আমাদপুর, 1 নভেম্বর:কালীপুজোর পরের রাত ৷ বিদ্যুৎ থাকলেও 12টা বাজতেই গ্রামের আলো নিভিয়ে দেওয়া হল ৷ দূর থেকে এগিয়ে আসছে মশালের আলো ৷ সঙ্গে ঢাক ও কাঁসরের আওয়াজ ৷ পিছনে ভক্তদের কাঁধে চড়ে নাচছেন রণচণ্ডী ৷ মাকে সেই বছরের মতো শেষবার দেখতে কেউ উঠে যান ছাদে, কেউ এসে দাঁড়ায় বড় জানালার সামনে ৷ মশালের আলো-আঁধারিতে বিরাট মূর্তি এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে হাত জোড় করে কপালে ঠেকান গ্রামবাসীরা ৷
কালীগ্রাম হিসেবে খ্যাত আমাদপুরে পুজো ও দেবী বিসর্জন দেখার মতো ৷ পুজোর পরদিন রাতে চার বোন যখন বিসর্জন শোভাযাত্রায় বের হন, তখন গোটা গ্রাম অন্ধকারে ঢেকে যায় ৷ দাউদাউ করে জ্বলে মশাল ৷ সেই আলোর সঙ্গে ঢাক ও কাঁসরের আওয়াজে উদ্দাম নৃত্য করেন বড়-মেজ-সেজ ও ছোট মা ৷ প্রায় 400 বছরেরও বেশি সময় ধরে চলে আসছে এই রীতি ৷
আমাদপুর গ্রামজুড়ে প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিনশো কালীপুজো হয় ৷ যার মধ্যে বিখ্যাত কালীর চার বোন ৷ দীপাবলির পরের দিন বিসর্জনের নিয়ম ৷ তাও কেবল ঢাক-কাঁসরের আওয়াজ ও মশালের আলোয় ৷ এভাবেই গ্রাম প্রদর্শন করেন আমাদপুরের সব কালী প্রতিমা ৷ নিকষ কালো অন্ধকারে কেবল মশালের আলোয় রাত 12টার পর গ্রাম ঘুরতে বেরোন চার বোন ৷ ভক্তদের কাঁধে চড়ে এগিয়ে যায় বিরাট প্রতিমা ৷ বেয়ারাদের নাচের মধ্যে দিয়েই মা-ও নাচতে থাকেন ৷ অনেকেই ভাবেন এত বড় ঠাকুর কীভাবে ভক্তদের কাঁধে নাচতে নাচতে গ্রাম পরিক্রমা করে ৷
নাচতে নাচতে গ্রাম প্রদর্শন কালী প্রতিমার (ছবি : পার্থ রায়চৌধুরী)
এই বিষয়ে স্থানীয় বাসিন্দা সুব্রত সরকার বলেন, "আমাদের বিশ্বাস, দেবী মাহাত্ম্যের জেরেই এখনও প্রাচীন এই প্রথা চলে আসছে ৷ আজ পর্যন্ত কোনওদিন সমস্যা হয়নি ৷ তবে একবার গাড়িতে করে ঠাকুর নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল ৷ সেই মতো সেজ মাকে গাড়িতে তোলা হয় ৷ তবে সেবার বিসর্জন হওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল ৷ এমনকি ঠাকুর বিসর্জনের সময় জলে নামাতেও অসুবিধায় পড়েছিলেন পুজো উদ্য়োক্তারা ৷ সেই থেকে আর কেউ সাহস করেন না প্রথার বাইরে বেরিয়ে বিসর্জন করতে ৷"
তিনি আরও জানান, কেবল চার বোনই নয়; গ্রামের সব কালী প্রতিমাই কাঁধে চড়ে বিসর্জনে যান ৷ ব্যতিক্রম ভৈরব ৷ ভৈরব বা মহাদেবগুলি কিছু কাঁধে যায় ও কিছু গাড়িতে ৷ বিসর্জনের রাতে ঢাকের বোল ও মশালের আলোয় নাচতে নাচতে জমিদার পাড়ায় এসে মিলিত হন চার বোন ৷ সেখানে বেশ কিছুক্ষণ নাচের পর সংশ্লিষ্ট ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয় ৷ তবে রাত 12টা থেকে শুরু হওয়া এই বিসর্জন প্রক্রিয়া শেষ হতে সকাল 7টা বেজে যায় ৷ প্রাচীন এই রীতি চাক্ষুষ করতে দূরদূরান্ত থেকে আসেন অনেকে ৷ গ্রামের বাড়িগুলি আত্মীয়স্বজনে ভরে যায় ৷ থাকে উৎসবের মেজাজ ৷
আমাদপুরের একটি মণ্ডপে ভৈরব মূর্তি (ছবি : সুব্রত সরকার)
সকাল 7টায় ঘাটের কাছে প্রতিমা (ছবি : সুব্রত সরকার)
কালীগ্রাম আমাদপুর যাওয়ার পথ নির্দেশিকা :
হাওড়া-বর্ধমান মেন লাইনে মেমারি স্টেশন ৷ সেখান থেকে মেমারি বাসস্ট্যান্ড ৷ ওখান থেকেই মিলবে আমাদপুর যাওয়ার বাস ও অটো ৷ এছাড়া মালম্বাগামী বাসে চড়ে আমাদপুর স্কুলপাড়া মোড়ে নামতে হবে ৷
কালনা-বর্ধমান বাসরুট দিয়ে গেলে নামতে হবে পাহাড়হাটি ৷ সেখান থেকে অটো বা টোটোয় যেতে পারেন আমাদপুর ৷
কলকাতার দিক থেকে গাড়ি করে এলে কলকাতা-বর্ধমান 19 নং জাতীয় সড়ক ধরে আঝাপুর হয়ে মেমারি যেতে হবে ৷ এরপর বামুনপাড়া মোড় হয়ে পাহাড়হাটি রাস্তা দিয়ে পৌঁছনো যাবে আমাদপুর গ্রামে ৷