জলপাইগুড়ি, 4 সেপ্টেম্বর: জাস্টিস ফর আরজি কর ! এই স্লোগান তুলে গত 26 দিনে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ পথে নেমেছেন ৷ সমাজের বিভিন্ন অংশ তাতে সামিল হয়েছে ৷ ডাক্তারদের একাধিক সংগঠন তো বটেই অন্য পেশায় যুক্তরাও আরজি কর মেডিক্য়াল কলেজ ও হাসপাতালে চিকিৎসক পড়ুয়ার ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন ৷ এই পরিস্থিতিতে আশ্চর্যজনকভাবে নীরব ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের জলপাইগুড়ি শাখা ৷
অথচ ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন বা আইএমএ রাজ্যস্তর থেকে জাতীয়স্তর পর্যন্ত আরজি করের ঘটনার প্রতিবাদে সামিল হয়েছে ৷ আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে সাসপেন্ড করে দিয়েছে আইএমএ ৷ তার পরও কেন নীরব ওই সংগঠনের জলপাইগুড়ি শাখা ? এই প্রশ্নেই সরগরম উত্তরবঙ্গ ৷
পরিস্থিতি এমনই যে সংগঠনের কেউই মুখ খুলতে চাইছেন না ৷ কেন এত নীরবতা ? তা জানতে আইএমএ-র জলপাইগুড়ির সভাপতি নিতাই মুখোপাধ্যায়কে ফোন করা হয় ৷ কিন্তু তাঁর ফোন বন্ধ থাকায় প্রতিক্রিয়া মেলেনি ৷ তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংগঠনের একজন গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী বলেন, ‘‘আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে চিকিৎসক তরুণীকে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় আমাদের পথে নামা উচিত ছিল । কোনও আলোচনাও হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে হয়নি৷ এটা দুঃখজনক ।’’
জলপাইগুড়ির এক পরিবেশপ্রেমী, যিনি বিভিন্ন আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত, বিশ্বজিৎ দত্ত চৌধুরী এই নিয়ে বলেন, ‘‘আমরা সাধারণ মানুষ আরজি করের ঘটনা নিয়ে রাস্তায় প্রতিবাদে নেমেছি । ডাক্তারদের সুরক্ষা নিয়ে আন্দোলন করছি । তথ্যপ্রমাণ লোপাটের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে । সবাই রাস্তায় নেমেছি । কিন্তু চিকিৎসকদের সংগঠন আইএমএ-র জলপাইগুড়ি শাখা কেন চুপচাপ আছে, তা আমাদের মাথায় ঢুকছে না ।’’
সত্যিই তো! যাঁর মর্মান্তিক পরিণতি হল, তিনি তো চিকিৎসক ছিলেন ৷ যাঁরা আন্দোলনে নেমেছেন, তাঁদের অধিকাংশ তো চিকিৎসকই ৷ তাহলে আইএমএ-র জলপাইগুড়ি শাখা কেন পথে নামল না ? এই নিয়ে ওই সংগঠনেরই প্রাক্তন সম্পাদক ড. পান্থ দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘এখানে অনেক জটিলতা আছে । সারা দেশের মতো জলপাইগুড়ির চিকিৎসকরাও বিচলিত এবং একই রকম ভাবে নারকীয় ঘটনার প্রতিবাদ করতে চাইছেন ৷ কিন্তু সমস্যা হচ্ছে জলপাইগুড়ি আএএমএ-র মাথায় যাঁরা আছেন, এক সময়ে নানারকম প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তাঁরা আইএমএ-র কর্তৃত্ব দখল করতে চেয়েছেন । বারবার চিকিৎসকরা ক্ষোভ প্রকাশ করলেও তাঁদের সরানো যায়নি । তাঁদের পিছনে ক্ষমতাতন্ত্রের আশীর্বাদ ছিল ।’’
কারা এই কর্তৃত্ব কায়েম করতে চাইছেন ? সেই নিয়ে অবশ্য স্পষ্ট করে কারও নাম বলেননি ড. দাশগুপ্ত ৷ তিনি বরং নিশানা করেছেন স্বাস্থ্যব্যবস্থার মধ্যে থাকা ‘উত্তরবঙ্গ লবি’কে ৷ যে লবির নাম আরজি করের ঘটনার পর থেকেই শোনা যাচ্ছে ৷ স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় একাধিক দুর্নীতির সঙ্গে এই লবির সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসকরাই জড়িয়ে বলে অভিযোগ উঠছে বারবার ৷
ড. দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘উত্তরবঙ্গ লবির কথা আমরা প্রতিদিন বলছি, জানছি, শোনাও যাচ্ছে । উত্তরবঙ্গ লবির মাথারা জলপাইগুড়িতে রয়েছেন । ফলে আইএমএ-র যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তারা চাইছেন না সাধারণ চিকিৎসকের ক্ষোভ আইএমএ-র মাধ্যমে প্রতিফলিত হোক । কিন্তু একথা মনে করার কোনও কারণ নেই যে চিকিৎসকরা বসে আছেন ।’’
ড. দাশগুপ্ত কারও নাম না করতে চাইলে আইএমএ-র জলপাইগুড়ি শাখার নীরবতা নিয়ে পরিবেশপ্রেমী বিশ্বজিৎ দত্ত চৌধুরী সরাসরি নিশানা করেছেন আইএমএ-র জলপাইগুড়ি শাখার সম্পাদক ড. সুশান্ত রায়কে ৷ বিশ্বজিৎ দত্ত চৌধুরী বলেন, ‘‘ড. সুশান্তকুমার রায় জেলার সম্পাদক । সংগঠনের অফিস তালাবন্ধ । তাঁরা কেন প্রতিবাদে নেই, তার উত্তরটা সুশান্তকুমার রায়কেই দিতে হবে ।’’
উল্লেখ্য, সুশান্ত রায়কে নিয়ে আগেই অনেক বিতর্ক হয়েছে ৷ তিনি প্রভাবশালী বলেই পরিচিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অন্দরে ৷ সেই প্রভাবেই তিনি স্বাস্থ্যবিভাগে উত্তরবঙ্গের ওএসডি হয়েছিলেন বলে অভিযোগ করেন অনেকে ৷ চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর এখন তিনি ওয়েস্ট বেঙ্গল মেডিক্যাল কাউন্সিলের সহ-সভাপতি ৷ তবে চাকরি থেকে অবসরের পরও বিতর্ক তাঁর পিছু ছাড়েনি ৷ আরজি কর-কাণ্ডেও তাঁর নাম জড়িয়েছে ৷
গত 9 অগস্ট ওই তরুণী চিকিৎসকের দেহ উদ্ধারের পর আরজি করে গিয়েছিলেন সুশান্ত রায় ৷ সেকথা সংবাদমাধ্যমের কাছে তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন ৷ মেডিক্যাল কাউন্সিলের নির্দেশ সেদিন আরজি করে তিনি গিয়েছিলেন বলে সংবাদমাধ্যমের কাছে দাবি করেছেন সুশান্ত রায় ৷ প্রশ্ন উঠেছে, খুনের ঘটনাস্থলে মেডিক্যাল কাউন্সিলের কী কাজ ? স্বাভাবিকভাবে চিকিৎসকরা যে তথ্যপ্রমাণ লোপাটের অভিযোগ তুলেছেন, সেই অভিযোগের মধ্য়ে সুশান্ত রায়ের নাম জড়িয়ে গিয়েছে ৷
তাই সকলের মনেই এখন প্রশ্ন যে আরজি কর-কাণ্ডে নাম জড়ানোর জেরেই সুশান্ত রায় জলপাইগুড়ি আইএমএ-কে প্রতিবাদে নামতে দিচ্ছেন না ? এই প্রশ্নের উত্তর যিনি দিতে পারবেন, সেই ড. সুশান্ত রায়ের সঙ্গেও মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে উত্তর পাওয়া যায়নি । ফলে তাঁর প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি ।
এছাড়া আরজি কর-কাণ্ডে নাম জড়িয়ে যাওয়া আরও এক চিকিৎসক অভীক দে জলপাইগুড়ি আইএমএ-র সহ-সভাপতি ৷ বিতর্কের জেরে তাঁকে সাসপেন্ড করেছে টিএমসিপি ৷ যদিও তাতে বিতর্কে অবশ্য থামেনি ৷ সেটাও কি জলপাইগুড়ি আইএমএ-র নীরবতার আরও একটা কারণ ! ধোঁয়াশা অব্যাহত ৷