পশ্চিমবঙ্গ

west bengal

ETV Bharat / opinion

ভারত-মলদ্বীপ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নয়া অধ্যয়

ভারত বিরোধী স্লোগান দিয়ে মলদ্বীপের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন মোহাম্মেদ মুইজ্জু ৷ গত বছর নভেম্বরে ক্ষমতায় আসার 11 মাস পর চলতি মাসে ভারত সফর করলেন তিনি ৷

By Achal Malhotra

Published : 4 hours ago

India and Maldives Relations
মলদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মেদ মুইজ্জু ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি (পিআইবি)

2023 সালের নভেম্বরে মলদ্বীপের প্রেসিডেন্ট পদে বসেন মোহাম্মেদ মুইজ্জু ৷ তার পর প্রথমবারের জন্য গত 6-10 অক্টোবর ভারত সফর করেন তিনি ৷ এই রাষ্ট্রীয় সফরের তাৎপর্য তাঁর প্রেসিডেন্ট পদে বসার পর থেকে ভারত ও মলদ্বীপের মধ্যে সম্পর্ক কীভাবে বিকশিত হয়েছে, তার পটভূমিতে সবচেয়ে ভালোভাবে মূল্যায়ন করা যেতে পারে ।

সবচেয়ে প্রথমে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে মুইজ্জু একটি শক্তিশালী ‘ইন্ডিয়া আউট’ প্রচারের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন ৷ নির্বাচনী প্রচারে তিনি যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা দ্রুত পূরণ করতেও আগ্রহী ছিলেন । সেই কারণে মুইজ্জুর সরকারের প্রথম কাজটি ছিল আনুষ্ঠানিকভাবে মলদ্বীপ থেকে ভারতীয় সেনার প্রত্যাহারের দাবি জানানো ৷ ওই সেনাকর্মীদের সেখানে বিমান ও হেলিকপ্টার (ভারতের দ্বারা উপহার দেওয়া) পরিচালনার জন্য মোতায়েন করা হয়েছিল ৷ এর উদ্দেশ্য ছিল স্বাস্থ্যক্ষেত্রে উদ্ধারকাজ করা এবং মলদ্বীপের নিরাপত্তার স্বার্থে ভারত মহাসাগরে ওই দেশের জলসীমায় নজরদারি চালানো ৷

মলদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মেদ মুইজ্জু ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি (পিআইবি)

মুইজ্জু ভারতের সঙ্গে পূর্ববর্তী সরকারের তরফে সম্পাদিত চুক্তি পর্যালোচনারও নির্দেশ দেন । একই সঙ্গে, প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু বার্তা দেন যে তাঁর বিদেশনীতির ক্ষেত্রে মলদ্বীপ ভারতের চেয়ে চিনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নতি করার দিকে বেশি নজর দেবে ৷ তাঁর সিদ্ধান্তেও বিষয়টি প্রতিফলিত হয় ৷ কারণ, ভারতের পরিবর্তে তিনি তাঁর প্রথম সরকারি সফরের জন্য চিনকে বেছে নিয়েছিলেন ৷ সেই সফরে চিনের সঙ্গে একটি প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তিও সম্পাদিত করে মলদ্বীপ ।

ফলে ভারত ও মলদ্বীপের মধ্যে সম্পর্ক চরম উত্তেজনার মধ্যে পড়ে । তবে সেই পরিস্থিতি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি ৷

মলদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মেদ মুইজ্জু ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি (পিআইবি)

মলদ্বীপের আপাতদৃষ্টিতে ভারত-বিরোধী বক্তব্য এবং চিনপন্থী হওয়ার কথা বলার পরও শুরু থেকেই ভারত পরিণত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে ৷ ভারত সেখান থেকে সেনাকর্মীদের প্রত্যাহার করতে সম্মত হয় ৷ কিন্তু মলদ্বীপের সঙ্গে অন্য একটি চুক্তি করতে সফল হয় ৷ সেই চুক্তি অনুযায়ী বিমান ও হেলিকপ্টার পরিচালনায় সেনাকর্মীদের বদলে অসমারিক কর্মীরা কাজ করছেন ৷ ফলে ভারতের প্রস্তাব মেনেই মলদ্বীপ এই চুক্তি করে ৷

প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু ভূ-রাজনৈতিক ও ভৌগলিক স্থল বাস্তবতার গুরুত্ব এবং ভারত মহাসাগরে মলদ্বীপের বৃহত্তম ও ভৌগলিকভাবে নিকটতম প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে জড়িত থাকার গুরুত্ব ভালোই বোঝেন । উভয় দেশের পারস্পরিক সন্তুষ্টির জন্য ভারতীয় সামরিক কর্মীদের ইস্যুটি সমাধান হয়ে যাওয়ার পর থেকে প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু সতর্কতার সঙ্গে অগ্রসর হন এবং নিশ্চিত করেন যে তাঁর পক্ষ থেকে পদক্ষেপের কারণে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের আর যাতে কোনও ক্ষতি না হয় ।

মলদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মেদ মুইজ্জু ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতিতে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি সম্পাদন (পিআইবি)

গত ডিসেম্বরের শেষের দিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে তাঁর কয়েকজন মন্ত্রী অবমাননাকর মন্তব্য করেন ৷ মুইজ্জু দ্রুত তাঁদের সরিয়ে দেন ৷ 2023 সালের ডিসেম্বরে প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু দুবাইতে সিওপি28 এর সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে দেখা করেছিলেন এবং দুই দেশের মধ্যে অংশীদারিত্বকে আরও গভীর করার জন্য একটি কোর গ্রুপ গঠন করতে সম্মত হন । 2024 সালের অগস্টে ভারতের বিদেশমন্ত্রী মলদ্বীপ সফরে যান আলোচনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ৷ তবে তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রেসিডেন্ট মুইজ্জুর ভারত সফরের জন্য অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করা ৷

প্রেসিডেন্ট মুইজ্জুর ভারতে সাম্প্রতিক রাষ্ট্রীয় সফর একাধিক অর্থে ফলপ্রসূ ছিল । সবচেয়ে প্রথমে বলতে হয়, এই সফরে নিশ্চিত হয়েছে যে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক এখন আগের পরিস্থিতিতে ফিরে আসতে শুরু করেছে । তাছাড়া, মুইজ্জু ভারতকে আশ্বস্ত করার জন্য প্রকাশ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতি দিয়েছেন ৷ যেখানে তিনি বলেছেন, "মলদ্বীপ এমন কিছু করবে না, যা ভারতের নিরাপত্তাকে ক্ষুণ্ন করে ৷" এর পর তাঁর সংযোজন ছিল "মলদ্বীপ" আত্মবিশ্বাসী যে অন্যান্য দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক (চিনের কথা বলতে চেয়েছেন) ভারতের নিরাপত্তার স্বার্থকে ক্ষুন্ন করবে না ।" (টাইমস অফ ইন্ডিয়া-কে দেওয়া মুইজ্জুর সাক্ষাৎকার) ।

গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরের মতো মূল বিষয়গুলির পাশাপাশি ভারত এবং মলদ্বীপ একটি ভিশন ডকুমেন্ট প্রকাশ করেছে ৷ সেখানে ভবিষ্যতে দুই দেশের সম্পর্ক কোনদিকে এগোতে পারে, তা নিয়ে একটা ধারণা দেওয়া হয়েছে ৷ ভারত মহাসাগর অঞ্চলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা ও সামুদ্রিক নিরাপত্তার উপর জোর দেওয়া হবে ।

বন্দর, বিমানবন্দর, আবাসন, হাসপাতাল, রাস্তার নেটওয়ার্ক, ক্রীড়া সুবিধা, স্কুল, জল ও পয়ঃনিষ্কাশন, আবাসন-সহ বিভিন্ন এলাকায় উন্নয়ন সহযোগিতা প্রকল্পের মাধ্যমে মলদ্বীপকে সহায়তা করতে থাকবে ভারত । একই সঙ্গে ফ্ল্যাগশিপ গ্রেটার মেল কানেক্টিভিটির সময়মতো সমাপ্তির কাজও করা হবে ৷

মলদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মেদ মুইজ্জু ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি (পিআইবি)

মুদ্রা বিনিময় চুক্তির মাধ্যমে মলদ্বীপকে আর্থিক অসুবিধা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে ৷ এই সাহায্য করার জন্য ভারতের প্রতিশ্রুতির প্রতিফলনই এই চুক্তি ৷ এর অধীনে মলদ্বীপে স্বল্পমেয়াদী বৈদেশিক মুদ্রার লিকুইডিটি এবং টাকা দেওয়ার ভারসাম্য বজায় রাখতে আরবিআই 400 মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং 30 বিলিয়ন মার্কিন ডলার দেবে ৷

ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে মলদ্বীপ কৌশলগতভাবে ভারত মহাসাগর অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী এবং ভারতের প্রতিবেশী প্রথম নীতি এবং মিশন সাগর (অঞ্চলে সবার জন্য নিরাপত্তা ও উন্নতি)-এর পরিপ্রেক্ষিতেও গুরুত্বপূর্ণ ।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে, ভারত বহু-নিযুক্তির নীতি অনুসরণ করে । অতএব, ভারত মলদ্বীপের (বা অন্য কোনও প্রতিবেশী দেশ) চিন বা অন্য কোনও বড় শক্তির সঙ্গে জড়িত থাকার বিরোধিতা করে না, যতক্ষণ না তারা নিরাপত্তা ও স্বার্থ-সহ ভারতের অখণ্ডতার জন্য ক্ষতিকর কোনও কার্যকলাপে লিপ্ত না হয় ।

ভারতের সঙ্গে মলদ্বীপের স্থিতিশীল সম্পর্ক ফিরে আসায় তার প্রভাব এই অঞ্চলে পড়বে ৷ এতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উত্তেজনা এড়ানো সম্ভব হওয়ায়, তা থেকে স্বস্তির পরিস্থিতি তৈরি হয় । ভারতের নিপুণ কূটনীতি এবং মলদ্বীপের তরফে বাস্তবসম্মত অবস্থান বদল ওই দেশকে ভারতের জন্য উদ্বেগ ও বিরক্তির কারণ হওয়া থেকে আটকানো গিয়েছে ৷ যা দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগর অঞ্চলে একটি অনুকূল পরিবেশের সামগ্রিক স্বার্থের জন্য ভারতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ।

(এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ৷ এখানে প্রকাশিত তথ্য ও মতামত ইটিভি ভারত-এর মতামতকে প্রতিফলিত করে না ৷)

ABOUT THE AUTHOR

...view details