কলকাতা, 25 সেপ্টেম্বর: কলকাতার দেড়শো বছরের গণপরিবহণের ইতিহাসের অন্যতম অংশ এই ট্রাম চিরতরে বন্ধ বয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় জোর গুঞ্জন শুরু হয়েছে সংবাদ মাধ্যম থেকে গণমাধ্যমে ৷ কারণ, সম্প্রতি রাজ্য পরিবহণ দফতরের মন্ত্রী স্নেহাশীষ চক্রবর্তী জানিয়েছেন, গতির সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে শহরে একটি মাত্র রুট ছাড়া আর কোথাও ট্রাম চালানো হবে না । আর এর পরেই সংবাদমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমে রাজ্য পরিবহণ দফতরের এহেন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগড়ে দিচ্ছেন অনেকেই ।
এই খবর প্রকাশ্যে আসার পরেই নাগরিক এবং ট্রাম প্রেমীদের মধ্যে একটি বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে যে, এবার বোধহয় সত্যিই ট্রামকে তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। এই বিভ্রান্তি কাটিয়ে আইনজীবীরা জানিয়েছেন যে, এখনই হতাশ হওয়ার কোনও কারণ নেই । থাকছে ট্রাম ৷ কারণ, বিষয়টি কলকাতা হাইকোর্টে বিচারাধীন ।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি একটি সাংবাদিক সম্মেলনে রাজ্যের পরিবহণ মন্ত্রী স্নেহাশীষ চক্রবর্তী স্পষ্ট বলেছেন যে, "কলকাতা হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা চলছে। শেষ শুনানিতে ট্রাম নিয়ে রাজ্যে সরকারের কী ভাবনা, সেটা জানতে চেয়েছে আদালত। সেই মতো রাজ্যে সরকারের ভাবনা হল যে, মাত্র একটি রুটে অর্থাৎ এসপ্ল্যানেড থেকে ময়দান পর্যন্ত ট্রাম চালানো যেতে পারে। এছাড়া, বাকি রুটগুলিতে ট্রাম চালানো সম্ভব নয় । সবার ট্রামের প্রতি আবেগ থাকলেও রাস্তাকে যানজট মুক্ত করতেই শহরের বুকে আর ট্রাম চালানো যাবে না ।"
কিন্তু, এরপরে একাধিক সামাজিক মাধ্যমের প্ল্যাটফর্মে দেওয়া বিভিন্ন পোস্টের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে ৷ অনেকেই মনে করছেন যে, এটাই বোধহয় ট্রাম নিয়ে রাজ্য সরকারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ৷ কিন্তু, এই ক্ষেত্রে রাজ্য পরিবহণমন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তী জানিয়েছেন যে, এটা রাজ্য সরকারের ভাবনা এবং এই ভাবনাটি তারা যথাসময়ে আদালতের কাছে তুলে দেবে। তাই, এখনই এই ভাবনাকে সিদ্ধান্ত হিসাবে ধরে নেওয়ার কোনও কারণ নেই ৷
প্রসঙ্গত, বর্তমানে কলকাতা হাইকোর্টে ট্রাম নিয়ে দুটি মামলা চলছে ৷ দুটি মামলাতেই একাধিক বিষয় যোগ করা হয়েছে। একটি মামলার শুনানিতে আদালতের তরফে বলা হয়েছিল যে, যতদিন পর্যন্ত এই মামলার শুনানি চলবে, ততদিন ট্রামের কোনও লাইনের উপরে পিচ ঢালা যাবে না ৷ কিন্তু, সম্প্রতি দেখা গেল কালিঘাট থেকে হাজরা মোড় পর্যন্ত পিচ ঢেলে ট্রাম লাইন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ৷ এই ঘটনার পরেই ওই জনস্বার্থ মামলার সঙ্গে আদালত অবমাননার আরেকটি অবজারভেশন যুক্ত করা হয়েছে ।
ট্রামের যে দুটি মামলা চলছে তার সঙ্গে যুক্ত থাকা আইনজীবীরা জানিয়েছেন যে বিষয়টি বিচারাধীন। যে কোনও দিন এর শুনানি হতে পারে। তাই এই মুহূর্তেই এটা মনে করে নেওয়া ঠিক নয় যে ট্রাম বন্ধ হয়ে গেল। কারণ, এর আগেও ট্রামের জমিতে রসগোল্লা হাব এবং জামাকাপড়ের হাব হওয়ার কথা শোনা গিয়েছিল ৷ কিন্তু, তেমন কিছুই হয়নি। তাই এখনই ট্রাম নিয়ে হতাশ হওয়ার আপাতত কোনও কারণ নেই।
ট্রাম গবেষক ও ট্রাম-প্রেমী ডক্টর দেবাশীষ ভট্টাচার্য যিনি ক্যালকাটা ট্রাম ইউজার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ প্রসঙ্গে ইটিভি ভারতকে জানিয়েছেন, কলকাতা হাইকোর্টের পরে তাঁরা দেশের সর্বোচ্চ আদালতেও ট্রাম নিয়ে দরবার করতে পারেন। অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী স্নেহাশীষ চক্রবর্তীর সঙ্গে একটি বৈঠক হয় ৷ সেখানে তিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন, যে তিনটি রুট চলছে সেগুলি চালু থাকবে এবং বাকি রুটগুলিতে পরিষেবা পুনরায় চালু করা যায় কিনা, সেই বিষয়টিও দেখা হবে। কিন্তু, সেই কথা রাখা হয়নি।
ক্যালকাটা ট্রাম ইউজার্স অ্যাসোসিয়েশন (CTUA)-এর একজন অন্যতম সদস্য সাগ্নিক গুপ্ত জানান, সম্প্রতি পরিবহণ মন্ত্রী বলেছেন এসপ্ল্যানেড থেকে ময়দান পর্যন্ত একটি ট্রাম চালানো হবে। কিন্তু, ময়দান পর্যন্ত ট্রাম কী করে চালানো যেতে পারে ? কারণ, এই রুটটি তো শেষ হচ্ছে গিয়ে খিদিরপুরে । তাহলে ময়দান পর্যন্ত চালিয়ে আবার ট্রামটিকে কী করে এসপ্ল্যানেড পর্যন্ত ঘুরিয়ে নিয়ে আসা হবে, সেটাই এখনও পরিষ্কার নয় ।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে দুটি রুট ছাড়া বাকি রুটগুলিতে লাল বাতি জ্বলেছে। স্বাভাবিকভাবেই তাই যত ট্রামের সংখ্যা কমছে, ততই গুরুত্ব কমেছে ট্রাম ডিপোগুলিরও । একের পর এক ট্রাম কোম্পানির জমি নয় বিক্রি হচ্ছে, না হলে বিভিন্ন হাব তৈরি করতে অধিগ্রহণ করা হচ্ছে । আবার কোথায় ব্রিজের ক্ষতি হওয়ার দোহাই দিয়ে উপড়ে ফেলা হচ্ছে ট্রামের ট্র্যাক । কখনও আবার অজুহাত দেওয়া হচ্ছে এই বলে যে, ট্রাম যানজটের সৃষ্টি করে বলে বন্ধ করা হয়েছে এর পরিষেবা । বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে ট্রামের প্রাসঙ্গিকতা যে এতটুকু কমেনি এবং পুনরায় ট্রাম চলা উচিত বলেই মনে করেন সাগ্নিক ৷