নয়াদিল্লি, 14 মার্চ: ‘এক দেশ এক ভোট’ নিয়ে বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর কাছে রিপোর্ট পেশ করেছে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের নেতৃত্বাধীন কমিটি ৷ সেই রিপোর্টে কমিটির পক্ষে লোকসভা ও বিধানসভার ভোট একসঙ্গে করার সওয়াল করা হয়েছে ৷ কমিটির আরও প্রস্তাব, লোকসভা ও বিধানসভার ভোট শেষ হওয়ার 100 দিনের মধ্যে স্থানীয়স্তরে নির্বাচন সেরে ফেলতে হবে ৷
62টি রাজনৈতিক দলের কাছে ‘এক দেশ এক ভোট’ নিয়ে মতামত চেয়েছিল কমিটি ৷ এর মধ্যে 47টি রাজনৈতিক দল মতামত জানিয়েছে ৷ এর মধ্যে 32টি দল একসঙ্গে নির্বাচন করার পক্ষে মত দিয়েছে ৷ আপত্তি জানিয়েছে 15টি দল ৷ বিজেপি ও তাদের শরিক করনাড সাংমার ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি) হল দু’টি জাতীয় দল, যারা একসঙ্গে ভোট করার পক্ষে মত দিয়েছে ৷ কংগ্রেস, বহুজন সমাজ পার্টি (বিএসপি), আম আদমি পার্ট (আপ) ও সিপিএম, এই চার জাতীয় দল প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়েছে ৷
গত কয়েকমাস ধরে একাধিক বৈঠক করেছে কমিটি ৷ সেখানে 15টি রাজনৈতিক দল জানায় যে সারা দেশে একসঙ্গে ভোট করলে সংবিধানের মূল ধারণা লঙ্ঘিত হবে ৷ এটা অগণতান্ত্রিক, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিপন্থী ৷ এর ফলে আঞ্চলিক দলগুলি কোণঠাসা হয়ে যাবে ৷ জাতীয় দলগুলির গুরুত্ব বেড়ে যাবে৷ রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার গঠনের দিকে নিয়ে যাবে পুরো ব্যবস্থাকে ৷
যারা এক দেশ এক ভোট সমর্থন করেছিল, তাদের মধ্যে রয়েছে বিজেপি, এনপিপি (জাতীয় দল হিসেবে) ও এআইএডিএমকে, অল ঝাড়খণ্ড স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (আজসু), আপনা দল (সোনিলাল), অসম গণ পরিষদ, লোক জনশক্তি পার্টি (আর), ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টি (অফ নাগাল্যান্ড), সিকিম ক্রান্তিকারি মোর্চা, মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট ও ইউনাইটেড পিপলস পার্টি লিবারেল অফ অসম, জেডিইউ, বিজু জনতা দল, শিবসেনা (যারা এনডিএ-র সঙ্গে রয়েছে) এবং অকালি দল ।
এর বিরুদ্ধে চারটি জাতীয় দল ছাড়াও রয়েছে, এআইইউডিএফ, তৃণমূল কংগ্রেস, এআইএমআইএম, সিপিআই, ডিএমকে, নাগা পিপলস ফ্রন্ট (এনপিএফ) ও সমাজবাদী পার্টি (এসপি) । কমিটির আহ্বানে সাড়া না দেওয়া বেশ কয়েকটি দল হল - ভারত রাষ্ট্র সমিতি, আইইউএমএল, জম্মু ও কাশ্মীর ন্যাশনাল কনফারেন্স, জেডিএস, ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা, কেরালা কংগ্রেস (এম), এনসিপি, আরজেডি, বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দল (আরএসপি), টিডিপি ও আরএলডি (এখন এনডিএ-র শরিক) এবং ওয়াইএসআরসিপি ।
অবাস্তব, 'রাজনৈতিক চমক'
কংগ্রেস, শিবসেনা (ইউবিটি) ও সিপিআই বৃহস্পতিবার 'এক দেশ, এক নির্বাচন'-এর ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টার জন্য কেন্দ্রের নিন্দা করেছে ৷ তারা বলেছে যে লোকসভা নির্বাচনের আগে এই প্রস্তাবটি ‘অবাস্তব’ এবং বিজেপির ‘রাজনৈতিক চমক’ ।
সুপ্রিম কোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী ও কংগ্রেস নেতা বিবেক তঙ্খা ইটিভি ভারত-কে বলেন, "এটি শুধুমাত্র ধারণা স্তরে ভালো৷ ওয়েস্টমিনস্টার মডেলের উপর ভিত্তি করে বর্তমান সংসদীয় গণতন্ত্রের তৈরি ৷ সেখানে এটি বাস্তবায়ন করা যাবে না । তাদের সংবিধান সংশোধন করতে হবে ৷ যার জন্য সংসদের দুই কক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োজন ।’’
তিনি আরও বলেন, “লোকসভা নির্বাচনের আগে এটি একটি রাজনৈতিক কৌশল মাত্র । প্রধানমন্ত্রী এই ধরনের স্লোগান পছন্দ করেন ৷ এই প্যানেলের সকল সদস্য এই ধারণার প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন । তাই তাদের এটিকে সমর্থন করতে হয়েছে ৷” তিনি একটি নির্দিষ্ট তারিখে দেশে লোকসভা, বিধানসভা ও পৌরসভা নির্বাচনগুলিকে একত্রিত করা নিয়ে কমিটির প্রস্তাব নিয়েও প্রশ্ন তোলেন ।
তিনি আরও বলেন, “যদিও তারা সংবিধান পরিবর্তন করে কোনোভাবে তা অর্জন করেও, তারা কি নিশ্চয়তা দিতে পারবে যে পরবর্তী নির্বাচনও একইরকম হবে ? অতীতে, রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে সময়ের আগে ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং বিধানসভাগুলিও মধ্যবর্তী মেয়াদে ভেঙে দেওয়া হয়েছে । ভবিষ্যতে যদি একই রকম পরিস্থিতি আসে, তাহলে কী হবে ? এমনকি রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার গঠনের জন্যও তাদের সংবিধান সংশোধন করতে হবে ৷"
রাজ্যসভার সাংসদ ও সিনিয়র শিবসেনা (ইউবিটি)-র নেত্রী প্রিয়াঙ্কা চতুর্বেদীর মতে, এক দেশ এক নির্বাচনের ধারণা ভারতীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না ৷ তিনি ইটিভি ভারত-কে বলেন, “তারা (সরকার) কেবল একটি ধারণার কথা চিন্তা করে একটি কমিটি নিয়োগ করেছিল ৷ আর এর বাস্তবায়নের অংশ না বিবেচনা না করেই এই রিপোর্ট নিয়ে এসেছে । এক দেশ এক নির্বাচনের ধারণা ভালো শোনালেও, বাস্তবসম্মত নয় । উদাহরণস্বরূপ, আপনি কিভাবে সম্প্রতি গঠিত বিধানসভাগুলিকে বিলুপ্ত করতে ও তাদের অবশিষ্ট মেয়াদ শেষ না করে পুনরায় নির্বাচনের জন্য রাজি করাবেন ৷"
তিনি আরও বলেন, “রসদের একটা ইস্যু হবে৷ এই মাত্রার ভোট পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক ইভিএম থাকা এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় সহায়ক কর্মী ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার সমস্যা রয়েছে । ভোটের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য আমরা দীর্ঘদিন ধরে ইভিএম ফলাফলের সঙ্গে ভিভিপ্যাট স্লিপের মিলিয়ে দেখার দাবি জানিয়ে আসছি ৷ কিন্তু নির্বাচন কমিশন এখনও পর্যন্ত সাড়া দেয়নি । তারা কীভাবে এক দেশ, এক নির্বাচন বাস্তবায়ন করবে ?’’
শিবসেনা ইউবিটি এই সাংসদ মহিলা সংরক্ষণ আইনের ইস্যুতে কেন্দ্র ও বিজেপি নিন্দা করেছেন ৷ গত বছর একটি বিশেষ অধিবেশনে লোকসভা এবং বিধানসভাগুলিতে মহিলাদের 33 শতাংশ সংরক্ষণ দেওয়ার বিল পাশ হয় ৷ পরে তা আইন হয় ৷ পরবর্তী ডিলিমিটেশন ও জনগণনার পর এই আইন কার্যকর হবে ৷ প্রিয়াঙ্কা চতুর্বেদী বলেন, “আপনি যদি এক দেশ, এক নির্বাচন নিয়ে এতই উত্তেজিত হন, তাহলে এই লোকসভা নির্বাচন থেকে আপনি মহিলা সংরক্ষণ বিল বাস্তবায়নেও একই তৎপরতা দেখাতে পারতেন । কিন্তু অসুবিধাজনক হওয়ায় তা হয়নি ।”
অন্যদিকে সিপিআই-এর ডি রাজা বলেন, “আমরা এই ধারণার বিপক্ষে ৷ কারণ, এটি একটি বহুদলীয় গণতন্ত্রে ও এত বৈচিত্র্যময় দেশের সংবিধানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় । পরিবর্তে, সরকারের উচিত ব্যাপক নির্বাচনী সংস্কারের দিকে মনোনিবেশ করা ।”
আরও পড়ুন:
- এক দেশ, এক নির্বাচন: মুর্মুকে রিপোর্ট পেশ কোবিন্দের কমিটির, পক্ষে-বিপক্ষে কারা ?
- ‘এক দেশ, এক ভোট’-এর পক্ষেই মত দিল কোবিন্দের কমিটি, রাষ্ট্রপতির কাছে রিপোর্ট পেশ