুষ এই পানীয় জল বিক্রি করেই নিজেদের অন্ন সংস্থান করছেন ৷
গ্রাম থেকে আসা ড্রামবন্দি জলেই বেঁচে রয়েছেন শহরের কয়েক হাজার মানুষ (নিজস্ব চিত্র) দেশের অন্যতম পুরনো এই পুরসভা স্থাপিত হয়েছিল 1868 সালে ৷ বর্তমানে পুর এলাকার আয়তন 13.25 বর্গ কিলোমিটার ৷ মোট ওয়ার্ড রয়েছে 29টি ৷ 2011 সালের জনগণনা অনুযায়ী পুর এলাকায় বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা 2 লাখ 5 হাজার 521 জন ৷ 12 বছর পর সেই সংখ্যাটি নিশ্চিতভাবে আরও এক লাখ বেড়েছে ৷ গোটা শহরে মোট 117টি বস্তি রয়েছে ৷ অর্থাৎ জনঘনত্ব অনুযায়ী, এই শহর বেশ বড় ৷ অথচ সেই শহরে পানীয় জল সরবরাহের জন্য রয়েছে মাত্র কয়েকটি ওভারহেড ট্যাংক ৷ তার মধ্যে দুটিতে এক লাখ গ্যালন জল ধরে ৷
সম্প্রতি তৈরি হওয়া কয়েকটি ট্যাংকে জল ধরে 2.59 লাখ গ্যালন ৷ শহরবাসীকে পরিস্রুত পানীয় জল খাওয়ানোর জন্য বছর দুয়েক আগে ঘটা করে নতুন পানীয় জল প্রকল্পের সূচনা হয়েছিল ৷ পুর কর্তৃপক্ষ দাবি করেছিল, মাস ছয়েকের মধ্যেই গোটা পুর এলাকায় পরিস্রুত পানীয় জলের সংযোগ পৌঁছে যাবে ৷ আজও তা হয়নি ৷ শুধু তাই নয়, বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডে পরিস্রুত পানীয় জলের সংযোগ পর্যন্ত নেই ৷ বাধ্য হয়েই পানীয় জল কিনতে হচ্ছে নাগরিকদের একাংশকে ৷
150 বছরেও পরিস্রুত পানীয় জল দিতে পারেনি পুরসভা (নিজস্ব চিত্র) অরবিন্দ পার্ক এলাকার বাসিন্দা হাসি মণ্ডল বলছেন, "প্রায় 10 বছর ধরে এখানে আছি ৷ এখনও পানীয় জলের কোনও ব্যবস্থা নেই ৷ বছরখানেক আগে পাইপ লাইন বসানোর নামে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি হলেও পুরসভা এখানে পানীয় জলের সংযোগ করেনি ৷ জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরও রাস্তার পাইপ লাইনে ঠিকমতো জল দেয় না ৷ আগে আমরা পলিটেকনিক সংলগ্ন এলাকা থেকে জল নিয়ে আসতাম ৷ কিন্তু এখন সেখানেও জল পাওয়া যায় না ৷ বাধ্য হয়েই আমাদের পানীয় জল কিনে খেতে হচ্ছে ৷ প্রতি 15 লিটার জলের জন্য খরচ হচ্ছে 20 টাকা ৷ আমাদের পক্ষে তো প্রতিদিন অমৃতি গিয়ে পানীয় জল নিয়ে আসা সম্ভব নয় !"
প্রতিদিন অন্তত 30 হাজার লিটার পরিস্রুত পানীয় জল গ্রাম থেকে ঢুকছে শহরে (নিজস্ব চিত্র) এভাবে সরকারি পানীয় জল যে ড্রামে ভরে বিক্রি করা যায় না, তা বিলক্ষণ জানেন বিক্রেতারা ৷ এনিয়ে প্রশ্ন করতেই মুখে কুলুপ তাঁদের ৷ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমনই এক পানীয় জল বিক্রেতার বক্তব্য, "আজ থেকে নয়, বছর 12 ধরে এই ব্যবসা করছি ৷ আগে পলিটেকনিক সংলগ্ন এলাকা থেকে জল সংগ্রহ করে বাড়ি বাড়ি বিক্রি করতাম ৷ এখন সেখানে জল পাওয়া যাচ্ছে না ৷ তাই অমৃতি থেকে জল নিতে হচ্ছে ৷ প্রতি জারে 15 লিটার জল ধরে ৷ আমরা ভুটভুটিতে চাপিয়ে সেই জল শহরে নিয়ে যাই ৷ প্রতিটি ভুটভুটিতে 65টি জার ধরে ৷ প্রতিদিন 40টির বেশি ভুটভুটি জল নিয়ে শহরে যাচ্ছে ৷"
কী বলছেন পুরসভার চেয়ারম্যান কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরী ? তাঁর বক্তব্য, "এর আগে এই শহরের পানীয় জল প্রকল্পে 101 কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছিল ৷ ওই বরাদ্দে প্রায় 90 কোটি টাকার কাজ হয়েছে ৷ এখন 12 কোটি টাকায় পাইপলাইনের লিংকের কাজ চলছে ৷ আমরা অম্রুত-2 (অটল মিশন ফর রেজুভিনেশন অ্যান্ড আরবান ট্রান্সফরমেশন) প্রকল্পে 153 কোটি টাকার আরও একটি পানীয় জল প্রকল্প তৈরি করছি ৷ যেসব জায়গায় এখনও পরিস্রুত পানীয় জলের পাইপলাইন বসেনি, সেখানে আমরা ওয়াটার ট্রিটমেন্ট টাওয়ার বসাচ্ছি ৷ ওই টাওয়ার থেকেও সম্পূর্ণ পরিস্রুত পানীয় জল পাওয়া যাবে ৷"
তাঁর কথায়, "তবে এই শহর এখন উপরদিকে বাড়ছে ৷ জনসংখ্যা বাড়লেও শহর পরিসরে বাড়ছে না ৷ তবু আমরা চেষ্টা করছি সবাই যেন পরিস্রুত পানীয় জল পান ৷ পানীয় জলের সমস্যা নিয়ে আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ জানালে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে ৷ মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ মেনে আমরা শহরের প্রতিটি বাসিন্দাকে যতটা সম্ভব পরিষবা দিতে বদ্ধপরিকর ৷"