বর্ধমান, 15 অগস্ট: 1912 সালের 23 ডিসেম্বর । কলকাতা থেকে দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তরের সময় শোভাযাত্রায় অংশ নেন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ । সেই শোভাযাত্রা লক্ষ্য করে বোমা মারে বিপ্লবীরা । বোমার আঘাতে রক্তাক্ত হয়ে আহত হন হার্ডিঞ্জ । সেই বোমা মারার পরিকল্পনা করেছিলেন বিপ্লবী রাসবিহারী বসু । যে রাসবিহারী বসুর হাত ধরে স্বাধীনতার মুখ দেখেছে আমাদের দেশ, সেই বিপ্লবীর জন্মভিটে আজ উপেক্ষিত ।
গ্রামবাসী মনসুর রহমান সাহানা বলেন, "খুবই লজ্জাজনক ঘটনা যে রাজবিহারী বসুর নামে যে জমি আছে, সেই জমি তাদের তিন ভাইয়ের নামে ছিল ৷ কিন্তু বর্তমানে অন্য দু'জনের নামে রেকর্ড করা হয়েছে ৷ কীভাবে সেটা হয় ! আমরা গ্রামবাসীরা এই খবরটা জানার পরে একদম ভালো লাগেনি ৷ এই গ্রামটা আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া একটা গ্রাম ৷ বন্যাপ্রবণ এলাকা ৷ এখানে যদি রাসবিহারী বসুর জন্মভূমিকে কেন্দ্র করে একটা পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা যায়, তাহলে একদিকে যেমন দেশের মানচিত্রে সুবলদহ জায়গা করে নেবে ৷ পাশাপাশি মানুষের সেই পর্যটনকে ঘিরে মানুষের আর্থিক সংস্থান তৈরি হবে ৷ এছাড়া আমরা এখানে একটা খেলার মাঠ এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে তোলা দাবি জানিয়েছি ।"
পূর্ব বর্ধমান জেলার সুবলদহ গ্রাম । বর্ধমান শহর পার করে দক্ষিণ দিকে সদরঘাট সেতু ৷ সেই সেতু পার করে দক্ষিণ দামোদরের রায়না ব্লকে সুবলদহ গ্রাম । অন্যদকে শ্যামসুন্দর হয়ে পাষন্ডা পার করে মিলবে বড় বৈনান । সেখান থেকে প্রায় 8 কিলোমিটার গেলেই মিলবে এই সুবলদহ গ্রাম । গাছ গাছালি ঘেরা গ্রাম সুবলদহ । গ্রামের ডান দিক দিয়ে বয়ে গিয়েছে দেবখাল । এটাকে খাল না বলে ছোটখাটো নদীও বলা যেতে পারে । সেই খালকে ডানদিকে রেখে নতুন বাঁধানো রাস্তা ধরেই মিলবে বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর জন্মভিটে ।
কিছুদিন আগে পর্যন্তও সুবলদহ গ্রামে ছিল কাঁচা মাটির রাস্তা । ফি বর্ষাতেও গ্রামবাসীদের দুর্ভোগের অন্ত ছিল না । যাইহোক এখন বর্ষায় কিছুটা হলেও স্বস্তি মিলেছে গ্রামবাসীদের । চারিদিকে বেশিরভাগ কাঁচা মাটির বাড়ি । একাধিক পুকুরঘাটকে ঘিরে রয়েছে তাল নারকেল বাঁশ-সহ গাছের সারি । সেই দু'পাশের বাঁশ গাছের সারির ভিতর দিয়ে গেলেই মিলবে বিপ্লবীর জন্মভিটে । তবে এখন জন্মভিটে বলতে পড়ে আছে কেবল এক চিলতে জমি । বিপ্লবীর জমিতে রয়েছে অনেক পুরনো একটা শৌচাগার । আর কিছুদিন আগে একটা বিপ্লবীর নামাঙ্কিত ফলক খোদাই করা হয়েছে । গাছগাছালির ভিতর দিয়ে বোঝার উপায় নেই যে সেখানে লুকিয়ে আছে মহান বিপ্লবীর জন্মভিটে ।
গ্রামবাসীদের দাবি, এই গ্রামকে কেন পর্যটন মানচিত্রে তুলে ধরার চেষ্টা করছে না প্রশাসন । যদিও কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী থেকে রাজ্য সরকারের একাধিক মন্ত্রী এই মহান বিপ্লবীর জন্মভিটেতে একাধিকবার ছুটে এসেছেন । প্রতিবারই তারা দিয়ে গিয়েছেন একাধিক প্রতিশ্রুতি । এমনকী রাজ্য সরকার বিপ্লবীর জন্মভিটে সংরক্ষণ করার জন্য কয়েক লক্ষ টাকা অর্থ বরাদ্দও করেছেন । সেই টাকা দিয়ে শুধুমাত্র বিপ্লবীর জমি লাগোয়া একটা ছোট পাঁচিল তোলা হয়েছে । আর হয়েছে একটা শৌচাগার । গ্রামবাসীদের আক্ষেপ, যে বিপ্লবীর হাত ধরে দেশ স্বাধীন হল তাঁর জন্মভিটে সংরক্ষণ করার জন্য সরকার কেন কোনও পদক্ষেপ করা হল না ।
স্বাধীনতার 77 বছর পরে গ্রামে শুধুমাত্র একচিলতে পাকা রাস্তা হয়েছে । গ্রামবাসীদের অভিযোগ, তাহলে যে টাকা উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ হল সেই টাকা কোথায় গেল ? কেন এই সুবলদহ গ্রামকে চেনানোর জন্য সরকারিভাবে কেন উদ্যোগ নেওয়া হল না, সেই প্রশ্নও উঠছে ।
গ্রামবাসী দীপক কুমার দাস বলেন, "অবহেলিত একটা গ্রাম সুবলদহ । কোনোদিন কাউকে দেখলাম না এই গ্রামকে প্রচারের আলোয় আনার জন্য চিন্তাভাবনা করল প্রশাসন । তবুও তৃণমূল সরকার আসার পরে গ্রামে রাস্তা হয়েছে কিছুটা হলেও অন্যান্য কাজ হয়েছে । এই গ্রামকে কেন্দ্র করে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা উচিত । এই গ্রামে একটা প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র আছে সেটার উন্নতি করা উচিত । এখানে পর্যটন কেন্দ্র হলে সেটাকে কেন্দ্র করে মানুষের কর্মসংস্থান গড়ে উঠবে । অথচ কেন্দ্রের মন্ত্রী থেকে রাজ্যের একাধিক মন্ত্রী এখানে ছুটে এসেছেন তারা প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন । কিন্তু এই তৃণমূল সরকারের আমলে কিছুটা কাজ হয়েছে । কিন্তু তাতে গ্রামের ছবিটা বদলে যায়নি ।
শেখ আসগর আলি বলেন, "রাসবিহারী বসুকে গোটা বিশ্ব চেনে । কিন্তু এখানে কেউ তাঁকে সম্মান জানায়নি । এখানে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী থেকে রাজ্যের মন্ত্রীরা এসেছেন কিন্তু কাজের কাজ হয়নি । গ্রামের কোনও উন্নতি হয়নি । আজ যে মানুষের হাত ধরে আমাদের দেশ স্বাধীনতার মুখ দেখেছে তিনিই আজ উপেক্ষিত রয়ে গেলেন ।"
পূর্ব বর্ধমান জেলা পরিষদের সভাধিপতি শ্যামাপ্রসন্ন লোহার বলেন, "বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর জন্মভিটেতে দীর্ঘদিন কেউ নজর দেয়নি । গ্রামে রাস্তাঘাট ছিল না । আমাদের সরকার আসার পরে রাজ্য সরকারের তরফে সেখানে রাস্তাঘাট-সহ একাধিক কাজ হয়েছে । আগামিদিনে ওই জায়গাকে আরও উন্নত করে গড়ে তোলার পরিকল্পনা আছে ৷"