নয়াদিল্লি, 8 জুলাই:গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত মায়ানমার ৷ জাতির ভিত্তিতে তৈরি দুটি সশস্ত্র সংগঠনের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে সেখানে ৷ এই পরিস্থিতিতে মিজোরাম-ভিত্তিক নাগরিক সমাজ সংস্থা বা সিভিল সোশাইটি অর্গানাইজেশন বাণিজ্য পথ অবরোধ করে রেখেছে ৷ যার প্রভাব পড়েছে ভারত-মায়ানমার সীমান্তে বাণ্যিজে ৷ পণ্য সরবরাহ বিঘ্নিত হয়েছে ।
ভারত থেকে মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করার পথে এই অবরোধ করা হয়েছে । এটি করেছে লংটলাই, মিজোরাম-ভিত্তিক নাগরিক সমাজ সংস্থা সেন্ট্রাল ইয়াং লাই অ্যাসোসিয়েশন (সিওয়াইএলএ) ৷ মায়ানমারের চিন রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ পালেতোয়া টাউনশিপের উপর আরাকান আর্মি জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনের নিয়ন্ত্রণের কারণে এই অবরোধ করা হয়েছে ৷ এটি একদিকে চিনল্যান্ড কাউন্সিল ও চিন ন্যাশনাল আর্মি এবং অপরদিকে আরাকান আর্মি ও চিন ব্রাদারহুড নামে বিভক্ত চিন গ্রুপের মধ্যে একটি সংঘাতের জন্ম দিয়েছে ।
কেন নয়াদিল্লির কাছে এই পরিস্থিতি উদ্বেগের বিষয় ?
কারণ পালেতোয়া হল ভারতের বিনিয়োগ করা কালাদান মাল্টি-মোডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্টের (কেএমটিটিপি) একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ । কেএমটিটিপি পশ্চিমবঙ্গের হলদিয়া বন্দরকে মায়ানমারের সিটওয়ে বন্দরের সঙ্গে সংযুক্ত করে, যা ভারতের বিনিয়োগে নির্মিত হয়েছিল । করিডোরটি তারপরে কালাদান নদীর নৌকা রুটের মাধ্যমে মায়ানমারের চিন রাজ্যের পালেতওয়া শহরের সঙ্গে সিত্তওয়েকে সংযুক্ত করেছে । পালেতোয়া উত্তর-পূর্ব ভারতের মিজোরামের সঙ্গে সড়কপথে যুক্ত রয়েছে । নির্মাণাধীন জোরিনপুই (মিজোরাম)-পালেতোয়া সড়ক ছাড়া সিটওয়ে বন্দর-সহ প্রকল্পের সমস্ত কাজ সম্পন্ন হয়েছে ।
সিওয়াইএলএ কী এবং এটি কার প্রতিনিধিত্ব করে?
সিওয়াইএলএ হল একটি প্রভাবশালী দক্ষিণ মিজোরাম-ভিত্তিক নাগরিক সমাজ সংস্থা এবং লাই জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে ৷ লাই হল একটি আদিবাসী জনগোষ্ঠী ৷ যারা প্রাথমিকভাবে মায়ানমারের চিন রাজ্যে এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের কিছু অংশে, বিশেষ করে মিজোরাম এবং মণিপুরে বসবাস করে । তারা বৃহত্তর চিন জনগোষ্ঠীর অংশ ৷ কিন্তু তাদের আলাদা সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত পরিচয় রয়েছে । লংটলাইয়ে অবস্থিত সিওয়াইএলএ ৷ এটি মায়ানমারের সীমান্তবর্তী দক্ষিণ মিজোরামের লাই জনগোষ্ঠীর স্বায়ত্তশাসিত জেলা পরিষদের সদর দফতর হিসেবেও কাজ করে ।
কেন ভারত থেকে মায়ানমারে পণ্য সরবরাহের উপর সিওয়াইএলএ অবরোধ জারি করেছে?
2021 সালের সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয় নোবেলজয়ী অং সান সুচির গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার ৷ এরপর থেকে জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনগুলি মায়ানমারে সামরিক জান্তাকে উৎখাত করার সাধারণ লক্ষ্য নিয়ে একসঙ্গে লড়াই করছে । আরাকান আর্মি এবং চিন ন্যাশনাল আর্মি এই জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনগুলির মধ্যে অন্যতম ।
আরাকান আর্মি মায়ানমারের রাখাইন রাজ্য (আরাকান) ভিত্তিক একটি জাতিগত সশস্ত্র সংগঠন । 2009 সালের 10 এপ্রিল এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ৷ আরাকান আর্মি হল ইউনাইটেড লীগ অফ আরাকান (ইউএলএ) এর সামরিক শাখা । 1988 সালে গঠিত হয় চিন ন্যাশনাল আর্মি ৷ এটিও মায়ানমারের চিন রাজ্যে অবস্থিত একটি জাতিগত সশস্ত্র সংগঠন, যা চিন জনগণের অধিকারের জন্য লড়াই করছে । আরাকান আর্মি এবং চিন ন্যাশনাল আর্মি উভয়ই চিন রাজ্য থেকে ও গুরুত্বপূর্ণভাবে পালেতোয়া টাউনশিপ এলাকা থেকে তাতমাডো বা মায়ানমার সামরিক বাহিনীকে বিতাড়িত করার জন্য লড়াই করছে ।
এই বছরের জানুয়ারিতে আরাকান আর্মি ঘোষণা করেছে, তারা ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী পালেতোয়া দখল করেছে । পালেতোয়া হল প্রথম জনপদ যা আরাকান আর্মির দখল করে ৷ আরাকান আর্মি নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে চিন রাজ্যের পালেতোয়া এবং রাখাইনের টাউনশিপগুলিতে সেনাঘাটিগুলি লক্ষ্য করে আক্রমণ চালাতে থাকে । পালেতোয়া হল রাখাইনের ঠিক উত্তরে এবং বাংলাদেশ ও ভারত উভয়েরই সীমান্তে ।
পালেতোয়া দখল করার পরেই চিন ন্যাশনাল আর্মি ও আরাকান আর্মির মধ্যে বিরোধ দেখা দেয় । শিলং-ভিত্তিক এশিয়ান কনফ্লুয়েন্স থিঙ্ক ট্যাঙ্কের সদস্য কে ইয়োমের দাবি, পালেতোয়া দখল করার পর আরাকান আর্মি চিন জনগণের জন্য শহরটি ছেড়ে দিতে অস্বীকার করেছে । ইটিভি ভারতকে ইয়োম বলেছেন, চিন ন্যাশনাল আর্মি এবং চিনল্যান্ড কাউন্সিল আশা করেছিল আরাকান আর্মি তাদের পালেতোয়া টাউনশিপ হস্তান্তর করবে এবং তারা ফের রাখাইন রাজ্যে ফিরে আসবে ৷ তবে আরাকান আর্মি তা করতে অস্বীকার করেছে ।"
চিনল্যান্ড কাউন্সিল হল চিনল্যান্ড রাজ্যের স্ব-শাসিত রাজনীতির আইনসভা । এটি গত বছরের 6 ডিসেম্বর চিনল্যান্ড কনভেনশন দ্বারা চিনল্যান্ড সংবিধান গৃহীত হওয়ার পরে গঠিত হয়েছিল ৷ এটি চিন রাজ্যের বিভিন্ন চিন সম্প্রদায়ের 235 জন প্রতিনিধি দ্বারা অনুমোদিত হওয়ার পর গঠন হয় । চিনল্যান্ড রাজ্যের দাবি করা অঞ্চলটি মায়ানমারের চিন রাজ্যকে ঘিরে রেখেছে । এটি বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত বরাবর পশ্চিম মায়ানমারের প্রায় সমস্ত চিন রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করে ।
ইতিমধ্যে চিনল্যান্ড কাউন্সিলের বিরোধী দলগুলি চিন ব্রাদারহুড নামে একটি নতুন সংগঠন তৈরি করেছে । মায়ানমারের দরিদ্রতম রাজ্য থেকে জান্তা বাহিনীকে বিতাড়িত করতে 9 জুন নতুন সংগঠন অপারেশন চিন ব্রাদারহুড শুরু করে । তারা এরপর আরাকান আর্মিতে যোগ দেয় । এর ফলে বৃহত্তর চিন জনগোষ্ঠীর অংশ লাই ক্ষুব্ধ হয় ।
মায়ানমারে চলমান সংঘাতের কারণে 25 মে থেকে ভারত অনির্দিষ্টকালের জন্য লংটলাই-পালতোয়া পথে বাণিজ্য বন্ধ করে দেয় ৷ তবে সিওয়াইএলএ এবং ইউএলএ-র মধ্যে আলোচনার পর 12 জুন থেকে পুনরায় সেই পথে বাণিজ্য চালু করা হয় । কিন্তু এখন যেহেতু আরাকান আর্মি চিন বাহিনীর হাতে পালেতোয়া টাউনশিপ হস্তান্তর করতে অস্বীকার করেছে, সিওয়াইএলএ বাণিজ্য পথ দিয়ে ভারত থেকে পণ্য সরবরাহ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ।
এই অবরোধের ফল কী হবে?
কে ইয়োম বলেছেন, "চিন ন্যাশনাল আর্মির সঙ্গে সিওয়াইএলএর সাধারণ স্বার্থ জড়িত রয়েছে । কালাদান রাস্তা সরাসরি মিজোরামের লংটলাইয়ের দিকে যায় । পালেতোয়া এবং রাখাইন রাজ্যের মানুষ ভারত থেকে ওষুধ এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহের জন্য এই রুটের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল । রাখাইন রাজ্য মায়ানমারের বাকি অংশ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন । এই অবরোধে এসব এলাকার মানুষ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ।"
কেন আরাকান আর্মি পালেতোয়াকে ছেড়ে দিতে অস্বীকার করছে?
কে ইয়োম উল্লেখ করেছেন, প্যালেটোয়া কৌশলগতভাবে এএমটিটিপি বরাবর অবস্থিত । মূলত যে পালেতোয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে তারা কেএমটিটিপির উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ করে ৷ আরাকান আর্মি কেএমটিটিপির প্রায় পুরো অংশ নিয়ন্ত্রণ করে । পালেতোয়া নিয়ন্ত্রণ করার ফেলে ভারতের সঙ্গে দর কষাকষির ক্ষমতা বাড়ায় আরাকান আর্মির । পরবর্তীতে কী হবে জানতে চাইলে ইয়োম বলেন,"আমাদের এখন অপেক্ষা করতে হবে এবং দেখতে হবে যে আরাকান আর্মি এই অবরোধে কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায় ।"