হায়দরাবাদ, 24 এপ্রিল: দাদরের শিবাজি পার্ক থেকে ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের দূরত্ব 14 কিলোমিটার। যা অতিক্রম করতে বেশি সময় লাগেনি সচিন রমেশ তেন্ডুলকরের ৷ বাকিটা ইতিহাস ৷ দীর্ঘ 24 বছরের ক্রিকেট কেরিয়ারে ব্যাট হাতে সারা বিশ্বকে শাসন করেছেন পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চির এই ভারতীয় ৷ এক দশকেরও বেশি আগে টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় জানালেও এখনও 'ক্রিকেটঈশ্বর' রূপে পূজিত হন এই মুম্বইকর ৷
বুধবার একান্নতে পা দিলেন ঝাকড়া চুলের এই 'কিশোর'। জীবনের অর্ধশতক অতিক্রম করার পরও তিনি কিশোর ৷ কারণ ক্রিকটের প্রতিটি প্রজন্মের কাছে তিনি চিরতরুণ ৷ কাশিরাম দাস লিখেছিলেন, "যাহা নাই মহাভারতে, তাহা নাই ভারতে...৷" সচিন তেন্ডুলকরের ক্রিকেট জীবন তেমনই। তাঁর ক্রিকেট জীবনে যা নেই, তা মহান খেলা ক্রিকটেও নেই। শততম সেঞ্চুরির মালিক তিনি। জীবনে একান্নতে সবে পা দিলেন। ভক্তরা বলছেন, ক্রিকেটীয় সেঞ্চুরির মত শচিন জীবনেও শতায়ু হন।
1983 সালে কপিল দেবের ভারতের লর্ডসে বিশ্বকাপ জয়ই সচিনকে ক্রিকেট সম্পর্কে উৎসাহী করেছিল। তিনি নিজেও বারবার বলেছেন, লর্ডসে ভারতের বিশ্বকাপ জয় তাঁর অনুপ্রেরণা। কিন্তু কালের যাত্রাপথ তাঁকে যুবসমাজের কাছে অনুপ্রেরণা হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। সচিন শুধু ক্রিকেটার নন, ক্রিকেটঈশ্বর। তিনি শুধু বাইশ গজের নয়, ভারতেরও রত্ন ৷ নানা মণিহার ও নানা সম্মানে প্রাপ্তির ঝুলি ভরছে এই মারাঠির ৷ তাঁর ময়ুর সিংহাসনে কোহিনূরটা অবশ্যই 'সেঞ্চুরি অফ সেঞ্চুরিজ'। লাল, সাদা, গোলাপি কিংবা টেষ্ট, ওয়ান-ডে এবং টি-20 ৷ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রিকেটের ফরম্যাট বদলালেও বদলায়নি সচিন ৷ ক্রিকেট ব্যাট যেন তাঁর 'গাণ্ডিব' ৷ আর ক্রিকেটীয় কুরুক্ষেত্রে তিনি হলেন 'অর্জুন'।
বান্দ্রার সাহিত্য সহবাসে অধ্যাপকের ঘরে জন্মানো ঝাঁকড়া ছুলের ছেলেটা যেন ক্রিকেট খেলার জন্যই জন্মেছিলেন। ছোটবেলায় টেনিস তারকা জন ম্যাকেনরোর ভক্ত ছিলেন। পছন্দ করতেন তাঁর মত হেডব্যান্ড পড়তে। দাদা অজিত তেন্ডুলকর তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন ব্যাট কিনতে। সচিন সেদিন পছন্দ করেছিলেন একটু ভারি ব্যাট। হয়তো বেশি দিন টিকবে বলেই মনে হয়েছিল সেদিনের বিস্ময় বালকের। একসময় ভারি ব্যাটেই অভ্যস্ত হলেন। তাই তাঁর নেওয়া প্রতিটি স্ট্রোক ভীমের গদার মতো বোলারের ছোড়া বলের উপর আছড়ে পড়ত।
কোচ রমাকান্ত আচেরকর ছিলেন সচিনের ধ্রুবতারা। কথায় বলে, "চ্যালা মেলে অনেক গুরু মেলে এক।" সচিনের জীবনে আচেরেকরও ছিলেন তাই। যাঁর নিরন্তর প্রচেষ্টা সচিনকে পরিণত করে তুলেছিল কঠিন ইস্পাতে ৷ 15 নভেম্বর, 1989 ৷ করাচির ন্যাশানাল স্টেডিয়ামে মাত্র 16 বছর বয়সে বিশ্বের সে সময়ের সেরা পাক বোলিংয়ের সামনে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছিল সচিনের ৷ ইমরান খান, ওয়াসিম আক্রম, ওয়াকার ইউনিস এবং আব্দুল কাদিরের বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে উঠেছিলেন পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চির এই ভারতীয় ৷ বাকিটা ইতিহাস...৷ ব্যাট হাতে শাসন করলেন ক্রিকেটবিশ্ব ৷ তারণ্যেই উদিত হলেন মহাতারকায়।
1987 বিশ্বকাপে বলবয় হিসেবে মাঠে থাকা সচিন পাঁচ বছর পরে ভারতীয় জার্সিতে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে আলোচনার কেন্দ্রে। 1992 সালে জীবনের প্রথম বিশ্বকাপেই জাত চেনালেন সচিন। 1996 সালে দেশের মাটিতে বিশ্বকাপে 'লিটল মাস্টার' ছিলেন ভারতীয় দলের সেরা বাজি। ইডেনে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে সেমিফাইনালে তিনি যতক্ষণ ক্রিজে ছিলেন, ততক্ষণ ভারতের আশা ছিল। ক্রিকেটের নন্দনকাননে সচিনের ইনিংসের সমাপ্তি ও তাঁর বাল্যবন্ধু বিনোদ কাম্বলির ক্রন্দনরত দৃশ্যের সাক্ষী ছিল ক্রিকেটবিশ্ব ৷ কিন্তু ভারতের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়েনি ৷ দ্বীপরাষ্ট্রের কাছে হেরে বিশ্বকাপ অভিযান শেষ করেছিল ভারত ৷ মাঝে হিরো কাপ, উইলস ট্রফি, টাইটানস কাপ জয় থেকে টেস্ট সিরিজ জয়কে অভ্যাসে পরিণত করা ভারতীয় দলের তিনিই ছিলেন অধিনায়ক ও কোচের 'মধুসুদন দাদা'।
ইংল্যান্ডের মাটিতে 1999 বিশ্বকাপ চলাকালীন পিতৃহারা সচিন দেখিয়েছিলেন তাঁর বাইশগজের প্রেম। জীবনের চরমতম দুঃখের দিনে একরাশ শোক বুকে নিয়ে দেশে ফিরে সেরেছিলেন বাবার পরলৈকিক কাজ ৷ তারপর আবার মাঠে ফিরে সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে জিতিয়েছিল দেশকে। শুধু তাই নয়, সেদিন সেঞ্চুরি করে আকাশের দিকে ব্যাট তুলে সদ্যপ্রয়াত বাবার প্রতি সচিনের স্মৃতিতর্পন দেখে ছিল ক্রিকেটবিশ্ব। 2003 দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে সচিন ছিলেন যেন ক্ষুধার্ত 'সিংহ'। সবচেয়ে বেশি রান করে সেরার সেরা হয়েও দেশকে ট্রফি দিতে না-পারার যন্ত্রণায় কুঁকড়ে ছিলেন মাস্টারব্লাস্টার৷
2011 বিশ্বকাপ ফাইনালে ওয়াংখেড়েয় বিশ্বকাপ জেতে মহেন্দ্র সিং ধোনির ভারত। কপিল দেবের 28 বছর পর অধরা স্বপ্ন পূরণ হল সচিনের। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে একান্ন বছরের সচিন বাইশ গজকে বিদায় জানিয়েও জানাননি ৷ কারণ আইপিএলে মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের মেন্টর হিসেবে এখনও কাজ করে চলেছেন সচিন ৷ সুতরাং সচিনের ক্রিকেটীয় যাত্রাপথ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্পের মতো ৷ শেষ হয়েও হইল না শেষ...৷
আরও পড়ুন: