গত 15 বছর ধরে বাংলাদেশে যে স্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, সেদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার আচমকা ইস্তফায় তা শেষ হয়ে গিয়েছে ৷ ইতিহাস যেন নিজেই নিজের পুনরাবৃত্তি করেছে ৷ প্রায় পাঁচ দশক আগে, 1975 সালের 15 অগস্ট স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে হওয়া একটি অভ্যুত্থানে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল ।
শেখ হাসিনার শাসনকাল শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সেই দেশগুলির তালিকায় যুক্ত হল, যে দেশগুলি হিংসাত্মক আন্দোলনের জেরে রাজনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছিল ৷ 1971 সালের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের উত্তরসূরীদের জন্য সরকারি চাকরিতে 30 শতাংশের সংরক্ষণ নিয়েই প্রথমে আন্দোলন শুরু হয়েছিল ৷ দেশব্যাপী সেই ছাত্র-বিক্ষোভের জেরে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন হয়েছে ৷
এছাড়াও বাইরের প্রভাব তো ছিলই ৷ যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিনের মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং পাকিস্তানের মৌলবাদী সংগঠনগুলির সমর্থনও পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে । যদিও ছাত্র বিক্ষোভ একটি তাৎক্ষণিক অনুঘটক ছিল এবং বহিরাগত শক্তিগুলি আরও সূক্ষ্ম ভূমিকা পালন করেছিল ৷ তবে এর জেরে দু’টি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা তৈরি হয়েছে৷ তা হল, গণতন্ত্রের পরিসর সীমিত হয়েছে এবং ইসলামি শক্তির পুনরুত্থান হয়েছে ৷ ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ছবিটা বদলেছে ৷ এটার নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করার প্রয়োজন রয়েছে ৷
গণতন্ত্র নিয়ে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতায় চ্যালেঞ্জই বেশি ৷ সাফল্য এসেছে সীমিত ৷ দেশের মৌলিক মতাদর্শ - জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা - প্রতিনিয়ত বাধার সম্মুখীন হয়েছে । বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সীমিত সাফল্যকে দু’টি আন্তঃসম্পর্কযুক্ত কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায় ৷ প্রথমত, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক নীতিগুলি সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করতে অনিচ্ছা দেখিয়েছে । 1975 সালে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড ও 2024 সালে শেখ হাসিনার পদত্যাগের মধ্যে কারণ প্রায় একই ৷ দুই ক্ষেত্রেই নির্বাচিত সরকারগুলির স্বৈরাচারী মনোভাব ৷ যা বিরোধীদের জন্য খুব কম জায়গা রেখেছিল ৷ এর ফলে একটি ভঙ্গুর রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি হয় । বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রাথমিক বছরগুলিতে শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল এবং শেখ হাসিনার 15 বছরের শাসনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মিল হল, বিরোধীদের সরিয়ে দেওয়া, ব্যাপক দুর্নীতি ও স্বৈরাচারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ, এই শাসনগুলির মুখোমুখি হওয়া বৈধতা নিয়ে সংকট তৈরি করে ৷
2009 সালের জানুয়ারি থেকে 2024 সালের অগস্ট পর্যন্ত শেখ হাসিনার দ্বিতীয় মেয়াদ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ । কয়েক বছরের অনিশ্চয়তা ও সামরিক-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট 2008 সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিপুল বিজয় লাভ করে এবং 2009 সালে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় । 2008 সালে আওয়ামী লীগের প্রাপ্ত বিপুল জনসমর্থন বাংলাদেশি জনগণের আশা ও আকাঙ্খা প্রতিফলন ঘটিয়েছিল ।
সরকার দারিদ্র্য দূরীকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অগ্রগতি করলেও একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছে । এটা 2014, 2018 এবং 2024 সালের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন বিরোধীদের বয়কটের মাধ্যনে স্পষ্ট হয়েছিল । সমালোচকরা যুক্তি দিয়েছিলেন যে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পিছনের দিকে যাচ্ছে, নির্বাচনী প্রক্রিয়া হিংসা ও জালিয়াতি দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে । এছাড়া, অর্থনৈতিক উন্নয়নে শেখ হাসিনার অবদান সম্পর্কে জনগণের উপলব্ধি হ্রাস পেতে শুরু করে ৷ কারণ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ - যেমন প্রতিনিধিত্ব, অধিকার ও আইনের শাসন বজায় রাখার ক্ষেত্রে সরকারের কার্যকারিতা কমে গিয়েছিল । শক্তিশালী, বৈধ ও গণতান্ত্রিক বিরোধী দল যেকোনও গণতন্ত্রে নিরাপত্তা বেষ্টনী হিসেবে কাজ করে ৷ সেই বিরোধীদের অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ সরকার নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়, যখন বিরোধী দল, ইসলামপন্থী, নাগরিক সমাজ দ্বারা সমর্থিত ছাত্রদের সংগঠিত হিংসাত্মক বিক্ষোভ হয় ৷