মালদা, 27 মার্চ: দিন বদলায়, বদল ঘটে প্রতিশ্রুতিরও ৷ শুধু রাজনৈতিক নেতানেত্রী নয়, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের দোষে দুষ্ট প্রশাসনের কর্তারাও ৷ ভোটের মুখে এমনটাই বলছেন গঙ্গা ভাঙনের জেরে ভিটেহারারা ৷ তাঁরা চান মাথা গোঁজার একটা জায়গা ৷ তাঁদের অভিযোগ, 'দিচ্ছি-দেব' করে তাঁদের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক খেলা খেলছেন নেতারা। এমনকী প্রশাসনও কথা দিয়েও কথা রাখছে না ৷ বারবার আশাহত হয়ে তাই এবারের লোকসভা ভোট থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখার চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে রতুয়া 1 নম্বর ব্লকের ভাঙন আক্রান্ত বেশ কয়েকটি গ্রামে ৷ রতুয়ার দুর্গতদের এই ক্ষোভ যদি জেলার প্রতিটি ভাঙন আক্রান্ত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে তাহলে কিন্তু ভোটপর্বে সমস্যায় পড়তে পারে হতে প্রশাসন বলে মনে করছে রাজনৈতিকমহল ৷
সত্তরের দশক থেকেই মালদা জেলা গঙ্গার বিষ নজরে ৷ জেলার পাঁচটি ব্লক ভাঙন আক্রান্ত ৷ বিপন্ন লক্ষ লক্ষ মানুষ ৷ গঙ্গায় বাঁধ দিয়ে মাটি রক্ষার চেষ্টা করা হয়েছিল বটে, কিন্তু ভয়াবহ ভাঙনে একে একে সাতটি এমন বাঁধ নদীতে তলিয়ে গিয়েছে ৷ তলিয়ে গিয়েছে পাথরে বাঁধাই পাড়, প্রোকোপাইনের পিলার ৷ প্রচুর মানুষ সব খুইয়ে পথের ভিখারিতে পরিণত ৷ তবে সাম্প্রতিক সময়ে গঙ্গার সবচেয়ে বেশি ভাঙন হয়েছে রতুয়া 1 নম্বর ব্লকের মহানন্দটোলা গ্রাম পঞ্চায়েতের কান্তটোলা, শ্রীকান্তটোলা, দ্বারিকাটোলা সহ অন্তত 6-7টি গ্রামে ৷
এই পঞ্চায়েতের জঞ্জালিটোলা, খাট্টিটোলা, খাকসাবোনা গ্রামগুলি গত মরশুমেই গঙ্গায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে ৷ সেসব গ্রামের অনেক মানুষ এখনও বাঁধ-সহ বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিয়ে রয়েছেন ৷ প্রথমদিকে প্রশাসনের তরফে দুর্গতদের খাবারের ব্যবস্থা করা হলেও গত বছরের বিজয়া দশমীর দিন থেকে তা বন্ধ ৷ কিন্তু সব ছাপিয়ে দুর্গতদের মুখে উঠে এসেছে মাথা গোঁজার সমস্যার কথা৷ প্রশাসনের কাছে তাঁরা শুধু এটুকুই দাবি করছেন ৷
কান্তটোলা গ্রামের 59 বছর বয়সি হরিশচন্দ্র মণ্ডল বলছেন, "বাপ-ঠাকুরদার জন্মও এই গ্রামে ৷ আমাদের 200 গজ লম্বা পাকা বাড়ি ছিল ৷ ছ'বিঘা জমিও ছিল ৷ গত শ্রাবণে সব নদীতে চলে গিয়েছে ৷ একটা সময় গঙ্গা 12 মাইল দূরে ছিল ৷ এখন গ্রামে ঢুকে পড়েছে ৷ একদিন কিংবা দু'দিন নয়, এই ভাঙন-সমস্যা বহুদিনের ৷ কিন্তু কেউ কিছু করে না ৷ গঙ্গাকে রোখার প্রতিশ্রুতিও কেউ দেয় না ৷ আসলে এই ভাঙনকে কেন্দ্র করেই সবাই কামাই করে যাচ্ছে ৷ আমরা আর কোথায় যাব? আমাদের সবই শেষ ৷ কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সরকারের কাছে আমার আর্জি, ওদের বাঁচার একটা ব্যবস্থা করে দিন ৷ একটা পুনর্বাসনের জায়গা দিন ৷"
বাড়ি হারিয়েছেন ছ'মাস আগে ৷ এখনও শোক সামলে উঠতে পারেননি অর্চনা মণ্ডল ৷ তিনিদেখিনম বলেন, "নদীতে ঘর পড়ার পর অনেকে এসেছিল ৷ সবার মুখেই এই করে দেব, ওই করে দেব ৷ কেউ কিছু করেনি ৷ আমাদের বাড়ি করার জায়গা দেওয়ার কথা বলেছিল ৷ ভরসা করেছিলাম ৷ জায়গা পেলে কোনওভাবে মাথা গোঁজার বন্দোবস্ত করতে পারব বলে নিজের উপর বিশ্বাস আছে ৷ কিন্তু এমএলএবাবু কাগজে সই করল না ৷ আমাদের জায়গাও হল না ৷ খগেন মুর্মু এসে বলেছিল, ওরা জায়গা দিলে সে ঘর বানানোর জন্য কিছু পয়সা দেবে ৷ জায়গা না হওয়ায় সেই পয়সাও পেলাম না ৷ আবার ভোট আসছে ৷ আবার সবাই ভোট চাইতে আসবে ৷ যে আমাদের জায়গার ব্যবস্থা করে দেবে তাদের ভোট দেব, নইলে ভোটই দেব না ৷ এটা গোটা গ্রামেরই কথা ৷"
এই গ্রামেরই বর্তমান প্রজন্ম আশিস মণ্ডল ৷ গঙ্গায় ঘর হারিয়ে পাশের গ্রামে নতুন বাড়ি করেছেন ৷ তাঁর বক্তব্য, "জন্ম থেকে গঙ্গার ভাঙন দেখছি৷ বাবারা তিনবার বাড়ি পালটেছে ৷ আমি একবার করলাম৷ দেখেছি অনেক ভোটও ৷ এই ভাঙনকেই ভোটের ইস্যু করে প্রতিটি রাজনৈতিক দল ৷ প্রত্যেকে ভুরি ভুরি প্রতিশ্রুতি দেয় ৷ কাজ কিছু করে না ৷ এবারও সিপিআইএম প্রতিশ্রুতি দিতে শুরু করেছে ৷ সব ভাঁওতা ৷ আসলে দলের রং পালটায়, কিন্তু মানুষগুলো একই থাকে ৷ এবারও সব দলের আসা শুরু হয়েছে ৷"
ফোন ধরেননি বিধায়ক সমর মুখোপাধ্যায় ৷ ফলে গ্রামবাসীদের অভিযোগ প্রসঙ্গে তাঁর প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি ৷ রতুয়া 1 নম্বর ব্লকের বিডিও রাকেশ টোপ্পো জানিয়েছেন, যে সরকারি খাস জমিতে দুর্গতদের পুনর্বাসন দেওয়ার কথা ভাবা হয়েছিল, সেই জমি নিয়ে একটি মামলা বিচারাধীন অবস্থায় রয়েছে ৷ অন্য জমির খোঁজ চলছে ৷ জমি মিললেই ভাঙন দুর্গতদের সেখানে পুনর্বাসন দেওয়া হবে ৷
রতুয়া 1 নম্বর ব্লকে গঙ্গা ভাঙনের শিকার হাজার দেড়েক মানুষ ৷ কিন্তু এই মানুষগুলির ভোটের বিরুদ্ধে অবস্থান যদি ছড়িয়ে পড়ে তবে মানিকচক ও কালিয়াচক 3 নম্বর ব্লকের ভাঙন দুর্গতরাও নিশ্চিতভাবে তাতে সামিল হয়ে পড়বেন ৷ তাতে প্রতিবাদী মানুষের সংখ্যা হয়ে যাবে প্রায় সাত হাজার ৷ তেমন হলে সমস্যায় পড়তে হতে পারে প্রশাসনকেই ৷
আরও পড়ুন: